ভারত দাঁড়াক নিজের পায়ে, চান DITO-র ডাচ সাহেব

ভারত দাঁড়াক নিজের পায়ে, চান DITO-র ডাচ সাহেব

Monday June 13, 2016,

4 min Read

কলকাতার একটুকরো হৃদয় পড়ে আছে প্যারিসে। দমিনিক ল্যাপিয়রের কাছে। আরেক টুকরো বুঝলাম হল্যান্ডেও আছে। মিস্টার জ্যান্ডার ভান মিরউইজ্‌কের কাছে।

কিছুদিন আগে কলকাতায় এসেছিলেন এই ডাচ সাহেব। হাওড়ার বাউরিয়ায় একটি চলমান স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাজ সরেজমিনে দেখতে এসেছিলেন। তাঁর সংস্থা ডিটো ফাউন্ডেশনের অর্থে এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি চালাচ্ছে হাওড়ারই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। হাওড়ার প্রত্যন্ত যে সব জায়গায় হাসপাতালে পৌঁছনো এবং সাধারণ চিকিৎসা পাওয়া এখনও দুরূহ, সেই সব জায়গাতেই নিয়মিত যাবে বিশালাকার এই মেডিকেল ভ্যান। এতে থাকবে চিকিৎসক এবং নার্সের একটি টিম। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই ভ্যানে চিকিৎসা তো হবেই প্রয়োজনে পরীক্ষারও ব্যবস্থা থাকবে। একদম বিনে পয়সার খয়রাতি চিকিৎসা নয়। সামান্য ব্যয়ে সেবামূলক চিকিৎসাই দিতে চান জ্যান্ডার।

কথায় কথায় খিল খিল করে হাসেন এই সত্তর ছোঁয়া তরুণ। কথা বলেন দৃঢ়তার সঙ্গে। বলছিলেন শুধু এখানেই থেমে থাকছেন না তিনি। ভারতে রয়েছে তাঁর আরও অনেক পরিকল্পনা। তাই রীতিমত ভারতে দল গড়েছেন। ডিটো ইন্ডিয়া। তিনজন ডিরেক্টরের তিনজনই বাঙালি। সাহানা ভৌমিক, সৌম্যজিত গুহ এবং ঊস্রি রায়।

দরিদ্র মেধাবী মেয়েদের পড়াশুনোর জন্যে বিশেষ প্রকল্প নিয়েছেন এঁরা। সম্প্রতি মুম্বাইয়ে উদ্বোধন হল ডিটোর ওয়াটার প্ল্যান্ট। থানের একটি বস্তিতে তিনটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের উদ্বোধন করলেন জ্যান্ডার সাহেব নিজে। ওয়াটারলাইফ নামের একটি সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তৈরি হয়েছে এই প্ল্যান্ট। ওই দরিদ্র বস্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হুয়ের বেঁধে দেওয়া মাপকাঠির তুলনায় আরও ভালো আরও পরিচ্ছন্ন জল দেওয়া হবে বলে দাবি করছে ডিটো এবং ওয়াটারলাইফ। তাও আবার নাম মাত্র মূল্যে। যেখানে জলের আকাল সেখানে ডিটোর এই উদ্যোগে হাতে স্বর্গ পেয়েছে ওই এলাকার মানুষ। থানের পুরসভা এই জল প্রকল্পের জন্যে জায়গাও দিয়েছে সৌজন্যের খাতিরে।

