যে পাঁচজনের সঙ্গে অন্তত একবার আপনার দেখা করা উচিত
Thursday April 07, 2016,
6 min Read
এই গরমে রাস্তায় বেরোতেই কেমন ভয় ভয় করে। প্যাঁচ প্যাঁচে ঘাম, ধুলো ধোঁয়া। ভিড় ঠেলে, গুঁতোগুঁতি করে রোজ অফিস যেতে হয়। সেজে গুজে বাড়ি থেকে ববেরলেন কিন্তু দেখলেন পথে যেতে যেতেই আপনি ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে একসা। সেদিন আমারও তাই হয়েছিল। তবে ওলা, উবের-এর দৌলতে আমার আজকাল কোনওক্রমে পথকষ্ট দূর হয়েছে। কিন্তু মনটা ভালো হয়ে গেছে বিল রেডফার্নের সঙ্গে আলাপ হয়ে। ভালো নাম উইলিয়াম রেডফার্ন। সবাই ডাকে বিল। ফ্লোরিডায় থাকেন। ভারতীয় সংস্থা MACJ-র সঙ্গে বাণিজ্যিক একটি চুক্তি চূড়ান্ত করতে কলকাতায় এসেছিলেন। পার্ক হোটেলে সেদিন আলাপ হল। বলছিলেন, কলকাতা ওঁর ভালো লেগেছে। খুব অল্প সময়ের জন্যেই শহরে রাস্তায় ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের বাইরে ছিলেন। তাতেই এখানকার উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে গিয়েছেন। শারীরিক শ্রমে, ঘামে কিংবা ধুলো কাদায় কখনওই বিলের আপত্তি ছিল না। ওঁর সম্পর্কে যত শুনলাম, যত আলাপ গড়াল মনটা ভালো হয়ে গেল।
লোকটা একটা সময় কানাডায় জমি বাড়ির দালালি করতেন। দালালি শব্দে অনেকের আপত্তি থাকতেই পারে কিন্তু ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওঁর নাকি কোনওই আপত্তি নেই। দালালিটা এনজয় করতেন বিল। আর এটাই ওঁকে তৈরি হতে সাহায্য করেছে। আজ থেকে প্রায় বছর ষোলো আগে খুলে ফেলেন তাঁর স্টার্টআপ। যাঁরা বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনছেন তাঁদের জন্যে বিলের স্টার্টআপ। কোন ফ্ল্যাট কিসে ভালে সে অভিজ্ঞতা ক্রেতার নাও থাকতে পারে, ঠকে যেতে পারেন, দামের সঙ্গে সুবিধের সামঞ্জস্য নাও হতে পারে তাই তাঁদের কথা ভেবেই খুলে ফেলেন তাঁর সংস্থা A Buyer’s Choice Home Inspections এক কথায় ABCHI। আবাসন প্রকল্পগুলোর দরজায় দরজায় ঘুরে রীতিমত নম্বর দেয় ABCHI। সেই ভিত্তিতেই দাম স্থির হয়, ক্রেতার ভিড় জমে। ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে কানাডা আর মার্কিন মুলুকে শুরু হয় ABCHI-র জয়জয়কার। এখন গোটা দুনিয়ার তাবড় তাবড় ডেভেলপাররা তাঁর নামেই থর-হরি-কম্প। ১৫ টি দেশে ছড়িয়ে আছে তাঁর শ'দুয়েক ফ্র্যাঞ্চাইজির জাল। MACJ-র সিইও মহেন্দ্র সুরেকা বললেন, এবার ওঁদের হাত ধরে বিল ঢুকছেন ভারতের বাজারেও। ২০২০-র মধ্যে দুনিয়ার অন্যদেশ গুলিও ছুঁয়ে ফেলবেন বিল। শচারেক ফ্র্যাঞ্চাইজির বিশাল সংসার পেতে বসবেন কিছু দিনের মধ্যেই। প্রতিযোগিতার বাজারে বিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী না হলেও দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে। খোঁজ নিয়ে জানলাম ও ম্যারাথনে দৌড়ন। সপ্তাহে কমকরে কুড়ি ঘন্টা সময় দেন শরীর চর্চায়। ২০১৩-য় এই পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই যুবক হাফ ম্যারাথন দৌড়েছেন ১ ঘন্টা ৫৫ মিনিটে। পরের মাসেই মিয়ামি, ফ্লোরিডা ট্রায়থলনে কুড়ি মাইল সাইকেলে, ৬ দশমিক ২ মাইল দৌড়ে ফিনিশ লাইন ছুঁয়েছেন মাত্র ২ ঘন্টা এগারো মিনিটে। এই প্রাণ শক্তিই বিলকে ফ্লোরিডা থেকে কলকাতায় এনেছে। ২০০ থেকে ৪০০ ফ্র্যাঞ্চাইজি খোলার হিম্মত দিচ্ছে।
