অনাথ ভবঘুরে শিশুদের আলোর পথের দিশারি 'ম্যাড'

অনাথ ভবঘুরে শিশুদের আলোর পথের দিশারি 'ম্যাড'

Tuesday December 29, 2015,

5 min Read

২০০৫ সালের কথা। দুই সদ্য যুবক নামী কলেজে পড়ার সুযোগ পান। সেই আনন্দ ভাগ করে নিতে ছুটে যান কোচির এক হোমে, যেখানে গরিব, অনাথ শিশুদের আশ্রয় দেওয়া হয়। শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে YMCA পুওর চিলড্রেন্স হোমের বাচ্চগুলিকে সেদিন মিষ্টি খাওয়ান জিতিন নেদুমালা এবং সুজিথ ভারকে। সদ্য কলেজে পা রাখা দুই যুবক তখন টেরও পাননি কত লম্বা পথের ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেটাই ছিল সারা দেশের অনাথ ভবঘুরে শিশুদের আলোর পথে সামিল করার আকাশ ছোঁয়া প্রয়াসের শুরু।

image


সেদিন হোম থেকে ফিরে আসার আগে জিতিন এবং সুজিথ বাচ্চাগুলির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তারা আর কী চায়। ভেবেছেন আরও মিষ্টি চাইবে, আইসক্রিম চাইবে। কিন্তু না। দুজনকেই অবাক করে দিয়ে বাচ্চাগুলির চাহিদা ছিল বই। দুই বন্ধু প্রতিশ্রুতি দেন, বই নিয়ে ফিরে আসবেন। প্রতিশ্রুতি রেখে কিছু দিনের মধ্যে বই নিয়ে হাজির হন জিতিনরা। বই পেয়ে বাচ্চাগুলি কী করল সেটা জানতে আরও একদিন যান হোমে। এবারও অবাক হওয়ার পালা। বাচ্চারা শুধু বইগুলি পড়েইনি, কী পড়ল, জানল, তার একটা রিপোর্টও তৈরি করে রেখেছিল। দুই যুবকের হোমে যাতায়াত আরও বাড়ল। যত দিন এগোল, দুজনের মনে একটা ধারনা তৈরি হল। বুঝলেন, সব মানুষ সমান। শিক্ষায় সবার সমান অধিকার আদায় করতে জিতেন নিজের আরও ২০জন বন্ধুকে জুটিয়ে ফেলেন। ২০০৬ এর মে-তে গড়ে ওঠে মেক অ্যা ডিফারেন্স, সংক্ষেপে ম্যাড।

image


ম্যাড এখন ৭৭টি হোমে ৪,২৫০ জন শিশুর দেখভাল করে। আর এই কাজ করেন ৪,৩০০ স্বেচ্ছাসেবী। ‘ম্যাড এমন একটি সংস্থা যেখানে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ যুবকেরা সমাজে প্রভাব ফেলতে নিজেদের সময় এবং শ্রম কাজে লাগায়। ম্যাড যত এগোতে থাকে, আমাদের নেতার প্রয়োজন পড়ে, যারা বোঝাতে পারবে আমাদের কী উদ্দেশ্য, কী কাজ, সমাজে তার কী প্রভাব। যুবসমাজের মধ্যে এই গুনগুলি আমরা দেখতে পেয়েছিলাম’,বলেন জিতিন। এই স্বেচ্ছাসেবকরাই ম্যাডের নানা কর্মসূচির মাধ্যমে অনাথ শিশুদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ চালান। কী এই কর্মসূচি?

ইডি সাপোর্ট- স্কুলের পর মাধ্যমিক এবং মিডল স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাহায্য করা।

ডিসকভার- জীবনশৈলী শেখানো এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যাঙ্কের লেনদেন শেখানো। মাঝে মাঝে বিশেষজ্ঞদেরও নিয়ে আসা হয়।

প্রপেল- হাইস্কুল স্তরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য কেরিয়ার ভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা,সঙ্গে থাকবেন একজন মেন্টর।

কমিউনিটি ফান্ডরেইজিং অ্যান্ড কর্পোরেট রিলেশন-যারা ম্যাডের জন্য আর্থিক সাহায্য করে তাদের সবার জন্য।

আরও সাপোর্ট রয়েছে, যেমন, জনসংযোগ, হিউম্যান ক্যাপিটাল, ফিন্যান্স, যার মাধ্যমে বোঝা যায়,সবাই ম্যাড সম্পর্কে জানেন এবং সংস্থার মধ্যে সবকিছু নিরবিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত হয়। এই কর্মসূচিগুলির বিস্তারিত পাওয়া যাবে makeadiff.in এ।

