বাঁচলেন গৌরী, বেঁচে গেল সিরোহিও

বাঁচলেন গৌরী, বেঁচে গেল সিরোহিও

Sunday September 06, 2015,

4 min Read

অভিধান ঘাঁটতে পারেন। খোঁজ করতে পারেন গুগল সার্চ ইঞ্জিনে। কিন্তু কেবিন সুইসাইডের মানে কোথ্থাও নেই। হয়তো ভাবছেন, শব্দকোষেই যা নেই, তার পিছনে ছুটে লাভ কী? এ তো সময়ের অপচয়। কিন্তু পাঠক, কেবলমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন যে কেবিন সুইসাইড কতটা ভয়ঙ্কর। শরীর না মরলেও,মন মরে যায় । তখন মানুষ যেন সুতোয় বাঁধা পুতুল। অদৃশ্য হাত যেমন নাচাবে, সে তেমন নাচে। কেবিন সুইসাইডের ফাঁদে পা দিয়েও যাঁরা বেরিয়ে আসতে পেরেছেন, তাঁদের একজন গৌরী আগরওয়াল। অনেকেই তাঁকে চেনেন সিরোহি গ্রামের গৌরী নামে।

কেবিন সুইসাইড যে কত ভয়ানক, গৌরী তা টের পান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কের কর্মজীবনে। ঝকঝকে কেবিনে চলমান বাতানুকূল যন্ত্রের দৌলতে বোঝাই যায় না যে বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নাকি কাঠফাটা রোদ? কমলালেবুর মিষ্টি শীত নাকি মন আনচান করা বসন্ত? কেবিন জমে ওঠা ফাইলের পাহাড় আর ঘড়ির টিকটিক শব্দ যেন বলতে থাকে, পিছিয়ে পড়ছে হে। একটু হাত চালিয়ে...।

জীবন ফিরে পেয়েছেন গৌরী

জীবন ফিরে পেয়েছেন গৌরী


কেবিন নামের আধুনিক খাঁচায় আটকে মনপাখি তবুও ডানা ঝাপটায়। গৌরীর চোখে ভেসে ওঠে ব্রিটেন ওয়ার উইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিতে পড়া অর্থনীতির কতসব থিওরি। উন্নয়নের মডেল। পেরুর ট্রাজিল্লোয় এনজিও-র হয়ে কাজ করতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল একদল মহিলার সঙ্গে। ওরা বস্তিবাসী। সিঙ্গল মাদার। সন্তানকে নিয়ে জীবনের লড়াই লড়তে হয় প্রতি মুহূর্তে। পিছিয়ে থাকা মানুষগুলোর জন্য কাজ করার বদলে কিনা কেবিনের খাঁচা। গৌরীর দমবন্ধ হয়ে যায়। মনে হয়, এ তো আত্মহত্যার সামিল। চাকরিতে টাকা রয়েছে, ফরেন ট্রিপ রয়েছে, কিন্তু মনে শান্তি নেই। মন যেন এগিয়ে চলেছে ভয়ঙ্কর খাদের কিনারায়।

ভবিষ্যতে কী লেখা রয়েছে জানা নেই। তবুও চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে গৌরী যেন মুক্তি পেলেন সুইসাইড‌ কেবিন থেকে। আইআইটি-র একদল ছাত্র সে সময় তৈরি করছিল এলান অ্যাডভেঞ্চার্স নামে এক সংস্থা। তাতে যোগ দিলেন গৌরী। নতুন পর্যটন স্থলের সন্ধানে ঘুরতে হত এক থেকে অন্য গ্রামে। তখন কেই বা বুঝেছিল যে সেই অভি়জ্ঞতাই একদিন হয়ে দাঁড়াবে গৌরী আগরওয়ালের জীবনে মূল্যবান সঞ্চয়।