বিলের কথা বলতে বলতেই এক কর্মচঞ্চল নারীর কথাও মনে পড়ে গেল। এই তো সেদিন দেখা হল। কলকল করে কথা বলেন। স্নিগ্ধ হাসিতে ভরিয়ে দেন কনফারেন্স রুম। সকাল শুরু হয় শরীর চর্চা দিয়ে। অক্লান্ত পরিশ্রম করার সুলুক বোধ হয় ওটাই। নাকি আরও অনেক কিছু। যেমন সবুজের কাছাকাছি থাকা কিংবা কলেজ পড়ুয়াদের একটা দঙ্গলের নেতৃত্ব দেওয়া। অথবা ওর কুকুর মিস্টি। ও বলে কুকর্মের পার্টনার। আচ্ছা বলুন তো আমি কার কথা বলছি! ও এই কলকাতারই মেয়ে আপনিও চেনেন হয়তো। এন এস এইচ এমের ক্যাম্পাসে সবাই ওকে একডাকে চেনে অনিশা ম্যাম বলে। অনিশা মেহতা কোঠারি। মাল্টিকন গ্রুপের কর্ণধার দিলীপ সিং মেহতার মেয়ে। ছোটো বেলা থেকেই খেলাধুলোয় দারুণ শখ। টেনিস, ডার্ট, ম্যারাথন সবেতেই সমান উৎসাহ। তবে পাল্লা ভারি ডার্টে। মর্ডার্ন হাই স্কুল, জি ডি বিড়লা কলেজ হয়ে বিদেশে এমবিএ করে ফিরে এসেছেন। বিয়ের পরও দস্যিপনা কমেনি। বিদেশে থাকলে একা একা বেড়াতেই বেশি ভালোবাসেন। নিঃসর্গ টানে। মানুষও। ম্যানেজমেন্ট স্কুল এনএসএইচএম-এর যে কমিউনিটি রেডিও সেই ওয়াই এফএম-এ অনিশাই প্রাইমাডোনা। সারাদিন মেতে আছেন রেডিওর কমিউনিটি নিয়ে। নানান প্রোগ্রাম, নানান ভাবনা আর শয় শয় ছাত্রছাত্রীর টিম। কাউকে পাঠিয়েছেন সুন্দরবন... কেউ গেছে জঙ্গলমহল। হোয়াটসঅ্যাপ-এ মেসেজ ঢুকছে। ছবি আসছে... মুহুর্মুহু। টিম সবসময় কানেক্টেড। ওঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হল তারুণ্যে টগবগ করছেন।
আলাপ হল হৃদয়ে তরুণ আরও একজনের সঙ্গে। যার এনার্জি লেভেল দেখলে বিরাট কোহলিও লজ্জা পাবেন। নাম ডক্টর পবন আগরওয়াল। মুম্বই ডাব্বাওয়ালাদের বিশাল লজিস্টিক চেইনের একমাত্র মুখপাত্র। তিনিই সিইও। তিনিই অ্যাম্বাসেডর। রীতিমত গবেষণা করেছেন ডাব্বাওয়ালাদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে। ১২৬ বছরের পুরনো এই ব্যবস্থাকে পবনজি নতুন করে ব্র্যান্ডিং করেছেন। আর সেটা করতেই মুম্বই ডাব্বাওয়ালা এখন সিক্স সিগমা। নির্ভুল হওয়ায় দেশের একমাত্র গর্বের প্রতিষ্ঠান। ক্লিন্টন থেকে যুবরাজ চার্লস কুর্নিশ করতে বাধ্য হয়েছেন মুম্বইয়ের ডাব্বাওয়ালা প্রথাকে। ইজ্জতের কিস্তি টুপিটা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ান বেটে খাঁটো এই প্লেয়ার। সেদিন ভাষণ দিচ্ছিলেন পানিহাটিতে জেআইএসের একটি কলেজে। শ্রোতারা অধিকাংশই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রছাত্রী। শুরু থেকেই গলার শিড়া ফুলিয়ে বলে দিলেন তিনি অনর্গল কথা বলতে ভালোবাসেন। আর তিনি সব থেকে বেশি ভালোবাসেন তরুণদের অনুপ্রাণিত করতে। ঝোড়ো সফরে পবনপুত্রও ছিলেন সঙ্গে। বাবার সঙ্গে সঙ্গে ফেরি করে বেড়াচ্ছিলেন ডাব্বাওয়ালাদের মর্যাদার লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত। পবনের প্যাশান নিজে চোখে না দেখলে ঠাহর করা যাবে না।
