বাইকে চড়ে বিশ্বজুড়ে করুন হানিমুন

বাইকে চড়ে বিশ্বজুড়ে করুন হানিমুন

Wednesday January 13, 2016,

4 min Read

উত্তম সুচিত্রার সেই চির রোম্যান্টিক মুহূর্তটা কোনও বাঙালি কি ভুলতে পারে। হোক না সাদা কালো কিন্তু হাজার ওয়াটের চোখ ধাঁধানো হাসি। ফুরফুরে হাওয়ায় উড়ছে টাই। হেলমেট হীন হিরো বাইক চালাচ্ছেন। পিছনে হিরোইন। সুচিত্রার ভুবনমোহিনী রূপ। সুতীব্র মেধার রোশনাই। বাঙালি আধুনিকতায় মার্জিত ঠোঁট নড়ছে... এখনও কানে লেগে আছে... এই পথ যদি না শেষ হয়... তবে...। নিশ্চয়ই ভীষণ বোরিং হত।

কখনও ভেবেছেন বাইকে করে গোটা পৃথিবী ঘোরার কথা। থ্রিলিং! তাইতো! কিন্তু ভাবুন তো। পথে ঘাটে লু। খাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট বন্দবস্ত নেই। আহার যত্রতত্ৰ শয়ন হট্টমন্দিরে... কী পারবেন? ঘাবড়ে গেলেন! নাকি আইডিয়াটা বেশ মজার লাগছে? মনে হচ্ছে ঘন্টায় ঘন্টায় ফেসবুক স্টেটাস আপডেট করা যাবে! প্ল্যান না থাকলে পকেটে একটা বড় ফুটো হয়ে যাবে। কৃষ্ণগহ্বরের মত।

চলুন আজ বরং এক ভবঘুরে ফটোগ্রাফার দম্পতির সঙ্গে আলাপ করি। শুনবো ওদের গল্প ওঁরা নিজেদের বাইকে চড়ে পৃথিবী ভ্রমণ করেছেন। আমাদের টিপস দেবেন, কিভাবে গোটা একটা বছর ধরে পৃথিবী আনাচ কানাচ ঘুরে বেড়ানো যায়।

image


নিজের বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে প্রতিটি মানুষের অনেক স্বপ্ন থাকে। আর এই বিয়ের অনুষ্ঠানের ছবি ক্যামেরা বন্দি করে ফোটোফ্রেমে ধরে রাখেন মণিকা আর স্বারিক। হঠাৎ মাথায় খেয়াল চাপে পৃথিবী ভ্রমণে যাবেন। তাই টানা পাঁচবছর ওঁরা দুজনেঅতিসতর্কে প্ল্যান করেন। পিপড়ের মতো টাকা জমান। আর একদিন বেরিয়ে পড়েন বাইকে চড়ে পৃথিবীর প্রতিটি কোণা নিজের চোখ দিয়ে আবিষ্কারের আনন্দ পেতে।

আমরা অনেকেই রোজনামচার জীবনযাপন করে ক্লান্ত। তবে হুট করে বেরবো বললেই হয় না। প্ল্যানিং চাই। টিভি চ্যানেলে ট্র্যাভেল শো দেখা,অনলাইনে হোটেল বুক করা আর কোনো জায়গায় স্বশরীরে ঘুরতে গিয়ে সেই এলাকার আদ্যপান্ত জানা, চেনা, উপভোগ করার মধ্যে বিস্তর ফারাক। মণিকারা তাঁদের Triumph Tiger 800XC মোটর বাইকে চেপে চষে ফেলেছেন দুনিয়া। আর আমাদের বলছিলেন সেই অভিজ্ঞতার কথা।

বলছিলেন কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হয়েছে। যেমন বাইকটা দুজন মানুষ এবং প্রয়োজনীয় মালপত্রের ভার বইতে সক্ষম কিনা। ওঁরা তাই হাল্কা,নরম স্যাডেল ব্যাগ নিতে বলছেন। ওঁরা জিনিস নিতে একধরনের পেলিকান কেস ব্যবহার করেছেন যা ফটোগ্রাফার এবং মিউজিশিয়ানরা করেন। এছাড়াও ছোটখাটো জিনিস,ক্যাম্পিং গিয়ার এসব দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়েছেন কাপড়ের ব্যাগে। জীবনের এক দুর্দান্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে গেলে সতর্কতাও প্রয়োজন। স্বারিক বিশেষ নজর দিয়েছেন সেফটি গিয়ার, রাইডিং গিয়ার এবং ভাল মানের হেলমেটের উপর।

