অভিষেকের PARK24X7 কলকাতার চিরস্থায়ী সমাধান

অভিষেকের PARK24X7 কলকাতার চিরস্থায়ী সমাধান

Friday September 22, 2017,

5 min Read

সানি ওর ডাক নাম। সবাই ওকে চেনেন। কলকাতার উদ্যোগপতিদের মৌচাকে ও এক পরিচিত মৌমাছি। যদিও খুব কাছের লোকেরাই ওকে এই নামে ডাকেন। বিশেষ করে রানাঘাটের বন্ধুরা। কলকাতায় অভিষেক তরফদারের ডাক নাম স্পাইডি। এই ডাক নামের রহস্য ওর কাজের ভিতরই লুকিয়ে আছে। তবে বলে রাখি হোয়াটস অ্যাপে Nobody লেখা ভেসে ওঠে ওর নম্বরের পাশে।
image


অভিষেক তরফদার। PARK24X7 নামে একটি অনলাইন গাড়ি পার্কিং স্টার্টআপের কর্ণধার। সম্প্রতি কলকাতায় বেশ চর্চিত ওর স্টার্টআপ। আসন্ন ফিফার অনূর্ধ্ব সতের বিশ্বকাপে অভিষেকের এই সংস্থাও একটি পার্টনার। দর্শকদের গাড়ি পার্কিংয়ের দায়িত্ব নিচ্ছেন ওরা। শুধু কি তাই কলকাতার রাস্তায় যারা গাড়ি নিয়ে বেরতে ভয় পান তাদের রীতিমত অভয় দিচ্ছে ওর অ্যাপ। সরকারের সঙ্গে, কলকাতা কর্পোরেশনের সঙ্গে, কলকাতা পুলিশের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের সমস্যার সমাধানের রাস্তা বাতলে দিয়েছেন এই ডেভেলপার। কীভাবে আইডিয়া এলো শুনলে হেসে গড়িয়ে পড়বেন। সমস্যাটা তো সমস্যার জায়গায় চিরকালই ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের কোনও এক সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রিটের একটি নৈশ ক্লাবে গিয়েছিলেন অভিষেক। গাড়িটা দেখে শুনে রাস্তায় পার্ক করে। যিনি পার্কিং সামলাচ্ছিলেন তার হাতে অগ্রিম টাকাও গুজে দিয়েছিলেন খেয়াল রাখার আগাম ভাড়া। তাও ফিরে এসে দেখেন গাড়ির চাকায় কাঁটা লাগিয়ে দিয়ে গেছে পুলিশ। সেই থেকে ভাবনা মাথায় ঘুরছিল কীভাবে গাড়ি পার্কিংয়ের সমস্যার স্থায়ী এবং যুগোপযোগী সমাধান করা যায়। অ্যাপটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে পারলেই কেল্লা ফতে। আপনি ম্যাপেই দেখতে পাবেন কোথায় পার্কিং স্পেস ফাঁকা। অনেকেই আছেন টাকার বিনিময়ে নিজেদের ব্যক্তিগত বাড়ির গ্যারেজে কিংবা ফাঁকা জায়গায় অপরের গাড়ি রাখতে দিতে রাজি। তারাও অ্যাপের মাধ্যমে স্পেস ভাড়া দিতে পারেন। এভাবেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও তাদের ফাঁকা স্পেসকে শহরবাসীর গাড়ির জন্যে অনায়াসেই ভাড়া দিতে পারছে। ফলে দুপক্ষেরই লাভ। আর স্বস্তি নিত্যদিন যাদের ভুগতে হয় সেই সব গাড়িওয়ালা মধ্যবিত্তদের।

আপাতত কলকাতা এবং মুম্বাই। ধীরে ধীরে অন্য শহরেও ছড়িয়ে পড়বে ওর এই অ্যাপের মাহাত্ম। আর হবে নাই বা কেন। অভিষেককে যারা চেনেন তারা বলেন ওকে কখনও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় থামিয়ে রাখা যায় না। ও সবসময় অস্থির। সবসময় গোত্তা খাচ্ছেন পাহাড়ের চুড়োয় উঠবেন বলে। ভীষণ বেড়াতে ভালোবাসেন। নির্জন জঙ্গল ওকে টানে। সমুদ্রও। কিন্তু সব থেকে বেশি টানে প্রতিস্পর্ধী পাহাড়।

অভিষেক তরফদার সম্পর্কে ওর বন্ধুদের দাবি ও একজন আদ্যন্ত প্রেমিক মানুষ। কবিতা লেখেন। সময় পেলে, হাতে কাগজ আর কলম পেলে আঁকিবুঁকি করেন। অত্যন্ত বন্ধু বৎসল আর তুখোড় এক প্রতিভাময় ছেলে। দুর্দমনীয় আন্ত্রেপ্রেনিয়র। প্রায় গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অনেক লড়াই করেছেন। কখনও চড়েছেন সাফল্যের সপ্তম স্বর্গে। আবার মুখ থুবড়েও পড়েছেন। কিন্তু কখনও হেরে যাননি। ধুলো ঝেরে ওঠাই যদি উদ্যোগ নেওয়ার পূর্বশর্ত হয় তবে সেই শর্ত পালন করেছেন বারংবার।

