দুই সহোদরার হাত ধরে আলোর পথে একদল খুদে

দুই সহোদরার হাত ধরে আলোর পথে একদল খুদে

Tuesday October 06, 2015,

4 min Read

কঠিন পরিস্থিতিতে একসময় পাড়া প্রতিবেশীরাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই সাহায্যটুকু না পেলে পড়াশোনা চালানো যেত কি না জানেন না জামশেদপুরের দুই মেধাবী বোন জ্যোতি এবং প্রিয়া চৌধুরী। ঠিক করে নিয়েছিলেন সাহায্যের দান কড়ায় গণ্ডায় মিটিয়ে দেবেন। করেছেনও তাই। স্টিল সিটি জামশেদপুরে দ্য সেটিং নামে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছেন। দরিদ্র পরিবারের প্রায় ৪০ জন শিশুর পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছে দুই বোনের এই সংস্থা। শিশুদের শিক্ষিকা জ্যোতি চৌধুরী বলেন, ‘তোমাদের মনই সব। একটা কিছুতে বিশ্বাস করতে শেখ, সেটাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যাও। অনেক বাধা আসবে ঠিকই। কিন্তু মনে মনে ঠিক করে রাখতে হবে, সব বাধা পেরিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে তুমি’।

image


খুদেদের যে উপদেশ দিলেন তাতে নিজেও বিশ্বাস করেন জ্যোতি। বিশ্বাস করেন মনের শক্তিতে। বেড়ে ওঠার সময়ই নিজেকে সামাজিক ধর্মযোদ্ধা করে তুলেছিলেন তিনি। জ্যেতি-প্রিয়া দুই বোনই তখন ছোট। অসুস্থ ছিলেন মা। তাই প্রতি দু-তিন মাস অন্তর হাসপাতালে ভর্তি করাতে হত। চিকিৎসার জন্য বাবা সবসময় মায়ের কাছে থাকতেন। টান পড়ল রোজগারে। সেই সময় গোটা চৌধুরী পরিবারকে আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছিল।

‘মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের। আমাদের শহরেরই এক এনজিও থেকে দুই বোনের পড়াশোনার জন্য আর্থিক সাহায্য পাই’,জানান জ্যোতি। বারাবর স্টিলসিটি জামশেদপুরে থেকে এবং বড় হয়ে জ্যোতির আচরণেও একটা বদ্ধ পরিকর ভাব ছিল। তখনই ঠিক করে নিয়েছিলেন, সমাজকেও তার দান কড়ায় গণ্ডায় পুষিয়ে দেবেন, যে সমাজ কঠিন সময়ে তাঁর এবং ছোট বোন প্রিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল, যখন তাঁরা খুব ছোট।

কথা রেখেছেন জ্যোতি। রুশি মোদি ফাউন্ডেশন নামে সংস্থা গড়েছেন। এই সংস্থারই একটি কেন্দ্র নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারগুলির বাচ্চাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে। টুয়েলভের পর এডুকেশন লোন নিয়ে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পঞ্জাব চলে যান জ্যোতি। তিন বছরের ছোট বোন প্রিয়া উচ্চশিক্ষার জন্য যান দিল্লি। জ্যোতি একটা স্টার্টআপে কাজ পান। তথ্যপ্রযুক্তিতে ক্যারিয়ার গড়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন মুম্বইয়ে। আর প্রিয়া এখন দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিন্যান্সে এমবিএ করছেন।

জ্যোতি চৌধুরী

জ্যোতি চৌধুরী


জামশেদপুরে থাকলেই বোঝা যায় রুশি মোদির সঙ্গে সেখানকার মানুষের কী আত্মীক যোগাযোগ। রুশি মোদি দীর্ঘদিন জামশেদপুরে ছিলেন এবং সেখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। সাধারণের বন্ধু হিসেবে পরিচিতি পান। ছোটবেলায় জ্যোতির একবার সৌভাগ্য হয়েছিল রুশি মোদির সঙ্গে দেখা করার। বাবা সবসময় বলতেন, ‘রুশি মোদির মতো হও’। ‘তিনি আমাদের সবার আদর্শ ছিলেন। তাই আমার স্টার্টআপও তাঁর নামে হবে, সেটাইতো স্বাভাবিক’, হেসে বলেন জ্যোতি। ২০১৩ সালে তাঁর সংস্থার পথ চলা শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল সাধারনকে শিক্ষা দেওয়া এবং তাদের মধ্যে উন্নত মানসিকতা তৈরি করা। রুশি মোদি ফাউন্ডশন একটা রেজিস্টার্ড সংস্থা। যদিও দুই বোন সবসময় শারীরিকভাবে হাজির থাকতে পারেন না, তবুও কাজ আটকায় না। সংস্থায় তাঁদের যার যা কাজ একদম ছকে বাঁধা। প্রিয়া সংস্থার অপারেশনাল দিকটা দেখেন। জ্যোতি প্রতিদিনকার কাজগুলি সামলান।

