দমানো যাবে না কিছুতেই, বোঝালেন ওড়িশার ডলি
Sunday October 04, 2015,
5 min Read
ডলি গায়েন। বয়স তিরিশের কোঠা পেরোয়নি। তবু মুখায়বে বলিরেখার অসংখ্য গাঢ় এবরো থেবরো ভাঁজ। প্রতিদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি চেহারায় ছাপ রেখে যায়। ডলি আসলে সাধারণ এক জেলেনি। আলাদা করে দেখার মতো কোনও বৈশিষ্ট হয়তো নেই। তবু কেন ডলির কথা বলছি? কারণ, প্রতিযোগিতার জীবনচক্রে ডলির ভেসে থাকার কাহিনী অসাধারণ। আর দশজনের কাছ থেকে আলাদা করে রাখে ওডিশার উপকূলবর্তী গ্রামের এই বাসিন্দাকে। সেই গল্পই শোনাবো আপনাদের।
ওডিশার কেন্দ্রপাড়া জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম খাইমাসির বাসিন্দা বছর ছত্রিশের ডলি গায়েন। সেই কোন ছোট বেলায়, ১০ বছর বয়েস থেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করায় হাত পাকিয়ে ফেলেন। প্রায় দু যুগ এই ব্যবসা করেই কেটে গিয়েছে। কয়েক বছর ধরে মাছের ব্যবসায় এক নতুন ধারার আমদানি লক্ষ্য করেছেন ডলি। ‘তখন অনেক মাছ পেতাম, কিন্তু পয়সা তেমন পেতাম না। এখন মাছ তেমন পাই না, তবে অল্প মাছেও ভালোই টাকা পাওয়া যায়’,ডলির উপলব্ধি।
মাছ আর কাঁকড়া ধরা থেকে বাজারে বিক্রি, স্বনির্ভর ডলি এইসব কাজে কারও তোয়াক্কা করেন না। একার হাতেই সব সামলান। মাছ বিক্রি করতে হলে মাইলের পর মাইল হেঁটে উপকূল লাগোয়া গ্রাম থেকে অনেক দূরে বাজারে যেতে হয়। স্থানীয় হাট-বাজারে মাছ বেচে ক’টাকাই আর পাওয়া যায়। বোঝেন ডলিও। তাই শুধু স্থানীয় হাট-বাজারের ওপর নির্ভর করেন না। কখনও কখনও বড় বড় সংস্থা বা বৃহত্তর বাজারে মাছ বিক্রি করতে নিয়ে যান, যেখান থেকে ডলির মাছ রাজ্যের নানা জায়গা অথবা রাজ্যের বাইরেও চলে যায়। মাছের ব্যবসা ডলির এখন নখদর্পণে। তিনি জানেন, স্থানীয় বাজারে বিক্রির চাইতে এই সমস্ত বড় বড় সংস্থার কাছে মাছ বিক্রি করলে লাভের অংক বেশ ভালো। ডলি বোঝান, ‘মাছ বিক্রি করে যে টাকা হাতে আসে তার থেকে ভাগ দিতে হয় আরও অনেককে। মাছ গুছিয়ে দেওয়ার জন্য একজনকে টাকা দিতে হয়, আমার নিজেরও থাকবে...কোনও দিন ১০০ টাকা, কোনও দিন ২০০ টাকা। যেদিন যেমন ইনকাম, ওভাবে ঠিক বলা যায় না’।
ডলির জন্য ব্যবসা মানে প্রতিদিনের নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ, অনিশ্চয়তায় ভরা। ‘মাসে কত রোজগার হিসেব করে বলা কঠিন। খেয়ে দেয়ে কোনও মাসে হাতে কিছু নাও থাকতে পারে। মাছ কাঁকড়া খেয়ে এত কী বোঝার আছে? জমানোর মতো পয়সা আমার কই? পেট বাঁচাবো না পয়সা জমাবো’?, জমানোর কথা জিজ্ঞেস করতেই সোজাসাপটা উত্তর ডলির।
জেলেনি কটাই বা আর দেখা যায়। তার উপর সরকারি নীতি সংখ্যাটা আরও কমিয়ে দিয়েছে। মাছের ব্যবসায় খুব বড় দায়িত্ব দেওয়া হয় না মেয়েদের। কারণ এই ক্ষেত্রটা বড্ড বেশি পুরুষ নির্ভর। মাছ ধরার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক যুগ মাছের চাষ, মাছ ধরার ট্রলারের আধুনিকীকরণ এবং যান্ত্রিকীকরণে জোর দেওয়া হয়েছে। এইসব ক্ষেত্রে মহিলাদের অবদান স্পষ্ট নয়, এমনকী কদর পর্যন্ত পায় না। কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের প্রকাশিত হ্যান্ডবুক অব ফিশারিজ স্ট্যাটিকস, ২০১৪র হিসেব অনুযায়ী, ওডিশায় ৩৫,৩০৪ জন সম্পূর্ণ সময়ের জেলে রয়েছেন, যাদের মধ্যে ৭,৯৭৩ জন মাত্র জেলেনি।