সিরোহি। ফরিদাবাদ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে হরিয়ানার এক শান্ত, নিরিবিলি গ্রাম। রাজ‌নৈতিক নেতাদের তর্জন-গর্জন নেই। গ্রাম্য বিবাদও কেউ দেখেনি। গৌরী আগরওয়ালকে দেখে সিরোহির ছেলে শাওন প্রশ্ন করেছিল, ‘‘কাউকে খুঁজছেন?’’ সেই থেকে শুরু। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আত্মার সম্পর্কে সিরোহির সঙ্গে যুক্ত হলেন গৌরী। ২০১২ সালে দ্য ‘স্কিলড সামারিটান ফাউন্ডেশন’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে তিনি শাওনের পরিবারকে দত্তক নিলেন। এরপর সময় গড়াল। সিরোহির সঙ্গে যেন এক অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে পড়লেন গৌরী।


image


সিরোহির পরিচয় পাথর খাদানের জন্য। মহার্ঘ সব পাথর তুলে নেওয়ায় পরিত্যক্ত খনিতে বর্ষার জল জমে তৈরি হয়েছিল মনোরম হ্রদ। রক্ত আলোয় হ্রদ ভাসিয়ে পশ্চিমের সূর্য যখন তাতে ডুব দেয়, সে সময় তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকেন গৌরী। যেখানে এত সৌন্দর্য তাকে পর্যটন হিসাবে তুলে ধরা যায় না কেন? প্রশ্নটা ঘুরপাক খায়। একদিন ফেসবুকে সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে আমন্ত্রণ জানিয়ে গৌরী লিখলেন, ‘‘এসো, সিরোহি ঘুরে যাও। একদিনের থাকা-খাওয়া নিয়ে খরচ মাত্র ১৫০০টাকা।’’ এতেই মিলল সাফল্য। যারা একবার এসেছিলেন, তাঁরা আসতে লাগলেন বারবার। ইকো ট্যুরিজমের দৌলতে খুলতে থাকল সিরোহির উপার্জনের রাস্তা। কিন্তু গৌরী বোঝেন, যেটা হয়েছে তা অতি সামান্য। বড় কিছুর জন্য দরকার সামাজিক আন্দোলন। গৌরী যেন হয়ে উঠলেন সেই আন্দোলনের অনুঘটক। সূর্য ডুবলেই সিরোহিতে ঝুপ করে নামত অন্ধকার, বিদ্যুতের সমস্যায় নাজেহাল গোটা গ্রাম যেন সেধিয়ে যেত ঘরের মধ্যে। সৌর আলোয় সেই গ্রামকে অন্য চেহারায় তুলে আনতে ‘ইঞ্জিনিয়ার উইদাউট বর্ডার (ইন্ডিয়া)’ নামে সংস্থার সাহায্য নিল গৌরীর ‘স্কিলড সামারিটান।’ ঘরে ঘরে জ্বলে উঠল আলো। যাতে সৌর প্যানেল-সহ যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় সেজন্য সিরোহিতে পরিবার পিছু মাসে দিতে হয় ৭০ টাকা। কিন্তু সৌর আলো খুলে দিল উপার্জনের বিস্তৃত ক্ষেত্র।

গৌরীর দৃঢ় বিশ্বাস উন্নয়নের অস্ত্র একটাই – পাওয়ার অব পিপল। স্ব-নির্ভরতার লক্ষ্যে তাই মহিলাদের দিয়ে তিনি স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করলেন। তাতে খুব একটা সাফল্য মিলল না। শুরু হল গৃহশয্যা উপকরণ তৈরির কাজ। আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়লেন মহিলারা। গড়ে উঠল উপাৎদিত পণ্য বিক্রির জন্য মান্ডি বা বাজা‌র।

না, এখানেই শেষ নয়। সিরোহির মতো আরও বেশ কয়েকটা গ্রামকে স্বনির্ভর, আরও স্বচ্ছল গড়ে তোলার লক্ষ্যে গৌরী এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে। কত পরিকল্পনা। কত স্বপ্ন। সুইসাইড কেবিনের বন্ধ দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে আসতে পেরেছেন, তাঁকে আটকানোর সাধ্য কার। ঝকঝকে মুখ, ক্ষুরধার মেধার একঝাঁক ছেলেমেয়ে তাঁর সঙ্গী। গৌরী বলছেন – এগিয়ে আসুন। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যে তৃপ্তি মেলে, তা পাওয়া যায় না আর অন্য কোথাও।