কলকাতার মাদুরদহে ম ম করছে Flavours of Asia

কলকাতার মাদুরদহে ম ম করছে Flavours of Asia

Saturday November 07, 2015,

5 min Read

শহরের ভিড় থেকে দূরে ছোট্ট একটা খাবারের দোকান। রেস্তোরাঁ ঠিক নয়, তাই বসার জায়গা থাকার কথাও নয়। আজকাল আমরা যাকে বলি টেক অ্যাওয়ে বা হোম ডেলিভারি পয়েন্ট, অনেকটা সেরকমই। আশেপাশের বাসিন্দারা বলেন আলাদ্দিনের পিদিম। শুধু বলতে হবে কী চাই। তাই সামনে হাজির করে দেবে জিনি থুড়ি, ফ্লেভারস অব এশিয়া। কেউ কেউ বলতেই পারেন, রাস্তার ধারের ভুরি ভুরি রোল, মোমোর দোকানের হিড়িকে এ আর নতুন কী? অভিনবত্ব একটাই। খাবারে বৈচিত্র। মাদুরদহের মতো জায়গার অনামী গলিতে ছোট্ট ওই দোকানে সবরকম চাইনিজ খাবারের স্বাদ চেখে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন দুই বাঙালি উদ্যোক্তা-ঋষিরাজ বোস এবং সুজন চট্টোপাধ্যায়।

image


টেকমেটিক ইউকে লিমিটেডে একসঙ্গে কাজ করতেন সুজন এবং ঋষিরাজ। লন্ডনে একসঙ্গে থাকতেন দুজনে। সুজন ভালো রান্না করতেন। ঋষিরাজ বন্ধুকে সাহায্য করতেন। তখন থেকেই ভাবনার শুরু। দুজনে মিলে খাবারের দোকান বা রেস্তোরাঁ জাতীয় কিছু একটা করার পরিকল্পনা ছকে ফেলেন। যদিও দেশে ফেরার পর সঙ্গে সঙ্গে তেমন কিছু করে ওঠা হয়নি। ঋষি ঢুকে পড়েন সাংবাদিকতায়। প্রায় বছর দশেক স্টার আনন্দ, নিউজ টাইম, কলকাতা টিভির মতো নিউজ চ্যানেলে কাজ করেন। এনজিওর জন্য ছবিও করেছেন। আর সুজন একটি নামী আইটি সংস্থার অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর। আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপান, নরওয়ে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন নামী আইটি সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতাও রয়েছে সুজনের। দীর্ঘদিন পর গতবছর দুই বন্ধু স্থির করলেন বহু দিনের পুরনো সেই পরিকল্পনা এবার বাস্তাবে রূপ দেওয়া হোক। 

খাবারের দোকান দেওয়ার জন্য বেছে নিলেন মাদুরদহকে। নাম দিয়ে দিলেন ফ্লেভারস অব এশিয়া। বাইরে থেকে এমনি কোনও বিশেষত্ব নেই। হঠাৎ করে চোখেও পড়ে না। পাশেই একটা রুটি-তরকার দোকান। সেটা ছাড়ালেই মুদিমালের বাজার রূপদাসি মার্কেট। আশেপাশে আর কোথাও চাইনিজ রেস্তোরাঁ নেই। তাই একটা প্রশ্ন না করে থাকতে পারছিলাম না। এত জায়গা থাকতে এই পান্ডব বর্জিত মাদুরদহ কেন? ‘সুজন পালটা প্রশ্ন করেন, কেন নয়?’ এরপর বলতে শুরু করেন, ‘আমার দুটো ফ্ল্যাট আছে এখানে। দুটোই ভাড়ায় দেওয়া। যারা থাকেন সবসময় অনুযোগ করেন, এখানে কাছেপিঠে ভালো চাইনিজ রেস্ট্রুরেন্ট নেই। খাবার আনতে হলে অনেকটা ঠেঙিয়ে রুবির মোড়ে আসতে হবে। আর নয়তো পিৎজা অর্ডার করা ছাড়া উপায় নেই। ইচ্ছে হলেই উইকএন্ড পার্টি করা যায় না, বা কোনওদিন ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছে করলেও খাবার পাওয়া যায় না। এত লোক এখানে থাকেন, তাঁদের এত চাহিদা। তাই আমরা ভাবলাম মাদুরদহই ঠিক জায়গা ব্যবসার জন্য’।