দেবীকা সাহু, একজন লিঙ্গ বিশেষজ্ঞ, যিনি ওডিশার উপকূল এলাকায় মৎস্যজীবীদের নিয়ে কাজও করছেন। তাঁর মতে, সরকারের কাছ থেকে এই ব্যাপারে খুব একটা বেশি সাহায্য আশাও করা যায় না। তিনি জানান, ‘কেন্দ্রপাড়া খাইমাসি গ্রামে বেশিরভাগ মহিলাই মাছ অথবা কাঁকড়া ধরে থাকেন। শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর কিছু ঘটতেও পারে। একটা উদাহরণ দিই। কেন্দ্রপাড়ার যেকোনও গ্রামে যান, একটা জিনিস দেখতে পাবেন। গ্রামের প্রত্যেক মহিলার পায়ে বা হাতে কাটা ছেঁড়ার দাগ থাকবেই। কাঁকড়া ধরার জন্য উন্নত কোনও প্রযুক্তির ব্যবহার নেই, মাছ ধরার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ফলে গত ৩০ বছর ধরে একই রকম ভাবে মাছ ধরা চলছে। ধারায় কোনও পরিবর্তন আসেনি। কোনও সাহায্যও মৎস্যজীবীদের দেওয়া হয়নি’।
১৯৯৭ সালে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার ধামরা থেকে পারাদ্বীপ পর্যন্ত সমুদ্রতট থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত সুরক্ষিত ঘোষণা করে। গড়ে ওঠে গহিরমাতা অভয়ারণ্য। ফলে সেখানে মাছ ধরা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এদিকে, মৎজীবীরা মাছ ধরার যে নৌকা এবং জাল ব্যবহার করেন তা নিয়ে সমূদ্রতট থেকে ৫ থেকে ১০ কিলোমিটারের বেশি দূরে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, মাছধরার বোটগুলি হয় মাত্র ৫ থেকে ২০ হর্সপাওয়ারের। ফলে, সমূদ্র তীরবর্তী এলাকায় মাছ ধরা যতই কঠিন হয়ে উঠছে, পেট চালাতে বাড়ির মহিলারা বাধ্য হচ্ছেন বাড়ি ছেড়ে নদী বা খাঁড়িতে মাছ ধরতে যেতে। ডলি জানান, ‘সমুদ্রয় এই বছর মাছ কিছু নেই...লোকে যে কী খাবে জানি না। এক এক জন বোটের নোঙর ফেলে বসে আছে। এখন যখন জালে মাছ পড়বে, তখন সমুদ্রে যাওয়া বন্ধ। অভয়ারণ্যে তো যেতে দেবে না। এই সময় কী খাব আমরা? তখন যে পারবে দুটো খাবে, যে পাবে না অনাহারে মরবে...যদি এই সময় মাছ ধরতে যাই, ধরা পড়লে দেড় লাখ টাকা লাগবে বোট ছাড়াতে। এতো টাকা পাবো কোথায়? ডিএফও, রেঞ্জার জরিমানা করে দেবে। বোট, জেলে সবাইকে আটকে রাখবে। নিজে ছাড়া পাবে, নাকি বোট ছাড়াবে, নাকি সঙ্গের লোকজনদের ছাড়াবে? হিসেব করতে গেলে প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ। ২ লাখ টাকা কে দেবে? নিরুপায় মৎস্যজীবীরা বোট ঘাটে বেঁধে ফেলে রাখে...কিছু করার নেই’, বলেন ডলি।
রাজনৈতিক নেতানেত্রী ভোট ছাড়া যাদের না কি দেখা পর্যন্ত মেলে না, তাদের সম্পর্কেও বীতশ্রদ্ধ ডলিরা। রাজনৈতিক নেতাদের কথা বলতে গিয়ে ডলি বলেন, ‘নেতাদের কী দরকার? ওনারা আসবেন কথন? যখন ভোট আসে তখন ভোট চাইতে আসেন। এখন পাওয়া যায় না। মরে গেলেও কেউ দেখতে আসবেন না। আমার এত বড় সংসার। কাজের লোক একটাই। আমি মেয়েমানুষ, তবু খাটি বলে ঘরের আট, দশজনের মুখে খাবার তুলে দিতে পারি। আমাদের বিপিএল কার্ডও নেই। লক্ষ্মীর ঘড়া ভেঙে পেট চালিয়েছি। ওদের আর আমার চিনতে বাকী নেই’।
ডলির ব্যবসায় চ্যালেঞ্জ অনেক। সাগরের উথাল পাথাল ঢেউয়ের মতই অস্থির, অশান্ত। অনবরত ওঠাপড়া। অতীতের কথা ভেবে বা ভুল কী করেছেন তা কাটা ছেঁড়া করতে বসার পাত্রী নন ওডিশার এই জেলেনি। ডলি এবং ডলির মতো আরও অনেক মহিলা মৎস্যজীবী ব্যর্থতার তকমা বয়ে বেড়াতে চান না। বাধা সরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার রসদ জোগাড় করেন নিজেদের রোজকার জীবনযাত্রা থেকে। এদেরই হয়তো বলে- সাধারণ মহিলা, অসাধারণ উদ্যোক্তা।