স্টার্টআপদের জন্যে অক্লান্ত অফিসার রত্না প্রভা

স্টার্টআপদের জন্যে অক্লান্ত অফিসার রত্না প্রভা

Wednesday January 27, 2016,

5 min Read

আন্ত্রেপ্রেনিওর হিসাবে কাজ করতে গিয়ে প্রায় সারাদিন ব্যস্ত থাকার অভিজ্ঞতা হয়তো আমাদের সবারই আছে। কিন্তু একজন সরকারী কর্মচারী চব্বিশ ঘণ্টা কাজে ব্যস্ত। এটা দেখার অভ্যেস এখনও তৈরি হয়নি। তাই এটা ভাবতেই আমাদের খুব অবাক লাগছে। কিন্তু এরকম নিদর্শনই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন একজন মহিলা আই.এ.এস অফিসার, যিনি শুধুমাত্র সরকারি কাজের দশটা পাঁচটায় নিজেকে আটকে না রেখে এগিয়ে এসেছেন কর্ণাটকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের রূপকার হিসাবে। ‘ইনভেস্ট কর্ণাটক’ মিশনকে সঠিক রূপ দিতে তিনি দিবারাত্রি পরিশ্রম করে চলেছেন। সত্যিকারের অনুপ্রেরণা এবং কাজপাগল এক সরকারি কর্মচারী আই.এ.এস রত্না প্রভা। অ্যাডিশনাল চিফ সেক্রেটারি (কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি), গভর্নমেন্ট অফ কর্ণাটক। ইয়োর স্টোরির সাথে কথা বলার সময় তাঁর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা, পেশাগত সাফল্য এবং তার নিজের জীবনের অনুপ্রেরণার কথা আমাদের সাথে শেয়ার করলেন। আজ শুনব তাঁর কথা।

image


আসলে ছোটবেলা থেকেই যে কোনও ব্যাপারেই উদ্যোম দেখাতে কার্পণ্য করতেন না। পেশাগত ভাবে আই.এ.এস হওয়ার পর এই উদ্যম বেড়েছে জ্যামিতিক প্রগতিতে। এই মনোভাবটাই তাকে সরকারি কাজ হোক বা কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান নিজেকে বেশ অন্যরকমভাবে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। আসলে কাজের প্রতি একটা ভালবাসা আর আবেগ আছে তাঁর। আর তাই এই ৩৫ বছরের চাকরি জীবনে তিনি যেখানেই কাজ করেছেন, মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে। কারণ তিনি সবসময়ই মানুষের জন্য অন্যরকমভাবে কিছু করার চেষ্টা করেছেন। আর এই করার পেছনে তাঁর আবেগই তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। তিনি বলছিলেন যে ১৯৯৫-৯৬ সালে এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের ডেভেলপমেন্ট কমিশনার হিসাবে কাজ করতেন। এই সময়ই প্রথম ইন্ডাস্ট্রির সাথে পরিচয় হয় তাঁর। এর আগে তিনি যেখানেই ডি.সি হিসাবে কাজ করেছেন সব জায়গাতেই প্রায় রুরাল ডেভেলপমেন্ট আর বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়ে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে। যখন তিনি এই এক্সপোর্ট জোনের সাথে কাজ করতে শুরু করলেন বুঝতে পারলেন যে এই জোনকে আরও ভালো করে সমৃদ্ধ করতে না পারলে, কর্ণাটকে কাজের পরিধি বাড়ানো যাবেনা। আসলে তিনি যে কাজই করেন তাঁর সাথে একটা অন্যরকম আবেগ জড়িয়ে পড়ে। শিল্প সম্পর্কে সেরকম কোন গভীর জ্ঞান না থাকার জন্য প্রথমে বিভিন্ন শিল্পপতিদের সাথে আলাপ জমাতে থাকেন, জানার চেষ্টা করতে থাকেন যে তাঁরা সরকারের থেকে কী আশা করেন বা একটা সঠিক শিল্পকেন্দ্র তৈরি করতে গেলে আসলে কী কী করা দরকার।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া অ্যাক্ট অনুযায়ী শিল্পের জন্য জমি বণ্টনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যাতে সেইসব জমির মালিকরা চাকরি পায় নিজেদের জমির বিনিময়ে কিন্তু প্রথমদিকে এই বিষয়টাকে সেভাবে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য জমি বণ্টনের ক্ষেত্রে অনেকরকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতো। তিনি বলছিলেন যে ‘এই অসুবিধার কথা মাথায় রেখেই আমরা নতুন নিয়ম চালু করি যে প্রত্যেক জমি দাতার পরিবার থেকে একজন করে চাকরি পাবেন এবং চাহিদা অনুযায়ী তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও হবে। স্থানীয় মানুষকে কাজে লাগানোর বিষয়ে আমরা শিল্পপতিদের সাথে আলোচনা করি। কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি হিসাবে অনেক সংস্থাই বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আয়োজন করে। আর আমরা এটাকেই স্থানীয় চাহিদার সাথে যোগ করে দিতে চাই। যাতে এইসব ইন্ডাস্ট্রি স্থানীয় মানুষকে তাদের কর্মী হিসাবে ব্যবহার করতে পারে, এতে যেমন সংস্থার সুবিধা হয় সেরকম এলাকা ভিত্তিক কর্মসংস্থানও সম্ভব হয়।

