ছোট্ট শহরে বড় স্বপ্নের বুনন

ছোট্ট শহরে বড় স্বপ্নের বুনন

Monday October 19, 2015,

5 min Read

“There has been no greater marketer than the loin cloth weaver who said, ‘Oh no, we are naked!” (তাঁতির থেকে বড় কারবারি আর কেউ নেই, যিনি বলেন, হায় ইশ্বর, আমরা নগ্ন!)। Small Town (স্মল টাউন)-এর ফেসবুক খুলতেই দেখা যাবে এই ক্যাপশন। তিন উদ্যোক্তার এই স্টার্টআপে ফেসবুকই ক্রেতা এবং পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করার একমাত্র মাধ্যম। ‘এই লাইনটা নেটে দেখতে পেয়েছিলাম। তখনই মনে হয়েছিল লাইনগুলির মধ্যে বিদ্রুপ মেশানো যুক্তি রয়েছে, ঠিক কেলভিন এবং হবসের মতো। তাই আমাদের ওয়ালে ওই লাইন ক’টা শেয়ার করি। সব সেক্টরের জন্য কথাগুলির মধ্যে নিহীত যুক্তি রয়েছে’, বলছিলেন নেহা প্রকাশ, হ্যন্ডলুম স্টার্টআপ Small Town এর তিন কাণ্ডারির একজন। ওই ক’টা লাইন তাঁদের স্টার্টআপের জন্যও অর্থবহ। কারণ ব্যবসা চালাতে সারা দেশের তাঁতি আর কারিগররাই ভরসা তিন তরুণ উদ্যোক্তার।

image


সম্পূর্ণ নিজেরদের পুঁজিতেই ব্যবসা করে Small Town। Small Town সম্পর্কে তিন প্রতিষ্ঠাতার নিজেদের ধারনা হল, ‘আইডিয়ার বহর, অফুরন্ত প্রকৃতিকে নকশায় তুলে আনা এবং কাপড়ে ষড়ঋতুর ছাপ। বিহার, বাংলা, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের তাঁতি এবং হস্তশিল্পের কারিগর আর আমরা-এই হল আমাদের গোটা টিম। আপনারাই বুঝতে পারবেন, তাঁতের বুনন, হস্তশিল্প, কাপড়, বাসসজ্জা, পেন্টিং, গ্রফিক্স, লোগো, স্মারক, নানা লেখা, আর্ট, অ্যাডভারটাইজিং সবেতেই আমরা খুশির ঝরণা ধারা বইয়ে দিই’। Small Town এর সংজ্ঞা দিতে বললে এককথায় বলতে হয়-ফ্যাশন ব্র্যান্ড। কিন্তু বাজারে চালু ফ্যাশনে তাঁদের অরুচি। কারণ সেগুলির মধ্যে এতটাই নান্দনিকতা আনার চেষ্টা রয়েছে যে মূল ধারাটাই হারিয়ে যায়। ‘কারও মতো হতে চাইতে গিয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়ে যাওয়ার প্রবণতা সত্যিই দুর্ভাগ্যের’, আরও একটি ফেসবুক পোস্টে লেখেন নেহা, যা আদতে তাঁদের ব্র্যান্ডেরই নির্যাস।

image


Small Town এর ছোট্ট টিম। তিন রাজ্যের তিন কর্মদ্যোগী, যারা স্বপ্ন আর বিশ্বাসকে তাড়া করতে গিয়ে উজ্জ্বল কেরিয়ারকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। যদিও সেই স্বপ্ন সম্পর্কে খুব অল্প জ্ঞানই পুঁজি ছিল। নেহা প্রকাশ এবং বিশ্বজিৎ দাস নামী বিজ্ঞাপন সংস্থা লিও বার্নেটের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ছিলেন। মনজিৎ সিং ছিলেন হেলপেজ ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর। ‘বিজনেস ক্লাসে ঘোরা, পদের লোভ- সব ত্যাগ করে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে লিও বার্নেটে ক্রয়েটিভ ডিরেক্টরের চাকরি ছেড়ে দিলাম’। নেহা আগেই জানিয়েছেন, টিমের কারওই টেক্টাইল, হ্যান্ডলুম, তাঁত এইসব নিয়ে ভালো জ্ঞান নেই। ‘শাড়ির জন্য এই ভালোবাসা এসেছে আসলে আমাদের মায়েদের ওই গোদরেজ আলমারি থেকে। কারুশিল্প সম্পর্কে জানতে আমরা তাঁতিদের গ্রামে প্রায় এক বছর বারবার গিয়েছি’, সেখানে থেকেছি। নেহা ব্যাখ্যা দেন। ‘আমরা তিনজনই একেবারে ক্রিয়েটিভ বলতে যা বোঝায়। কিন্তু এখন সব করছি’, বলেন নেহা।

