‘কাজের মেয়েরা’ এখন সত্যিকারের কাজের মেয়ে
Thursday January 14, 2016,
3 min Read
কাকভোরের আগে ওঠে বাড়ির রান্না সেরে নেওয়া। কুকুরের উৎপাত সামলে তিন-চার কিলোমিটার প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ফার্স্ট ট্রেন ধরা। প্রবল ভিড়ে ধাক্কা খেত খেতে যাদবপুর, ঢাকুরিয়া কিংবা বালিগঞ্জে যখন ট্রেন ঢোকে তখন পূবের আকাশ সবে ফরসা হচ্ছে। ট্রেন থেকে নেমে হনহনিয়ে ‘বাবু’র বাড়িতে কাজে যাওয়া। এমন জীবনসংগ্রামে এক সময় জীবনের বর্ণমালাটা কেমন যেন বেরঙিন হয়ে গিয়েছিল শোভা, বৃহস্পতিদের। এই গড্ডালিকায় গা ভাসাতে চাননি দীপালি হালদারের মতো কয়েকজন। বৃহস্পতি, ললিতাদের তাঁরা বোঝান পরের বাড়িতে গিয়ে ‘ঝি’-এর কাজ করে হারিয়ে গেলে চলবে না, হাতের কাজ দেখিয়ে সম্ভ্রমের জায়গাটা তৈরি করতে হবে। সেই ভাবনা থেকে বাটিকের কাজ শুরু। তাদের তৈরি পোশাকের ওপর রংয়ের খেলার মতো ক্যানিং-এর বাহিরবেনা, ধলিরবাটির মেয়েদের আকাশে এখন স্বপ্নের মেঘার ভেলা।
একফসলি জমি। তাই বছরের বাকি সময়টা জোগাড়ে, রাজমিস্ত্রির কাজ। বাড়ির কর্তাদের যদি কাজের এই অবস্থা হয় তাহলে গিন্নিরা আর কোথায় কাজ খুঁজবেন। সংসারে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের খোঁজে বধূরা সহজ রাস্তা হিসাবে নেন ‘পরিচারিকার’ কাজ। এভাবেই দক্ষিণ কলকাতা ও শহরতলির বিস্তীর্ণ এলাকার বাড়ির কাজের লোকের ‘সাপ্লাই লাইন’ হয়ে উঠেছে ক্যানিং লাইন। বিয়ের পর থেকে দিনরাত এভাবে হাড়ভাঙা খাটতে খাটতে হাঁফিয়ে উঠছিলেন ক্যানিং-এর বাহিরবেনা, ধলিরবাটির বৃহস্পতি সরকার, শোভা মণ্ডল, ললিতা হালদার, ভারতী সরদাররা। কিছু একটা করতে চাইছিলেন তাঁরা। তাঁদের সেই স্বপ্নকে উস্কে দেন এলাকারই মেয়ে দীপালি হালদার। দীপালিদেবীর মনে হয়েছিল গ্রামের মেয়েরা সেলাইয়ের কাজে মন্দ নয়। বাটিকের কাজও টুকটাক জানে। সেই ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পথচলা শুরু হয় ‘স্বর্ণলতা’ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর। ঠিক হয় সেলাইয়ের কাজ ও বাটিকের ওপর চুড়িদার, শাড়ি, চাদর, লুঙ্গি, বেডশিট তৈরি করবে মেয়েরা।
২০০৭ সালে ‘স্বর্ণলতা’ তৈরির সময় কম কথা শুনতে হয়নি দীপালি, শীলাদের। কেউ বলেছিল এসব করে কী হবে, কারও বক্তব্য ছিল কে কিনবে ঠিক নেই তার জন্য এত খাটনি। নেতিবাচক কথাবার্তার মধ্যেও লক্ষ্য স্থির ছিল এই মহিলাদের। কাজের প্রতি নিষ্ঠা ছিল প্রথম থেকেই। তার ফলও মেলে। কম দামে গোষ্ঠীর মেয়েদের তৈরি পোশাক নেওয়ার জন্য ক্যানিং-এর ব্যবসায়ীরা এখন যোগাযোগ করছেন। পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মেলা, প্রদর্শনীতে ‘স্বর্ণলতা’-র সদস্যরা তাঁদের সামগ্রী তুলে ধরেন। রাজ্য হস্তশিল্প মেলা ও সবলা মেলায় ভাল সাড়া পেয়েছেন তাঁরা। মিলনমেলায় শুধু বাটিকের চুড়িদার ও শাড়ি মিলিয়ে তাদের পঞ্চাশ হাজার টাকার বিক্রি হয়েছে। সবলাতেও প্রচুর চুড়িদার, শাড়ি বিকিয়েছে। আর ভোরের ট্রেনের ডেলি প্যাসেঞ্জারি নয়, এখন বাংলা পেরিয়ে নিজস্ব কারুকাজ নিয়ে দীপালিদেবীরা পৌঁছে যাচ্ছেন দেশের নানা প্রান্তে। এর মধ্যেই দিল্লির প্রগতি ময়দানে দুবার সরকারি মেলায় গিয়েছেন তাঁরা, কখনও কর্ণাটকের হুবলিতে। ভিনরাজ্যে গিয়ে গোষ্ঠীর মেয়েরা বুঝতে পেরেছেন বাটিকের কাজের যথেষ্ট কদর আছে। তাই সব ভুলে এখন কাজ নিয়েই গোষ্ঠীর বারো জন যোদ্ধা ব্যস্ত থাকেন।
‘স্বর্ণলতা’ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর এই উত্থানে প্রভাবিত ক্যানিং ২ নম্বর পঞ্চায়েত। তারা সাধ্যমতো পাশে দাঁড়িয়েছে। এই গোষ্ঠীর সম্পাদক দীপালি সরকার বললেন, ‘‘বাটিকের কাজে আমরা আর বৈচিত্র্য চাই। নকশার অদল-বদল করে আরও কী কী করা যায় তা নিয়ে আমরা আলোচনা করি। এই ব্যাপারে ঠিকমতো প্রশিক্ষণ পেলে মনে হয় অনেকটা এগোতে পারব।’’ অগ্রগতির ছাপ এখন থেকেই বোঝা গিয়েছে বাহিরবেনা, ধলিরবাটির মতো গ্রামগুলিতে। পরের বাড়িতে কাজের যাওয়ার রুটিনটা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করছে। দীপালিদেবীর কথায়, ‘‘বাটিকের হাত ধরে সংসারে কিছুটা অবদান রাখতে পেরে খুবই ভাল লাগছে। মেয়েরা যে এখন বাড়িতে বসেই রমরমিয়ে কাজ করছে তাতে মনে হয় দায়িত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছে।’’ ‘স্বর্ণলতা’ দলের সম্পাদকের কথার অনুরণন শোভা, ভারতী, বৃহস্পতিদের গলায়। শোভা মণ্ডলের কথায়, ‘‘দীপালিদেবী আমাদের সাহস জুগিয়েছেন। সবকিছু হাতে ধরে শিখিয়েছেন। বাটিকের কাজ আমাদের নতুন জীবন দিয়েছে।’’ ‘ঝি’-এর তকমা সরিয়ে নতুন সকালের আলোয় চকচক করে ওদের মুখ।