দৃষ্টিহীন ললিতা স্বপ্ন দেখছেন, আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন?

দৃষ্টিহীন ললিতা স্বপ্ন দেখছেন, আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন?

Sunday March 06, 2016,

3 min Read

আলিপুরদুয়ারের হত দরিদ্র পরিবারের এই মেয়ে ললিতা পাল। দৃষ্টিহীন। এরকম পরিস্থিতি তো অগুণতি। তাহলে হঠাৎ ললিতা কেন শিরোনাম হবেন। ভাবছেন তো! আসলে ললিতা আর পাঁচটা প্রতিবন্ধি নন। তিনি প্রতিবন্ধকতাকে রীতিমত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগিয়ে গেছেন। এবং এই দৃষ্টিহীন মেয়েটিই আর পাঁচটা মানুষের কাছে অদম্য ইচ্ছের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন। বর্তমানে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে এমএ পড়ছেন তিনি। তবে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াটা তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় যত না চ্যালেঞ্জের তার থেকে আর্থিক কারণটা আরও বড় হার্ডেল। আর সেই বাধাটা আরও প্রলম্বিত করেছে তার আশপাশের মানুষজন। এমনকি তার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। মেধায় ক্ষুরধার ললিতা বলছিলেন, একজন দৃষ্টিহীন পড়ুয়া হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল তাঁকে বিশেষ কোনও সুযোগ-সুবিধে দেওয়া। সেজন্য তিনি আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু এখনও কারও ভ্রূক্ষেপ নেই। তাবলে থেমে থাকার পাত্রী নন আমাদের ললিতা। 

image


গ্রামের বাড়ি আলিপুরদুয়ারে। শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে থেকে এমএ পড়ছেন। হস্টেল খরচ বাবদ বছরে কয়েক হাজার টাকা গুনতে হয়। তাছাড়াও, আরও নানান অসুবিধা আছে। যেমন, উচ্চশিক্ষার জন্য যে সমস্ত বইপত্র দরকার সেগুলি ব্রেইলে পাওয়া যায় না।‌ এজন্য একজন শিক্ষক রাখতে হয়, যিনি সিলেবাসের বইগুলি পড়ে শোনান। এজন্য প্রতিমাসে প্রায় ১২০০ টাকা খরচ হয়। ললিতার কথায়, এসব কারণেই এমএ পড়াটা আমার ক্ষেত্রে এখন বেশ চাপের। 

বাবা গত হয়েছেন। ওঁরা পাঁচ ভাইবোন। চারবোনের ভিতর ললিতা ছোট। অন্য বোনেদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এক দাদা। তাঁরও সামান্য আয়। ললিতার বিধবা মা বললেন, কষ্ট হলেও ওঁর লেখাপড়াটা আমরা চালাতে চাইছি। ও নিজের পায়ে দাঁড়াক, এটাই চাই।

ছেলেবেলা থেকেই দৃষ্টিহীন। তবে লেখাপড়়ায় ভীষণ আগ্রহ। তা দেখে অভিভাবকরা ললিতাকে ভর্তি করেছিলেন আলিপুরদুয়ারের ব্লাইন্ড স্কুলে। সেখানে ক্লাশ এইট পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছেন। এরপর আরও পড়তে চেয়েছিলেন লেখাপড়ায় ভালো মেয়েটি। অভিভাবকরা ধারকর্জ করে টাকার সংস্থান করেন। ললিতাকে ভর্তি করা হয় হুগলি উত্তরপাড়ার লুই ব্রেল মেমোরিয়াল স্কুল ফর দ্য সাইটলেস স্কুলে।

এরপর মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিএ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করেন ললিতা। এমএ পড়ার শখ ছোটবেলা থেকেই। ভর্তি হন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

লেখাপড়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত আর একটি প্রতিভা আছে ওঁর। খুব ভালো গানের গলা। বলছিলেন, মাধ্যমিকে অতিরিক্ত বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন মিউজিক। পরে উচ্চ মাধ্যমিকে কম্পালসারি বিষয় হিসাবে মিউজিক নিয়েই লেখাপড়া করেছেন। 

একজন দৃষ্টিহীন মেয়ে হিসাবে লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত গড়েছেন ললিতা। ওঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, প্রতিবন্ধী মেয়ে হিসাবে কী কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে?

ললিতা বললেন, যে কোনও ধরনের প্রতিবন্ধী দুধরনের সমস্যায় ভোগেন। প্রথমত, সাধারণ মানুষজনের তুলনায় শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণেই দারুণ রকম হীনমন্যতায় ভোগেন। অন্যদিকে, আমাদের সমাজ প্রতিবন্ধীদের প্রতি সবক্ষেত্রে আজও সহমর্মী নয়। ফলে, প্রতিবন্ধী ছেলে বা মেয়েটি সামাজিকভাবে নানান অবহেলার শিকার হন। স্বভাবতই, তাঁর মন ভেঙে যায়।

ললিতা আরও বললেন, যে কোনও মানুষকে তাঁর নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন অফুরন্ত মনের জোর। কিন্তু জীবনের বিভিন্ন ধরনের অবহেলার শিকার হয়ে প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা বহুক্ষেত্রে তাঁদের মনের জোরটি হারিয়ে ফেলেন। ফলে, সারাটা জীবন পরমুখাপেক্ষী হয়েই জীবন কাটাতে হয় তাঁকে।

তবে নিজেকে নিয়ে ললিতা হ‌রেক রকম স্বপ্ন দেখেন। হাইস্কুলে টিচার হতে চান, স্কুল শিক্ষিকার চাকরি পেয়ে মা, ভাইবোনদের মুখে হাসি আর নিজের পায়ের তলায় জমি শক্ত করতে চান। আগামী দিনে ললিতা সমাজকে দেখাতে চান, মনের জোর আর সহযোগিতা থাকলে কোনও প্রতিবন্ধকতাই তোমাকে আটকাতে পারবে না!