image


ঋষিরাজ দাবি করেন, চাইনিজ মেনকোর্সের সবটাই পাওয়া ‌যাবে ফ্লেভারস অব এশিয়ায়। মেনুকার্ডে চোখ না রেখে এক নিশ্বাসে বলে যান, ভেজ, এগ, চিকেন এবং মিক্সড ফ্রায়েড রাইস এবং চাউমিন (হাক্কা এবং গ্রেভি) রয়েছে মেন কোর্সে। আর সাইডডিশে চিলিচিকেন, গ্রিন চিলিচিকেন, সুইট/হট গার্লিক চিকেন, চিকেন উইথ জিনজার, লেমন চিকেন, চিকেন উইথ মাশরুম, চিকেন উইথ ভেলিটেবলস, থাই চিকেন, চিলিফিস, গ্রিন চিলিফিস, ফিস মাঞ্চুরিয়ান, প্রন মাঞ্চুরিয়ান, প্রন সেজওয়ান, চিলি প্রন, প্রন উইথ হট গার্লিক’...উফ্! দারুন লোভনীয় মেনু নিজেকে সামলানো মুশকিল! কোনও রকমে জিভের জল সামলে জানতে চাইলাম ভেজেটেরিয়ানদের জন্য কী ব্যবস্থা? ঋষিরাজ জানালেন, ‘সব গ্রেভি চিকেনের আইটেম পনির, মাশরুম আর বেবিকর্নে পাওয়া যাবে ভেজেটেরিয়ানদের জন্য। যারা খাবারে পেঁয়াজ-রসুন ভালোবাসেন না তাঁদের জন্যও আমরা ব্যবস্থা রেখেছি’। এতো গেল চিকেন, প্রন, ফিস আর নিরামিষির রমরমা। কিন্তু অনেকেই আছেন মটন আর ভাজাভুজি ছাড়া রোচে না, তাদের কথা ভাবেনি ফ্লেভারস অব এশিয়া? হেসে ঋষিরাজ উত্তর দিলেন, ‘না তাদেরও নিরাশ করিনি আমরা। অর্ডার করলেই পেয়ে যাবেন মটন পেঁয়াজি, মটন বটি ফ্রাই, মটন বল, ফিস ফ্রাই, ফিস ফিঙ্গার এমনকী ফিস ওরলিও’। এত কিছু! অস্ফুটে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল শব্দটা। ঋষিরাজ ধরে নিয়ে বললেন, ‘উইশ! একদম ঠিক শব্দ বলতে যা বোঝায়’। কথাগুলি শুনতে আলাদ্দিনের প্রদীপের সেই দৈত্য জিনির মতোই কানে বাজছিল, ‘কী চাই বল!’ নিমিষেই হাজির হত ইচ্ছেপূরণের ঝাঁপি নিয়ে! এখানে জিনির ভূমিকায় অবশ্যই ঋষিরাজ!

image


মাদুরদহের মতো জায়গায় একসঙ্গে খাবারের এত বৈচিত্র পাওয়া যেমন কঠিন, উলটো দিকে এটাও ঠিক একটু জনবহুল এলাকার দিকে এলে চাইনিজ রেস্তোরাঁর এই মেনু প্রায় সবখানেই এক। তাহলে ফ্লেভারস অব এশিয়ার বিশেষত্ব কী? ছোটখাট চেহারার ঋষিরাজ জানান, ‘মান এবং পরিমান। এই ইন্ডাস্ট্রির ভালো কুক দিয়ে আমরা রান্না করাই। চাইনিজ ফুড হলেও এমন রান্না হয় যাতে বাঙালি স্বাদও থাকে তার মধ্যে’। ঋষিরাজকে দেখতে আর দশটা ফাস্টফুড বিক্রেতার মতো নন। প্রায় সবসময় কিছু একটা পড়ছেন। জানা গেল, স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরির রেসিপি পড়েন। বন্ধু সুজন বলেন, ‘ক্ষতি কী যদি আমরা আমাদের খদ্দেরদের ভালো স্বাদের স্বাস্থ্যকর খাবার দিতে পারি এবং সেটা খেয়ে তাঁরা যদি খুশি হন, লাভ আমাদেরই’।

image


ফ্লেভারস অব এশিয়া শুধু নিজের ব্যবসাই বোঝে না, আশেপাশে ব্যাবসায়ীদের জন্যও আয়ের রাস্তা খুলে দিয়েছে। প্রতিদিনের মুদিমাল, সবজি আসে পাশের দোকান থেকে। সবজি বিক্রেতা রাজু, রামরা তাতে দারুণ খুশি। তাদেরও ব্যবসা বাড়ছে। কাছের অমর পোলট্রি সেন্টার এবার আর মুখে মুখে হিসেব রাখতে পারছে না, তাই ছাপানো বিল দেওয়া শুরু করেছে। ময়লা কুড়োতে আসেন যে লোকটা, তাঁরও রোজগার বেড়েছে। রাস্তার কুকুরগুলিকে আর অভুক্ত থাকতে হয় না। প্রতিদিনের মুরগির ছাঁট তাদের জন্য বরাদ্দ। যারা সেক্টর ফাইভে কাজ করেন আর থাকেন মাদুরদহে তাদের তো সোনায় সোহাগা। একা অথবা বন্ধুদের নিয়ে খাবার দাবার ডিনার এখন এক তুড়িতেই! তারাও তাই বেশ খুশি। ফ্লেভারস অব এশিয়াকে পেয়ে মাদুরদহই যেন ধন্য।

সবসময় এরকম ভালো মানের, ভালো স্বাদের খাবার দিয়ে যেতে পারবেন বলে দুই উদ্যোক্তাও বেশ আত্মবিশ্বাসী। তাঁরাই জানান, যদি স্যুপও অর্ডার করা হয়, তিন কিলোমিটারের মধ্যে হোমডেলিভারি দেওয়া হয়। তাঁদের এই উদ্যোগ কিছুদিনের মধ্যে সবার বাহবা কুড়োবে বলেও আশাবাদী দুই বন্ধু। সুজনদের এটাই প্রথম ভেঞ্চার। কিছুদিনের মধ্যে ছোট্ট খাবারের দোকানটিকে রেস্তোরাঁ করার ইচ্ছে রয়েছে বলে জানালেন। এক কথায় বলাই যায়, হ্যাপি ফুডিং মাদুরদহ!