২০০৬ এ যে বীজ বোনা হয়েছিল সেই গাছ ফল দিতে শুরু করল ২০১২য়। জোবিশ ম্যাথিউ ইউএস কমিউনিটি কলেজ ইনিশিয়েটিভ প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হয়। জোবিশ ছিল ম্যাডের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। জিতিন এবং অন্যান্য ম্যাড স্বেচ্ছাসেবীরা জোবিশের ইংরেজি এবং কঠিন শব্দ পড়ার দক্ষতা বাড়ানোর পেছনে প্রচুর খেটেছিলেন। মেধাবী জোবিশ শিক্ষক এবং হোমের সবাইকে গর্বিত করে অ্যাডমিশনের তিনিটি ধাপ- TOEIC ইভালুয়েশন, স্টেটমেন্ট অব পারপাস এবং পিআই একে একে পেরিয়ে যায়। জোবিশের মতোই ভেলোরের পাস্তর হোমের একটি মেয়ে নন্দিনী আর, ম্যাডের আরেক সাফল্য। ম্যাডের প্রপেল প্রোগ্রামের অধীন হাইস্কুলের ছেলেমেয়েদের কেরিয়ার স্পেসেফিক কোচিং দেওয়া হয়। নন্দিনীর মেন্টর ছিলেন ভেলর ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির এক ছাত্রী। তাকে দেখে নন্দিনী নিজেও ভিআইটিতে পড়ার জন্য উৎসাহিত হয়। গরিব কৃষক পরিবারের মেয়ে নন্দিনীর স্বপ্ন বাস্তব করা সহজ ছিল না। এক্ষেত্রে অবশ্য নন্দিনীর মেন্টর বিরাট ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি VIT এর ভিসির সঙ্গে দেখা করে নন্দিনীর ইচ্ছের কথা জানান। সামন্য কৃষক পরিবারের ওই মেয়ের এমন অধ্যবসায় এবং বন্ধুদের সাহায্যের কাহিনিতে আভিভূত VIT অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নন্দিনীকে স্কলারশিপ নিয়ে সেখানে পড়ার যে পরীক্ষা তাতে বসার অনুমতি দেয়। টেস্টের জন্য পদার্থবিদ্যা, রসায়ন এবং গণিত নিয়ে প্রচুর খাটতে হয় নন্দিনী এবং তার মেন্টরকে। টেস্ট উতরানোর পর ইন্টারভিউতে ডাক পড়ে। নিজের রোলমডেলের মতো আজ নন্দিনীও একই প্রতিষ্ঠানে সম্পূর্ণ স্কলারশিপ নিয়ে তথ্য-প্রযুক্তিতে ইন্টিগ্রেটেড মাস্টার্স পড়ছেন।

ফি বছর বাচ্চাদের ড্রিমক্যাম্পে নিয়ে যায় ম্যাড। ৩দিনের ক্যাম্পে ম্যাড জীবনশৈলীর প্রশিক্ষণ দেয়। এই ক্যাম্পগুলি শিশুদের মধ্যে থেকে সেরাটা রেব করে আনে। এমনই এক মজার অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে হায়দরাবাদে ম্যাডেরই এক স্বেচ্ছাসেবী মানবের। ‘আমার সঙ্গে সবসময় একটা কিউব থাকে। সেবার ড্রিমক্যাম্পেও ছিল। ক্যাম্পে বাচ্চাগুলির চোখ পড়ে সেটারই দিকে। কিন্তু অরুণের আগ্রহটা একটু বেশিই ছিল। ওই দুদিন আমি যেখানে গিয়েছি অরুণ আমাকে চোখে চোখে রেখে দিয়েছে। কোনও একটা কারণে অরুণের হাতে কিউব না দিয়ে মুখে মুখে অংকের সমাধান শিখিয়ে দিয়েছিলাম। পরের দিন কিউব ছাড়াই সে অংক ঠিক করে দিয়েছিল। অবশেষে ওই রাতে আমি অরুণের হাতে কিউবটি দিই। সারা রাত ধরে ওইটি নিয়ে লেগেছিল সে। একসময় হাতে কিউব নিয়ে হাসি মুখে এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। বুঝতে পারলাম জয়ের হাসি হাসছে অরুণ। গত ফেব্রুয়ারিতে অরুণকে যেখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে সেই হোমে যাই। অরুণ তখনও কিছু প্যাঁচানো অংকের সমাধান করছিল। অবাক হয়ে দেখলাম এই বিস্ময় বালক জটিল সব অংকের সমাধান করছিল। এক একটা অংক সমাধানে এমন সব উপায় দেখাচ্ছিল, আমি সত্যি কখনও দেখিনি। তখনই বুঝলাম অরুণকে আটকানো যাবে না’।

প্রতি বছর ২৩টি শহরে এমন অগুনতি জোবিশ, অরুণ, নন্দিনীরা হল কয়েকটা উদাহরণ মাত্র। স্কুলছুট, আশ্রয় পাওয়া এই শিশুগুলিই বড় হয়ে দেশ-বিদেশের নামী কলেজে পড়াশোনা করছে। জেডব্লিউ ম্যারিয়ট থেকে ইন্ডিয়ান আর্মিতে কাজ করছেন। আর এভাবে হোমে আশ্রয় পাওয়া হাজারো শিশুর জীবন বদলে দেয় ম্যাড।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ম্যাডের ঝুলিতে পুরস্কারের অন্ত নেই। অশোকা স্টেপেলস ইয়ুথ সোশ্যাল এন্টারপ্রেনার কম্পিটিশন ২০০৮, আইকঙ্গোর করমবীর পুরস্কার ২০০৯, কর্ডসফেলো অ্যাওয়ার্ড ২০১০, ওয়ালর্ড ইয়ুথ সামিট অ্যাওয়ার্ড ২০১১ আরও কত কী। ভারতের ম্যাডের বিশ্ব পরিচিতিও কম নয়। মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা ২০১০ সালে ভারতে এসে যেকটা সংস্থা ঘুরেছেন তার মধ্যে অন্যতম ম্যাড। মেক অ্যা ডিফারেন্স কমনওয়েলথ দেশগুলির থেকে বেছে নেওয়া চারটি সংস্থার একটি যেখানে রয়্যাল গুগুল + হ্যাঙআউট এর মাধ্যমে কুইনস ইয়ং লিডারস ট্রাস্ট লঞ্চ হয়েছে। সম্প্রতি হান্ড্রেড গ্রেট প্লেসেস টু ওয়ার্ক-এর তালিকায় ৮৯তম স্থান পেয়েছে। আর এইসবই প্রমাণ করে সমাজে ম্যাডের স্থান কোথায়।