ফিরে আসি কলকাতায়। কারণ এই শহরের বন্ধু দমিনিক ল্যাপিয়রের সঙ্গে এই জ্যান্ডার সাহেবের একটা যোগ আছে। সেকথা আপনাদের না জানালে এই ডাচ সাহেবকে চেনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ল্যাপিয়রের সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। আমরা যারা কলকাতার মানুষ তাদের কাছে ল্যাপিয়র খুবই পরিচিত। জীবনানন্দ দাশের দেওয়া কলকাতার তিলোত্তমা পদবীর একটা সমগোত্রীয় আন্তর্জাতিক পদবী দিয়েছেন ল্যাপিয়র City of Joy। রোগ ভোগ দারিদ্রের যন্ত্রণায় কাতরানো এই শহরের অস্বাস্থ্যকর বস্তির ভিতরও হৃদয় কিভাবে পদ্মের মতো ফুটে ওঠে জানতেন দমিনিক। এবার তাঁর হাতের মশালটা তুলে নিয়েছেন জ্যান্ডার সাহেব। জ্যান্ডার ভান মিরউইজ্‌ক। উত্তর ইউরোপের একটি ছোট্ট দেশ হল্যান্ডের লোক। মহাসমুদ্রে একটা ছোট্ট বিন্দুর মত এই দেশ। কেরিয়ারের শুরুতে সেখানেই সাংবাদিকতা করতেন। তারপর ব্যবসা। ঘর সাজানোর সামগ্রীর ব্যবসা। বেডকভার বেডশিট থেকে যেকোনও রকম গৃহসজ্জার জিনিসই বিক্রি করতেন জ্যান্ডার। মূলত ট্রেডার ছিলেন। ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে নিয়ে যেতেন সামগ্রী। দারুণ দামে বিক্রি হত ইউরোপের বাজারে। দেখতে দেখতে ফুলে ফেঁপে উঠলেন জ্যান্ডার মিরউইজ্‌ক। পরিধিতে বৈচিত্র্যে বাড়ল ব্যবসা। যেসব ভেন্ডারের কাছ থেকে সামগ্রী নিয়ে যেতেন তাদেরই প্রোডাকশন ইউনিট ঘুরতে গিয়ে একবার তাঁর চোখে পড়ে দরিদ্র শিশুদের ক্লিষ্ট মুখ। ওরা তার জন্যে প্রোডাক্ট তৈরিতে ব্যস্ত অন্ধকার কারখানায়। লজ্জায় মিশে যেতে থাকলেন জ্যান্ডার। আত্ম দংশন হল। স্থির করলেন এই দরিদ্র শিশুদের জন্যে কিছু একটা করবেন। আদ্যন্ত ব্যবসায়ী জ্যান্ডার শর্ত রাখলেন দরিদ্র এই শিশুদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখার প্রতিশ্রুতি দিলে তবেই মাল কিনবেন। এইভাবে ধীরে ধীরে সামাজিক উদ্যোগে ঢুকে পড়তে থাকেন জ্যান্ডার। এরই মধ্যে আলাপ হয় দমিনিক ল্যাপিয়রের সঙ্গে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় বেরিয়ে আসে দুজনের মতের কী ভীষণ মিল। প্রগাঢ় হয় বন্ধুত্ব।

১৯৭০ এর দশকের শেষের দিকে। বন্ধুত্বের পাশাপাশি সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দেন জ্যান্ডার। ল্যাপিয়রের কাজের জায়গা মূলত কলকাতার সেই সব দুঃস্থ দরিদ্র মানুষগুলো যাদের সুস্থ জীবন বলতে কিচ্ছু ছিল না। তাঁর উপন্যাস সিটি অব জয়ের রয়্যালটির টাকায় একটু একটু করে মুখ তুলছিলো হাওড়ার বস্তি এলাকা। তখনই দমিনিকের হাত ধরলেন জ্যান্ডার। ভালো লাগতে শুরু করে ভারতের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কাজ। তাই বিভিন্ন প্রজেক্টের সঙ্গে জুড়তে থাকেন নিজেকে। শুধু ভারতে কেন হল্যান্ডেও সমাজসেবায় ব্রতী হন জ্যান্ডার। অতি বিনয়ী জ্যান্ডার বলছেন তাঁর সেবামূলক কাজ এই মহাসাগরে একটা ছোট্ট বিন্দুর মতো। বুদবুদের মতো। কিন্তু বিন্দু গুলিই খুব জরুরি। শুরু করেন তাঁর সমাজসেবী সংস্থা ডট ইন দ্য ওশন বা DITO Foundation, ছোট্ট দেশ হল্যান্ড থেকে সেবা ব্রতের টানে ছড়িয়ে পড়েন এশিয়ায়। মূলত ভারতে। কেবল দানে বিশ্বাস করেন না জ্যান্ডার। তিনি চান, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখুক দরিদ্র এই দেশ। প্রাথমিক ভাবে ভারতের মৌলিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছেন তিনি। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যকেই অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ শুরু করেছেন। আশির দশকের প্রথম দিকে শুরু হয় বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করা। এখনও স্বপ্ন দেখেন ভারতে স্থায়ী এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনার কঠিন কাজটায় তার সংস্থা সামান্য হলেও প্রাসঙ্গিক এবং জোরালো অবদান রাখতে পারবে।