image


‘কিন্তু’, নেহা বলে চলেন, ‘বিজ্ঞাপনের জগৎ থেকে আসার ফলে একটা বিষয় আমাদের মাথায় সবসময় ছিল, আমরা শুধু কাপড়ের ব্র্যান্ড হব না, একটা আদর্শ সংস্থা গড়ব। ধরুন, পুরনো পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এমন তাঁতি এবং কারিগরদের আবার ফিরিয়ে আনতে প্রবল দর কষাকষি চালিয়ে যাচ্ছি। গ্রামের প্রতি কিলোমিটার ছবি তোলার মতো, মনের কোণায় জায়গা করে রাখে। এই গ্রামগুলি পর্যটকরা ঘুরতে আসতে পারেন, তাঁদের জন্য হেরিটেজ ডেস্টিনেশন হয়ে উঠতে পারে এই গ্রামগুলি। তাহলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। কিন্তু শুধু ভালো ভালো হোটেল তৈরি হলেই হবে না। গ্রামগুলি ঘিরে আমাদের আরও অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। দেখি কবে পরিকল্পনাগুলি দিনের আলো দেখে’।

image


‘Small Town এর তিন উদ্যোক্তাই ছোট শহরের। তাই সংস্থার নামও Small Town। তারপর আমরা যখন আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত হ্যান্ডলুম শুরু করি সেগুলিও ছিল বাংলা, বিহার, মধ্যপ্রদেশের ছোট গ্রামে’, হেসে বলেন নেহা। দু বছরে Small Town শুধু উত্তোরণই দেখেছে। চারদিক থেকে প্রশংসাও কুড়িয়েছে। কিন্তু মাথা ঘুরে যায়নি। ব্যাবসার ধরনও পালটে যায়নি। নানা ই-কমার্স সংস্থার মতো Small Town কখনও ওয়েবসাইটে নিজেদের কাপড় তুলে ধরার চেষ্টা করেনি। বরং ফেসবুকেই নিজেদের আবদ্ধ রেখেছে। ‘আমরা স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করি। ট্রেন্ড বা ফ্যাশনের পেছনে ছুটি না। সমমনাদের সঙ্গে আলাপ করতে স্যোশাল নেটওয়র্কটাকে ব্যবহার করি। ব্যাস ওইটুকুই। ওটাই বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আমাদের খোলা জানালা’, বলেন নেহা। ‘ওয়েবসাইট না থাকার একটা সহজ কারণ হল সময়ের অভাব। আমাদের ছোট্ট দলের একজন এখনও চাকরি করেন। খুব সীমিত হাত। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজকরার ফলে আমাদের ডিজাইন আমরা নিজেরাই তৈরি করতে চাই, যেভাবে লোগে, পেপার ব্যাগ, আমাদের স্টাইলিং, ছবি তোলা এইসব করেছি। জয়পুর ডটকম বা তারপোলেস্টোর ডটকমের সঙ্গে আমরা এখনও জুড়ে যাইনি কারণ, আমরা গ্রাহকদের বোঝার চেষ্টা করছি, তাদের ফিডব্যাক নিচ্ছি এবং সরাসরি তাদের জানতে চাইছি। আমরা সবসময় সম্পর্কে বিশ্বাস করি। একই সঙ্গে অনলাইন অফলাইন সব ধরনের সুযোগ খোলা রাখতে চাইছি। আমাদের সব কাজের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যাবে ফেসবুক পেজে। টাইমলাইনে সবসময় পোস্ট করছি। এভাবেই এতদিন বিক্রি করে আসছি’, জানান নেহা।

