গাড়ির মতো বাড়িও যদি চলতে পারত মন্দ হতো না। ধরুন হঠাৎ মনে হল আপনার সাধের দোতলা বাড়িটা একটু পেছানো গেলে সামনের বাগানটা আরেকটু বড় হয়। কিন্তু ভাবলে কী হবে, বাড়ির নীচে কি চাকা আছে যে ঠেলে সরিয়ে দেবেন খানিকটা। আর শুধু শখের বাগানের জন্য পুরনো ভেঙে নতুন করে একটু পিছিয়ে বাড়ি বানানোর ভাবনা বেশ বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। অগত্যা,যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। তাই বা হতে যাবে কেন? ভুলে যাবেন না হাইটেক যুগে আপনার বাস। প্রযুক্তির অসাধ্য নেই কিছু। তাই বাড়ির তলাতেও চাকা লাগে। প্রয়োজনে পছন্দমতো জায়গায় সরাতেও পারেন। কী? আবাক হচ্ছেন তো? এমনই এক অদ্ভুতুড়ে প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে হরিয়ানার এসসিএসবি ইঞ্জিনিয়িরিং ওয়ার্কস নামে এক ইমারতি সংস্থা।
ফুলিয়ার বেলঘড়িয়া ২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশের গ্রাম চাঁপাতলা। স্থানীয় পঞ্চায়েত ভবনের ঠিক পাশেই অমল শর্মার ৯০০ বর্গফুটের বসত বাড়ি। একসময় অমলবাবু কাপড়ের ব্যবসা করতেন। বছর কয়েক আগে সেই ব্যবসায় কয়েক লক্ষ টাকা লোকসানের পরে তিনি আর সে পথে হাঁটেননি। বাড়ির সামনেই টিনের চাল দেওয়া একফালি দোকানে বসে চা বিক্রি করেন । সবকিছু আগের মতো না চললেও খারাপ কিছু ছিল না। গোল বাধল জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজ শুরু হওয়ার পরে। বাড়ি-সহ প্রায় তিন শতক জমি অধিগ্রহণ করে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ক্ষতিপূরণের অঙ্ক শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে অমলবাবুর।
অমলবাবু বলেন, ‘ক্ষতিপূরণ বাবদ মোটে ১৬ লক্ষ টাকা পেয়েছি। ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারি এই বাজারে বাড়িটা করতেই ১৭ লক্ষ টাকা খরচ পড়বে। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। তারপরেই খবরের কাগজ পড়ে এই বাড়ি সরানোর ব্যাপারটা জানতে পারি’। এরপরেই তিনি যোগাযোগ করেন স্থানীয় এক ইমারতি সামগ্রীর এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনিই খোঁজখবর নিয়ে যোগাযোগ করিয়ে দেন হরিয়ানার ‘এসসিএসবি ইঞ্জিনিয়িরিং ওয়ার্কস’ নামে একটি সংস্থার সঙ্গে। অমলবাবু বলেন, ‘বাড়িটা যেখানে ছিল সেখান থেকে ৭০ ফুট পিছিয়ে নিতে পারলেই আর কোনও সমস্যা থাকবে না। নতুন করে বাড়ি তৈরির ঝক্কিও নেই। খরচও অনেক কম।এস সি এস বি ওয়ার্কশপের সঙ্গে কথা বলার পর রাজি হয়ে যান ওই সংস্থার কর্তারা’।
কিন্তু কী এই প্রযুক্তি? ওই ইমারতি সংস্থার কর্তা আর কে সিং জানান, ‘বাড়িঘর, দোকান সরাতে হলে বুলডোজারের আর প্রয়োজন নেই। আগের কাঠামোকে অক্ষত রেখেই নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেতে পারে’। নিজের চোখে না দেখলে গোটা ব্যাপারটা গল্প বলে মনে হতে পারে। আরকে সিং বোঝালেন, ‘গোটা প্রক্রিয়াটাই দাঁড়িয়ে নিখুঁত মাপজোকের ওপর। যে জায়গায় বাড়ি বা দোকান সরাতে হবে সেখানে আগে শক্তপোক্ত করে মজবুত ভিত গাঁথা হয়। পরে যে জায়গায় ঘরটি রয়েছে তার চারপাশে একেবারে নীচ পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে শেষ প্রান্তের ভিত বের করে গোটা বাড়ির নীচে ‘জগ’ লাগিয়ে কাঠামোকে নীচ থেকে ওপরে ওঠানো হয়। এবার লোহার পাত পেতে, তার ওপর বাড়িটি বসিয়ে চাকার সাহায্যে নির্দ্দিষ্ট জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়’। মূল প্রযুক্তি এটাই। আর এইভাবেই অমল শর্মার ৯০০ বর্গফুটের বাড়ি চার দিনে ৭০ ফুট সরিয়ে নতুন ভিতের ওপর বসিয়ে দিয়েছেন এস সি এস বি ওয়ার্কশপের ইঞ্জিনিয়াররা।
ওই সংস্থার তরফে অমলবাবুকে জানানো হয়, সমস্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করতে মোট সাড়ে তিন লক্ষ টাকা খরচ পড়বে। শেষতক রফা হয় তিন লক্ষ টাকায়। ওই সংস্থার এক কর্মীর কথায়, ‘এই কাজটি করতে আরও বেশি টাকা লাগে। কিন্তু প্রচারের কারণেই এত কমেও রাজি হয়েছি আমরা’। সংস্থার মালিক শিবচরণ সাইনির দাবি, বাড়ি সরানোর কাজ এ রাজ্যে এই প্রথম। এর আগে তাঁরা কলকাতা, শ্রীরামপুর, ব্যান্ডেল, চন্দননগর, খড়্গপুরে কাজ করেছেন। তবে সেগুলো ছিল হয় বাড়ি সোজা করা নাহলে ভিত থেকে বাড়ি তোলার কাজ। তবে অন্য রাজ্যে ওই সংস্থা আটটি বাড়ি সরিয়েছে। আর প্রায় তিন হাজার বাড়ি ভিত থেকে তুলে উঁচু করে দিয়েছে।
সংস্থার কর্তাদের দাবি, এই প্রযুক্তি হিট করলে একসঙ্গে অনেক সমস্যা মিটে যাবে। কোথাও বাড়ি বা দোকান ভাঙা পড়লে সরকারের পুনর্বাসনের খরচ যেমন কমবে, তেমনি গৃহস্থের বাস্তুহারা হওয়ার টেনশানও থাকবে না। আর ফুলিয়ার অমলবাবুর তো এখন সোনায় সোহাগা। সরকারের তরফে নতুন বাড়ির জন্য হাতে পেয়েছিলেন ১৬ লক্ষ টাকা। বাড়ি সরাতে খরচ হল ৩ লক্ষ টাকা। খানিকটা মেরামতি, টুকটাক অন্য কাজে খরচ আরও ২ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ হাতে নিট ১১ লক্ষ টাকা! সাপ মরল অথচ লাঠি ইনট্যাক্ট! নেপথ্যে ‘এসসিএসবি ইঞ্জিনিয়িরিং ওয়ার্কস এর ‘ম্যাজিক’ প্রযুক্তি!