রানাঘাটের মেধাবী দামাল ছেলেটা যখন প্রথম কলকাতায় এসেছিল সেটা ছিল প্রথম নেওয়া ঝুঁকি। শহরের মানুষ এবং অগুনতি অমানুষের এই শহরে ও তখন সবে চিনতে শিখছিলেন মানুষ। ঝাঁ চকচকে কলকাতার ভিতর আরেকটা যে ঘিঞ্জি অস্পষ্ট কলকাতা আছে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াই ছিল ওর জন্যে প্রথম সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। তারপর কনফিউশন অনেক। জেমস জয়েসের কাহিনির চরিত্রের মত অনেক মানুষের ভিড়ে নির্জন নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাও পেয়েছেন অভিষেক। শহরের আলোর তলায় হ্যাঁ বন্ধু - না বন্ধু। প্রেম-অপ্রেম। শঠতা, প্রতারণা। পাশাপাশি আবেগে আকুল কলকাতাকে বুঝে নিতে বছর দুয়েক সময় লেগে গেছে।

২০০৩ সালে কলকাতায় পড়তে আসেন। সল্টলেকের একটি নামি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে বিটেক পড়ছিলেন। প্রথম বছর দুয়েক নিজের সঙ্গেই নিজে লড়েছেন অনেক। যাকে বলে Struggle for existence বা খাপ খাইয়ে নেওয়ার লড়াই। টিকে থাকার সেই মহাসংগ্রামে যখন ফাইনালি জিতলেন তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। লড়াইয়ের দিন গুলোর কথা বলতে গিয়ে এক নিঃশ্বাসে গোটা বাক্যটা শেষ করতে চাইছিলেন স্পাইডি। বলছিলেন প্রথম দিকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়া চলাকালীন যে কাজ পেয়েছেন সেটাই করেছেন। কখনও ডেটা এন্ট্রির কাজ করেছেন। তো কখনও কোনও সংস্থার জন্যে ওয়েবসাইট বানিয়ে দিয়েছেন। কখনও ফ্রিল্যান্স করেছেন। হার্ডকোর ডেভেলপার অভিষেক এভাবেই প্রথম ব্রেকটা পেয়ে যান। বিদেশি একটি ক্লায়েন্ট। সফ্টঅয়্যার তৈরি করার প্রজেক্ট। ২০০৭ সালে সেই প্রজেক্টের সুবাদেই নিয়োগ করেন কর্মচারী। সংস্থার নাম রাখেন ওয়েবস্পাইডি টেকনোলজিস। প্রথমে জনা কুড়ি কোডার ডেভেলপার নিয়ে শুরু হয় কাজ। ধীরে ধীরে কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে কর্মী সংখ্যা। অঢেল কাজ ঢুকতে থাকে। তখন তরতর করে এগোচ্ছে অভিষেকের নৌকো। একটি চিনা সংস্থার জন্যে ভিডিও তৈরির কাজ পান। পাশাপাশি ডিজাইনিংয়ের একটি শাখাও পুরোদমে কাজ করতে থাকে। পিসি চন্দ্রের মত একের পর এক বড় ক্লায়েন্ট জুড়তে থাকে অভিষেকের সঙ্গে। কর্পোরেট ভিডিও তৈরি করা থেকে ইভেন্টের ফটোগ্রাফি, কিংবা কমার্শিয়াল অ্যাডরোল তৈরি করার পাশাপাশি শর্টফিল্ম তৈরির কাজ করতে থাকেন অভিষেক। সেই সুবাদে তৈরি হয় ওর দ্বিতীয় সংস্থা ব্ল্যাক সল্ট এন্টারটেইনমেন্ট। এরই ফাঁকে উঁকি দেয় নতুন সম্ভাবনা। নতুন বাজার। নতুন উৎসাহ। বাংলার তাঁতকে বিশ্বের বাজারে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ নিয়ে খুলে ফেলেন ইকমার্স সাইট। তাঁতঘর। জীবনে যাইই করেছেন অভিষেক সেটারই শীর্ষ ছোঁয়ার চেষ্টা করেছেন। সাফল্য এসেছে। প্রচারের আলো পেয়েছেন। আর পেয়েছেন পরিতৃপ্ত কাস্টমার। কিন্তু সমস্ত সৃজনেরই একটা উপসংহার থাকে। সেভাবেই সময়ের হাতে মিলিয়ে গিয়েছে তাঁতঘর। ২০১৫ সালে প্রথম হোঁচট খেয়েছেন তাঁতঘর নিয়ে। সে এক বিষাদ সিন্ধু। কিন্তু থেমে থাকেননি ছেলেটি। সেবছরই সিঙ্গাপুরের এক বন্ধুর সঙ্গে খুলে ফেলেছেন একটি অ্যালকোহল ডেলিভারির স্টার্টআপ। অনলাইনে অ্যালকোহল ডেলিভারি এদেশে মসৃণ নয়। তাই সিঙ্গাপুরেই রমরমিয়ে চলছে সেই ব্যবসা।

এই মিষ্টভাষী, দুষ্টু ছেলেটাই গোটা দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিদেশেও ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজের ব্যবসার শাখাপ্রশাখা। মানুষকে বিশ্বাস করতে গিয়ে বারবার ঠকেছেন। কিন্তু নিজের প্রতি বিশ্বাস হারাননি। আর তাই আজ অভিষেক তরফদার নিজেকে ভেঙেচুরে আবার নির্মাণ করে উঠে দাঁড়াতে পেরেছেন। সাফল্যের শীর্ষটা ছুঁয়ে দেখতে চাইছেন আবার। Park24X7 সেই চেষ্টার একটা ফসল।