image


ক্রেতা কেন্দ্রীক নয়, Small Town হল প্রতিষ্ঠাতা কেন্দ্রীক। তার মানে এই নয় গ্রাহকরা Small Town এর কাছে প্রথম গুরুত্ব নয়। বরং ফেসবুকে গ্রাহকদের রুচিবোধকে সম্মান জানিয়ে তাদের সঙ্গে নীবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

image


যে পথ তাঁরা বেছে নিয়েছেন মোটেও সহজ নয়। তাঁদের প্রথম কাজ, ৬০ হাজার টাকার বরাত তাঁতিরা ঠিক সময়ে শেষ করে উঠতে পারেনি। জমানো টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করা নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে এটা বিরাট ধাক্কা ছিল। তবু কারিগরদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নেওয়া হয়নি বা শাস্তিও দেওয়া হয়নি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম যাদের শুধু গালিগালাজ জুটেছে আর মালিক পক্ষ ব্যবহার করে গিয়েছে। ওই ঘটনা থেকে বিরাট শিক্ষা নিলেন নতুন উদ্যোক্তারা।‘ Small Town এ আমাদের তিন জনেরই ভাগ্য যেন বেশিই কঠিন ছিল। ভাগলপুরের তাঁতিরাও বেশ বেগ দিয়েছে। আমরা যে নকশা দিয়েছি সেগুলি নিয়ে ঠাট্টা করা থেকে শুরু করে তসরের সঙ্গে চিনা নাইলন মিশিয়ে দেওয়ার মতো কাজও করেছেন তাঁরা। এটা অবশ্যআমাদের একটা সাহায্য করেছে, খুব তাড়াতাড়ি সব শিখে গিয়েছিলাম আমরা। এখন বুঝতে পারি কেন তসরের দাম বাজারে মাঝে মাঝে বেশ কম হয়। একই কায়দায় তৈরি নকল মাহেশ্বরী বা চান্দেরির মতো শাড়িতেও বাজার ছেয়ে যায়। আমরা এমনও তাঁতি পেয়েছি যারা খুব ভালো বন্ধুও বটে’, বলে চলেন নেহা।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রত্যেক তাঁতিকে এক এক জন উদ্যোক্তা করে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েছে Small Town। পয়লা এপ্রিল থেকে শিক্ষাদীক্ষা হীন মহিলা তাঁতিদের কর্মশালার মাধ্যমে স্মার্ট ফোন ব্যবহার, তার মাধ্যমে ছবি তুলে আপলোড করে দেওয়া শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু প্রতীক এবং রঙের মাধ্যমে এই কাজটাকে আরও সহজ করে দিয়েছেন নেহারা। ‘নিজেদের পোস্টের মাধ্যমে গ্রামে বসেই সারা বিশ্বের গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে পারেন তাঁতিরা’, বলেন নেহা।

টিম মনে করে শুরুর দিকে সবচেয়ে কঠিন হল প্রতি মাসের রোজগার নিশ্চিত করা। ‘মনের শান্তি ধরে রাখার জন্য টাকা যে কতটা জরুরি এতদিন বুঝতে পারিনি। অনেক ধাক্কা খেয়েছি। তাঁতি থেকে সুতো এমনকী রং, ছাপা সব ক্ষেত্রে মার খেয়েছি। কোনও পরিকল্পনা, হিসেব কিছু যেন কাজ করছিল না’, মনে পড়ে নেহার।

তবুও শুরুয়াতির সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল, নেহা বলেন, ‘স্বাধীনতা’। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য নেহার উপদেশ, 'নিজে যা তাই হও। নিজের স্টার্টআপের জন্য নিজের থেকে ভালো ব্র্যান্ড পোজিশানিং আর কেউ বুঝবে না'।