কর্ণাটক সরকারের শিল্পনীতি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে বেঙ্গালুরুর বাইরেও শিল্পকেন্দ্র তৈরি করা যায়। শহর থেকে যত দূরে যে নিজের শিল্প তৈরি করবে সে ততো বেশি সুবিধা সরকারের থেকে পাবে। এতে অনুন্নত এলাকাতেও শিল্পের ছোঁয়া আনাটা সম্ভব। হায়দরাবাদ – কর্ণাটক জোনের জন্য সুবিধা সব থেকে বেশি। এরপর ক্রমান্বয়ে আসে বম্বে – কর্ণাটক এলাকা, তারপর মাইসোর – ম্যাঙ্গালোর এলাকা। যদিও বেঙ্গালুরুর প্রতি শিল্পপতিদের যে ভালবাসা আছে সেটা নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই তবুও আমরা চেষ্টা করছি আশেপাশের জায়গাগুলোতে এরোস্পেস, তথ্য প্রযুক্তি বা ইলেকট্রনিকসের মতো শিল্পকে ভালভাবে জায়গা করে দিতে।

পরিকাঠামো ব্যবস্থা একটা বড় সমস্যা এখানে, তাই এই বিষয়টা নিয়ে উচ্চপর্যায়ে আলোচনার দরকার। আমাদের বলছিলেন, যখন তিনি দায়িত্ব নেন তখন কর্ণাটক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশের মধ্যে সপ্তম বা অষ্টম স্থানে ছিল। আর এখন গুজরাটের পরেই কর্ণাটক। দ্বিতীয় স্থানে। মহিলাদের উন্নতির জন্যও ভাবনা চিন্তা করছে সরকার যাতে তাদের জন্য আলাদা করে কিছু করা যায়। মহিলা আন্ত্রেপ্রেনিওরদের জন্য বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে – শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য একটা আলাদা পার্ক তৈরির কাজ চলছে। তিনি বলছিলেন ‘আমরা এমন একটা নীতি তৈরি করেছি যাতে যেকোনো পার্কে মহিলা আন্ত্রেপ্রেনিওরদের জন্য ৫% করে জায়গা এবং সুযোগ বরাদ্দ থাকবে। আসলে মহিলাদের জন্য সেরকম কোন আলাদা ব্যবস্থা আগে ছিল না। বরং তাদের শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সাথে এক কোটায় রাখা হতো। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে এবং আমরা মহিলা ব্যবসায়ীদের আরও বেশি করে সমাজের অঙ্গ হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি’। বেঙ্গালুরু আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টেও একটা বড় সুযোগ তৈরি হবে। ডিফেন্স এবং এরোস্পেসের নতুন উচ্চ-প্রযুক্তি সম্পন্ন হাব তৈরি হচ্ছে এখানে। কর্ণাটক সবসময়ই এরোস্পেসে প্রথম স্থানেই ছিল আর সেই জায়গাটাকে ধরে রাখাই তাদের মুল লক্ষ্য। এর সাথে সাথে ডিফেন্সেও যাতে রাজ্যের উন্নতি হয় সেদিকেই বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে।

এরপর আমাদের স্টার্টআপ নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে বেশ হাসতে হাসতে বললেন ‘শুরুয়াতি ব্যবসায় আমরা সবসময়ই প্রথম স্থানে। এই বিষয়ে মাননীয় মন্ত্রীর মত অনুযায়ী শুধু তথ্য প্রযুক্তির স্টার্টআপ নয়, সাথে সাথে নির্মাণ শিল্পেও স্টার্টআপের প্রয়োজনীয়তা আছে এবং সেদিকেও আমরা এখন সঠিকভাবে নজর দিচ্ছি।

ইয়োর স্টোরির সাথে আলাপ করতে করতে নিজের জীবনের কথা বলতেও ভুলে যাননি এই দুঁদে দক্ষ আই.এ.এস অফিসার। জানিয়েছেন যে ওঁর বাবা ছিলেন একজন সিভিল সারভেন্ট আর মা ছিলেন ডক্টর। বড় ভাই একজন প্লাস্টিক সার্জেন। পরের ভাইও একজন সিভিল সারভেন্ট। আসলে ছোটবেলা থেকেই বাবা-মার থেকে দেখেছেন কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা কাকে বলে। আর সেটাই ভাই বোনরা মেনে চলার চেষ্টা করেন। বলছিলেন যে ‘এখন আমার মাথায় সবসময়ই কাজ আর কাজ। যখন আমি গাড়িতে করে অফিস যাই বা কোথাও ঘুরতে যাই তখনও আমার মাথায় শুধু কাজের চিন্তাই ঘোরাফেরা করে। আমার বাবা মা আমাকে একটা অনুপ্রেরণা দিয়েছেন – মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করা, আর আমিও যখন কোন মানুষের জন্য কিছু করতে পারি খুব খুশি হই এবং আনন্দ পাই'।

আর সবথেকে আনন্দের বিষয় হল যেখানেই কাজ করেছেন রত্না প্রভা সেখানেই একটা ছাপ ফেলতে পেরেছেন তিনি। সবজায়গার মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে। আবেগে ভরা গলায় বলছিলেন ‘৩২ বছর আগে আমার প্রথম পোস্টিং হয়েছিল বিদারে, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হিসাবে কিন্তু আজও সেখানকার মানুষ আমাকে মনে রেখেছে। একদিন সকালে রুটিন চেকআপের জন্য রক্ত নেওয়ার সময় একটা ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার নাম কি? যখন আমি নিজের নাম বললাম তখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করল যে আমি বিদারে কখনো কাজের সূত্রে ছিলাম কিনা। আমি যখন সম্মতি জানালাম তখন সে বলল যে তার বাবা মা সবসময় তাঁকে ছোটবেলা থেকে রত্না প্রভার নাম শোনাত। আর সেই মানুষের রক্ত নিতে এসে ছেলে এতোটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে ঠিক করে রক্তের স্যাম্পলটাই সংগ্রহ করতে পারেনি সে’।

( লেখা - শ্রদ্ধা শর্মা, অনুবাদ - নভজিত গাঙ্গুলী )