‘দিলওয়ালে’ হওয়ার টোটকা শাহরুখের

‘দিলওয়ালে’ হওয়ার টোটকা শাহরুখের

Saturday December 12, 2015,

4 min Read

কর্পোরেট জগতের তাবড় তাবড় মানুষ নিষ্পলক চেয়েছিলেন তাঁর দিকে। বোর্ড মিটিংয়ে গম্ভীর মুখে স্ট্যাটিস্টিক্স আওড়ানো স্যুট-বুট পরা কর্পোরেটরা তখন কলেজ পড়ুয়ার মতো তাঁর রসবোধে মোহিত। সিট থেকে হেসে গড়িয়ে পড়ছিলেন। তিনি শাহরুখ খান। গল্পে-গানে-হাসি-ঠাট্টায় একাই আইআইএম ব্যাঙ্গালোরের লিডারশিপ সামিটের মঞ্চ মাতিয়ে রাখলেন।

image


বলিউড বাদশাকে স্বাগত জানান আইআইএম ব্যাঙ্গালোরের বোর্ড অব গভর্নরস-এর চেয়ারপার্সন কিরণ মজুমদার শ। এরপর গোটা মঞ্চের দখল নিয়ে নেন কিং খান। ফুটপাথ থেকে সিংহাসনে চরার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে।

  • নিজের চারপাশের জগতকে নিজের মতো করে বদলে ফেলার সহজাত ক্ষমতা থাকে একজন লিডারের মধ্যে। তাঁরা কখনও প্রশ্ন করতে ভয় পান না, ভয় পান না স্বপ্ন দেখতে। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কোনও পদক্ষেপ করতেও পিছপা হয় না। একজন সেলিব্রিটি হওয়ার সুবাদে আমার প্রতিটি কাজকেই আঁতস কাচের নীচে রেখে বিশ্লেষণ করা হয়। কিন্তু ‌যখনই নিজের দৃষ্টিভঙ্গী বোঝাতে ব্যর্থ হই, তখন মনে মনে গাই, “ হাম তো অ্যাক্টো করেগা, দুনিয়া সে নেহি ডরেগা... ”। তাই কাজ করে ‌যাওয়াটাই জরুরি।
  • শুধু স্বপ্ন দেখলেই হবে না। পুরানো, স্থবির রীতিনীতিকে ভেঙে নিজের এগিয়ে ‌চলার পথ মসৃণ করতে হবে। ব্যর্থতায় পিছিয়ে আসলে চলবে না। বরং ক্রিজে টিকে থেকে মোকাবিলা করতে হবে। আমি বিশ্বের অনেক সফল কর্পোরেটদের সংস্পর্শে এসেছি। নিজ নিজ ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত অথচ নিজের সম্পর্কে ‌যখন তাঁদের বলতে দেওয়া হয়, কথার মধ্যে সেই উষ্ণতা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ব্যবসায়ীরা শুধু অঙ্ক বোঝেন, আবেগের ধারপাশ মাড়ান না। টার্গেটে পৌঁছানোর লক্ষ্য তাঁদের যেন প্রাণহীন যন্ত্রে পরিণত করেছে। সৃজনশীলতা আমার মতে, ‘ম্যানেজেরিয়াল ’ নয় ‘ইম্যাজিনেরিয়াল ’ কনসেপ্ট।
  • নেতৃত্ব দেওয়ার অর্থ প্রেরণা জোগানো। স্ট্যাটিসটিক্স আর সংখ্যা দিয়ে শুধুমাত্র ব্যাঙ্কার আর স্টক ব্রোকারদেরই অনুপ্রাণিত করা যায়। কারণ প্রেরণার সঙ্গে আবেগের যোগ রয়েছে। কোনও ব্যক্তি বা পণ্যের প্রতি মানুষের আস্থা অর্জন করতে গেলে চিন্তাশক্তির জোর থাকতে হবে। ভাবনা আবদ্ধ থাকলে সৃজনশীলতা বাধা পায়।
image


