এক উদ্যোগী আইরিশ সাহেবের "বং Connection"

এক উদ্যোগী আইরিশ সাহেবের "বং Connection"

Tuesday February 09, 2016,

3 min Read

পল নিউম্যানকে মনে আছে? দু শতাব্দী আগের মানুষ। রাজা রাজড়া নন। ব্রিটিশ সরকারের কোনও হোমড়া চোমড়াও নন। দেশোদ্ধারে ব্রতী কোনও মহান ব্যক্তিত্ব নন। কিন্তু তবু কলকাতার ইতিবৃত্ত লেখা হলে তাঁর নামোল্লেখ ছাড়া সেটা অসমাপ্ত থেকে যাবে। তিনি পল নিউম্যান। না এটা ক্যুইজ কনটেস্ট নয়।

আচ্ছা ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে পুরনো গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের ঠিক উল্টোদিকে নিউম্যান পাবলিশিং হাউসের মালিক ছিলেন এই ভদ্রলোক।

image


ডবলু নিউম্যান এন্ড কোং লিমিটেড। বুকসেলার্স, স্টেশনার্স, প্রিন্টার্স। এই হল নিউম্যান পাবলিশিং এর আসল পরিচয়। ১৩ মে ১৯২০ সালে তৈরি। স্বদেশি এবং বিদেশি বই, পাঠ্যপুস্তক, নভেল যে কোনও ধরনের বইয়ের অব্যর্থ ঠিকানা ছিল নিউম্যান হাউস। সারাদিন ঠাসা ভিড় থাকত দোকানে। রমরমিয়ে চলত ব্যবসা, সেসময় কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের একটা আড্ডাখানা হয়ে উঠেছিল এই দোকান।আইরিশ বাবুও হয়ে গিয়েছিলেন পাক্কা বাঙালি বাবু।

এক এক করে অনেক বন্ধু হয়। কলকাতার সঙ্গে সখ্যতা বাড়ে। পলের ছেলে কলকাতার বইয়ের দোকান নিয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহিত ছিলেন না। বরং উদাসীনই থাকতেন। পেশায় ইঞ্জিনিয়র। কাজকর্ম নিয়ে দেশ (আয়ারল্যান্ডের) চৌহদ্দির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করতেন। প্রকাশনা আর বইয়ের জগতে আবেগের দৌড়ে দাদুর যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন পলের নাতি ফিলিপ। পল বার্ধক্যে পৌঁছতেই পাবলিশিং হাউসের দেখভাল করার দায়িত্ব পান ফিলিপ নিউম্যান। কিন্তু এক গাঁয়ে চাষ অন্য গাঁয়ে বাস তো আর হয় না। তাই সিম্পলি হল না। তবু দীর্ঘদিন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

এই পল সাহেব বছরের বেশির ভাগ সময়ই পড়ে থাকতেন কলকাতায়। কখনও পরিবার ছাড়া, কখনও সপরিবারে। আর ক্রিসমাসের আগে নিয়ম করে ফিরে যেতেন আয়ারল্যান্ড। ঠিক যেমন প্রবাসী বাঙালিরা দুর্গাপুজোয় ফিরে আসেন তেমনি। কিন্তু তার নাতি ফিলিপ ঠিক তার উল্টো। বাংলাকেই মনে করেন তাঁর স্বদেশ। তবু চিরকাল আয়রল্যান্ডে চাকরি করেছেন। ফিরে এসেছেন বারেবারে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন ফিরে আসেন ফিবছর। ক্রিসমাসের আগে পরে, বর্ষশেষের উৎসবটা কাটান দার্জিলিঙে।

এরকমই এক কমলা বিকেলে, হু হু ঠাণ্ডায় ফিলিপ সহেবের সাথে দেখা হল দার্জিলিং ম্যালে, ষাটোর্ধ আইরিশ এই ভদ্রলোক ঠিক আমার পাশে দাঁড়িয়ে 'চা উৎসব' এর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখছিলেন, আর পটাপট ছবি তুলছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগ বাড়িয়ে আলাপ জমাতেই চোখের সামনে হারিয়ে যাওয়া কলকাতার একটা রোদে পোড়া দুপুরের ছবি ফুটে উঠলো। ভেসে উঠল কলকাতার সেই বিখ্যাত বই এর দোকানের ফ্ল্যাশব্যাক। এ এক অন্য "BONG কানেকশন"।

ভারত এবং কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগের গল্প শুনছিলাম ফিলিপ সাহেবের কাছ থেকে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সবে সন্ধ্যে নেমে আসা পাহাড়ি বাঁকের দিকে এলোমেলো দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে ফিলিপ বললেন "পাবলিশিং হাউসের কাজটা খুব উপভোগ করতাম। আমিও বাবার মত মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছি। আয়ারল্যান্ডে সেই কাজই করেছি। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন, যেই কলকাতায় আসতাম, মনে হত সব ছেড়ে দিয়ে পাবলিশিংয়ের কাজটাই করি। ভীষণ টানত"। তাই বইয়ের দোকানটা যতদিন পেরেছেন চালিয়েছেন। এখন আর কিছু নেই। চুকে বুকে গেছে। শুধু জীভে লেগে আছে পুরনো গ্রেট ইস্টার্নের বেকারির স্বাদ। এখনও ফিলিপের স্মৃতিতে উজ্জ্বল ডেকার্স লেন।

১৯৭৬ থেকে কলকাতায় যাতায়াত। আর এলেই তাঁকে একবার যেতেই হয় দার্জিলিঙ। গত ৩৯ বছর ধরে এটাই রুটিন। একটা বছরও নাকি মিস হয়নি।

বাইরে ততক্ষণে হাড় কাঁপানো কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। ঘড়িতে সবে সাড়ে ছ’টা, অথচ হাওয়ার তীব্রতা অনুভব করলে মনে হবে অনেক রাত। ম্যালে উৎসব চলছে। পাহাড়ি নাচ, গান, বর্ণাঢ্য সাজে সুসজ্জিত স্থানীয় মানুষ। আলোর সাতনরি হারে শতাব্দী প্রাচীন স্লেট হোটেল কে দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে লাজেরাঙা কনে । ওই রোম্যানটিসিজম ভেঙ্গে ফিসফিস করে ফিলিপ বললেন , ‘এর জন্যই তো এত কিছু । দেশের মায়া ছেড়ে প্রতিবছর এই সময় এখানে ছুটে আসা আর প্রতিবছর দার্জিলিঙকে নতুন করে পাওয়া ।’

দার্জিলিং নিয়ে ফিলিপের দারুণ অবসেশন ততটাই কলকাতা নিয়েও। এতটাই যে তিনি বলছিলেন, তিনি নাকি আসলে বাঙালি হয়ে গেছি । আইরিশ পরিচয়টা শুধু পাসপোর্টে লেখা থাকে।’