বিভিন্ন মহাদেশে ওঁদের বাইকের ট্রান্সপোর্টিং এর বিষয়টি ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। এয়ার কার্গো করে বাইকটি উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ছিল সবচেয়ে মুস্কিল। অনেক দেশে ‘Carnet de Passage,’ বলে এক ডকুমেন্ট লেগেছে, যা প্রমাণ করে বাইকটি শুধুমাত্র ভ্রমণের জন্যই ব্যবহার করা হচ্ছে।

image


মণিকা বললেন,পাঁচ বছর ধরে টাকা জমিয়েছেন। অনেক কৃচ্ছসাধনের দরকার নেই। দুদিন বাদে বাদেই বড় রেস্তোরায় না খেতে গেলেই টার্কির একটি টিকিটের টাকা উঠে আসবে। সবটাই নিজের মনকে বোঝানোর বিষয়। অন্য লোকের সঙ্গে কাউচ সার্ফিং করে থাকলে হোটেল খরচ অনেকটা বাঁচে।

মণিকারা প্রায় ৩৩,০০০ কিলোমিটার বাইকে সফর করেছেন। ওঁদের প্ল্যান আগামী ৪/৫ বছর ধরে এভাবেই কাজের অবসরে দুনিয়ার নানান শহরে টো টো করা। ওঁরা সবসময় বাইকের দূষণ নিয়ন্ত্রক পরীক্ষা করান। স্বারিক সর্বাপেক্ষা অনুকূল গতিতে বাইক চালান, যা শুধু জ্বালানী সাশ্রয় করে তাই নয়,বায়ুদূষণও কম করে। প্লাস্টিকের বোতল, বাটি, গ্লাস এসব ওঁরা ব্যবহারই করেন না। জায়গায় জায়গায় থেমে পানীয় জল ভরে নেন। রিচার্জ করা যায় এমন ব্যাটারি ব্যবহার করেন। ট্যুরে যতটা সম্ভব কম মালপত্র বহন করেন। সবচেয়ে বড় কথা, ওঁরা প্রকৃতিপ্রেমী। প্রাকৃতিক সম্পদ অথবা বনভূমির কোনো ক্ষতি করেন না।

image


জানতে চাইছিলাম সপ্তাহের সাতদিন কিংবা দিনের ২৪ ঘন্টা দুজন দুজনের সঙ্গে রয়েছেন। একঘেয়ে লাগে না? ঝগড়া হয় না কখনো? স্বারিক বলেন আগের রাতে যত বোকা বোকা বিষয় নিয়েই ঝগড়া হোক না কেন,ভোরবেলা তাঁবুতে,হোটেলের কামরায় বা কাউচে যেখানেই ঘুম ভাঙ্গে,তাঁরা একে অপরের দিকে হেসে তাকান এবং সুপ্রভাত বলে দিন শুরু করেন। মণিকার কথায় সবচেয়ে বিরক্তিকর হল বাইক আর বাতাসের শব্দের মধ্যে চেঁচিয়ে স্বারিকের সঙ্গে কথা বলা। 

গোটা ট্রিপটাই স্মরনীয়। তবে এখনও ওরা মজা পান এটা মনে করে যে নরওয়ের একটা ফেরিঘাটের ওয়েটিং রুমে ওরা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দুজনেই হেসে গড়িয়ে পড়লেন সেই রোম্যান্টিক গাফিলতির জন্যে। 

এরকম অজস্র স্মৃতির জন্যে আরও অনেকবার ওরা এরকমই অ্যাডভেঞ্চারে যেতে এক পায়ে খাড়া। ফলে তাঁর মোক্ষম টিপস কাজ করতেই হবে। এখনো অনেক দুর্দান্ত সূর্যোদয় বিষণ্ণ করা সূর্যাস্ত দেখা বাকি। ফলে তাঁরা সারাদিনের কাজের শেষে ঘরে ফিরে প্ল্যান করেন পরেরবার কোথায় যাবেন? গোটা কর্মব্যস্ত জীবনটাই তো আসলে জলজ্যান্ত অ্যাডভেঞ্চার। কি তাই না?

(লেখা বাহার দত্ত, অনুবাদ এষা গোস্বামী)