  • আমি কোনওদিন নিজের লক্ষ্য স্থির করি না। বক্স অফিসে কয়েকশো কোটি টাকা আয়ের উদ্দেশ্যেও ঝাঁপাই না। কারণ এই ধরনের লক্ষ্য স্থির করার অর্থ নিজেকে বিভ্রান্ত করা। জীবনের সারসত্য হল কঠোর পরিশ্রম। পরিশ্রম ছাড়াই স্বপ্নের উড়ান গতি পাবে এটা ভাবার অর্থ মূর্খের স্বর্গে বাস করা। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের গুরুত্ব রয়েছে। নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য না ঝাঁপালে জীবন সাদামাটাই থেকে যাবে।
  • তবে এরজন্য বিপ‌র্যয়ের ঝাপটাও পোহাতে হয় লিডারদের। পরিজনকে হারাতেও হয়। আমাকেও হয়েছে। কিন্তু এমনটা হলে কী করবেন? হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদবেন ? আমি মাঝে মাঝে অবশ্য সেটাই করি। সুসজ্জিত বাথরুমের বাথ টাবে স্টিম বাথ নিতে নিতে হাঁপুশ নয়নে কেঁদে ভাসাই। কিন্তু ‌যখন আমার প্রিয় লিমিটেড এডিশন সুগন্ধিটি গায়ে মেখে স্নানঘর থেকে বেরিয়ে আসি, তখনই আমি অন্য মানুষ। সবরকম বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রস্তুত এক ব্যক্তিত্ব। কাজেই অল্পসল্প কান্নাকাটি খারাপ নয়। কিন্তু পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে তার মোকাবিলায় কোমর বেঁধে নামাই একজন লিডারের বৈশিষ্ট্য।
  • আমার মনে হয় ‘পারফেক্ট লাইফ’ বলে কিছু হয় না। ‘পারফেক্ট লাইফ’-এই বাক্যাংশের কোনও অস্তিত্বই নেই। আসলে অভিজ্ঞতার এবড়োখেবড়ো অধ্যায়ই আমাদের জীবনকে সুন্দর করে তোলে। সমস্যাই আমাদের ভালভাবে বাঁচতে শেখায়। তাই তাঁদের আলিঙ্গন করতে দোষ কোথায়? অবশ্য আমার পেশায় আমি কাজল, মাধুরি আর আলিয়াকেও জড়িয়ে ধরার সুযোগ পাই। আপনারা ‌যে যেই সংস্থাতেই যোগ দিন বা নিজের সংস্থাই খুলে ফেলুন না কেন, এমন সুযোগ পাবেন না (বলেই হেসে ওঠেন বাদশা, হাসির রোল ওঠে দর্শকাসনেও) ।
  • তবে ভাগ্যে কী আছে তা কেউ বলতে পারে না। এর আদর্শ উদাহরণ আমি। ছোটবেলা থেকে খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। পিঠে একবার চোট পাই। চিকিৎসা করানোর টাকা ছিল না। নিজের দুঃখ ভুলতে থিয়েটার গ্রুপে যোগ দিলাম। হঠাৎই বাবা মারা যান। ভাড়া বাড়ি থেকে উৎখাত করে দেওয়া হয় আমাদের। মা ছোট বাড়ির খোঁজ শুরু করেন। আমাদের প্রপারটি ডিলারের শ্বশুর তখন একটি টিভি ধারাবাহিক ‘ফৌজি’র কাজ করছিলেন। মা আমাকে ওঁনার কাছে পাঠালেন। জুটে গেল অভিমন্যু সিং চরিত্রটির কাজ। তারপরই জীবন অন্য মোড় নেয়। ঘটনাচক্রে ওই ডিলারের থেকে আর বাড়ি নেওয়া হয়নি আমাদের।
  • তবে আমাদের জীবনে ভাগ্যের কিছুটা ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। কীভাবে আমরা তার মোকাবিলা বা প্রতিরোধ করব, কেউ শিখিয়ে দিতে পারে না। ‌যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়েই তার প্রতিরোধে ঝাঁপাতে হয়, নাহলে জীবন সায়াহ্নে সময়ের ঢেউ আপনাকে ‌যখন পাড়ে আছড়ে ফেলবে তখন পিছনে তাকিয়ে ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবেন না।
  • জীবনের চড়াই-উতরাই আপনি তখনই উপভোগ করবেন ‌যখন দুচোখ খোলা রেখে সমস্ত চ্যালেঞ্জকে আহ্বান জানাবেন। ‘দিলওয়ালে’ না হলে জীবনের নানা অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করতে পারবেন না। মনই সৃজনশীলতার বীজ যা হৃদয়ের মাটিতে বেড়ে ওঠে। সেই বীজ প্রাণের স্পন্দন পাবে না ‌যতক্ষণ না খোলা মনে জীবনটা উপভোগের প্রতিজ্ঞা নেবেন। সৃজনশীলতায় ভর করে প্রকৃত সাফল্য পেতে গেলে ‘পজিটিভ ভাইবস’ খুব জরুরি। আর তা তখনই সম্ভব ‌যখন অন্যদের জন্য ভাল কিছু করার জিগির থাকবে আপনার মধ্যে। সেটাই ‌যে কোনও সৃজনশীল নেতার মূল ভিত্তি।

(লেখক দীপ্তি নায়ার, অনুবাদ শিল্পী চক্রবর্তী)