মুম্বইয়ে একটি সংস্থায় সম্পূর্ণ সময়ের কর্মী হয়েও জ্যোতি চেষ্টা করেন প্রতি দু-তিন মাস অন্তর নিজের শহরে এসে কাজকর্ম দেখে যেতে। ঠিক যেভাবে স্বপ্ন দেখতেন সেভাবেই বারিধে দুই বোনের সংস্থা চলছে। প্রিয়াও নিয়মিত যাতায়াত করে সংস্থার কাজ দেখভাল করেন। ‘প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট থেকে লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা, ফান্ড জোগাড় করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সমাজকে কিছু দিতে পারছি, এই ভাবনাটাই বড় আনন্দ দেয়। আমাদের পাঠ্যক্রম সাম্প্রতিক গবেষণার উপর নির্ভর করে তৈরি, যেখানে বলা হয়েছে মনই সব। মানসিকতা যদি উন্নত হয়, তবে জীবনের শীর্ষে পৌঁছে যেতে কোনও বাধাই সামনে আসতে পারবে না। অসম্ভব বলে কিছু হয় না-এটাই একমাত্র মন্ত্র আমরা শিশুদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে চাই’, বলে চলেন বছর ২৪ এর জ্যোতি।

প্রিয়া চৌধুরী

প্রিয়া চৌধুরী


একসময় দুই বোন যখন এইসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলেন তখন চারপাশের লোকজন খুব একটা সমর্থন করেননি। ‘যাদের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে সেই বাবা-মায়েরা ভাবেনও না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য সন্তানরা স্কুলে গেল কি না। বরং তাঁরা ভাবেন কোনও কাজ করলে সংসারে দু পয়সা আসত। এই বাচ্চাগুলির বাব-মাকে বোঝানো এবং সন্তাদের পড়াশোনা করতে স্কুলে পাঠানোর জন্য রাজি করানো একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জিং এবং মজার’, বলেন জ্যোতি।

এখনও দুই বোন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কীভাবে এই সংস্থায় টাকা দিলে সেটা ট্যাক্স ফ্রি করানো যায় কি না। এখনও পর্যন্ত জ্যোতির সেভিংস এবং কয়েকজনের দানে সংস্থা চলছে। জ্যোতির লক্ষ্য অনুমোদন পেলেই সংস্থাটিকে পুরপুরি স্কুল করে ফেলার। সেন্টার থেকে তিনি বাবা-মা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ফিডব্যাক নেন নিয়মিত। ‘আমার বাচ্চাগুলি এবং স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে সবসময় ফিডব্যাক নিচ্ছি কীভাবে সেন্টার চালানো যায়। পড়ুয়াদের কতটা উন্নতি হল সেদিকেও খেয়াল রাখি। যখনই আমি তাদের সামনে দাঁড়াই বাচ্চাগুলির উৎসাহ যেন দ্বিগুন হয়ে যায়, দাঁড়িয়ে অনেক কিছু বলে, যা শুনে মনে হয় সবাই ঠিক পথেই এগোচ্ছে, অন্তত সবার সামনে তাদের কথা বলার এই ক্ষমতা, সেটাই তো আজকাল খুব জরুরি’, বলেন জ্যোতি।

তিনি খুশি, কারণ কিছু মানুষের জীবনে একটা কিছু পরিবর্তন আনতে পেরেছেন। জামশেদনগরের বছর ২৪ এর মেয়েটির চোখে খুশির ঝিলিক। বলে যান, ‘আমার যেমন উন্নতি হচ্ছে, আমার সেন্টারেরও উন্নতি হচ্ছে’।