প্যাশান দেখলাম আরও একজনের মধ্যেও। কলকাতার ছেলে। জন্ম, লেখাপড়ার শুরু কলকাতাতে হলেও ১৯৯২ থেকেই কাটিয়েছেন কলকাতার বাইরে। প্রথমে কানপুর আইআইটি তারপর সোজা বোস্টোন ইউনিভার্সিটি। কিন্তু কলকাতায় শেকড় বাকড়। বন্ধু পরিজন। ছোটোবেলার স্মৃতিঘেরা ট্রামলাইন, ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে চলার ফুটপাথ, বৃষ্টিভেজা আদুরে ভিক্টোরিয়া। স্পর্ধার শ্যামবাজার। বাগবাজারের চায়ের ঠেক। উচ্ছন্নে যাওয়ার ধর্মতলা। পঁচা গন্ধ, তবু এশিয়ার সেরা ফুলপট্টি। যাদবপুর-গড়িয়াহাটা-আহিরিটোলা। দুর্গাপুজোর ঢাক। কালীপুজোর কুড়কুড়ি। তা থৈ বাবুঘাট। আর তার টানেই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছেন। কিছুদিন হল মনস্থির করেছেন কলকাতাতেই থাকবেন। ছবি তুলবেন। আড্ডা মারবেন। আর এখান থেকেই শুরু করবেন তাঁর কাজ। তুখোড় পদার্থ বিজ্ঞানী ডক্টর অর্ণব মজুমদার এবার মন দিয়েছেন রাশি বিজ্ঞানে। বিগ ডেটা নিয়ে আগ্রহ ছিলই। এবার ডেটা সায়েন্স নিয়ে খুলে ফেলেছেন স্টার্টআপ। কলকাতা যার দফতর কিন্তু ক্লায়েন্ট মার্কিন মুলুকে। সম্প্রতি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে যন্ত্রের ভাষা। মেশিন লার্নিং ল্যাঙ্গুয়েজ ডিকোড করছেন বিজয়গড়ের ছোট্ট ফ্ল্যাটে। ছোটোবেলার বন্ধু কৌস্তভ চক্রবর্তির সঙ্গে জোট বেঁধে শুরু করেছেন আর্কভিশন টেকনোলজিস। নিভৃতে বসেই স্বপ্ন দেখছেন আকাশ ছোঁয়ার।
খুব বেশি দূরে নয়... অর্ণবের সঙ্গে গল্প করে ফেরার পথেই চোখে পড়ল খোয়াই। শান্তিনিকেতনের ছোঁয়া আছে দোকানটায়। হাতের কাজ। তাঁতের শাড়ি। ডোকরার পুতুল ঝুলছে। একটু আগবাড়িয়ে আলাপ জমাতে গিয়েই দেখলাম... আরে একে তো আমি চিনি। সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়। স্নিগ্ধ স্বভাবের ব্যক্তিত্বময়ী কস্তুরীদি। অনেক লেখা পড়েছি। খাসখবর যখন ছিল তখন টিভির পর্দায় কত দেখেছি। আর আজ আচমকাই খোয়াইয়ে। জানতে পারলাম। খোয়াইয়ের ফাউন্ডার উনিই। সঙ্গে অবশ্য দুই বোনকে নিয়ে শুরু করেছিলেন দোকান। ২০০৬ সালে। তার মানে দেখতে দেখতে দশবছর হয়ে গেল। আমি জানতাম না। এটা ভেবে লজ্জিত হব হব করছি তখনই মনে হল না জানা দোষের নয় জেনে নেওয়া গুণের। কস্তুরীদিও খুব স্বাভাবিকভাবেই গল্প জুড়ে দিলেন। উনিও আমার নাম শুনেছেন কিন্তু আলাপ ছিল না। হয়ে গেল। বললেন সাংবাদিক থেকে উদ্যোগপতি হওয়ার কাহিনি। শুরুটা মজা করেই করেছিলেন ওরা। কিন্তু যত সময় এগিয়েছে ধীরে ধীরে সিরিয়াসনেস বেড়েছে। প্রথমদিকে অনেকেই জানত না। যেমন হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে দক্ষিণ কলকাতার মানুষ শিল্পীত সামগ্রীর খোঁজে এখানে ছুটে আসেন। আমার সামনেই এক তরুণী এসে তাঁর স্মার্টফোনের জন্যে হাতের কাজ করা কাপড়ের পাউচ কিনতে এলেন। দেখলাম। আহা মরি দামও নয়। তাই চটপট বিক্রিও হয়ে যায় সামগ্রী। এরই ফাঁকে ফোন এল কোনও এক প্রকাশক অথবা সম্পাদকের। এই প্রান্তে কস্তুরীদি বলছেন, শুনতে পাচ্ছি।
- লেখাটা পাঠিয়ে দিয়েছি। দেখে নেবেন। আর একটা কথা, আমি কিন্তু আপনাদের কাগজের মর্জি মেনে লিখিনি কিছু। বরং উল্টোকথাই লিখেছি। কারণ আমি আগেই বলেছিলাম মনে আছে নিশ্চয়ই আপনাদের পত্রিকার লাইনকে সমর্থন করি না।
এরকমই ঋজু, সাহসী উদ্যোগপতি কস্তুরীদি এখনও নতুন কিছু করার কথা ভাবেন। কলকাতার স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে ভরসা রাখেন এটা ভেবেই ভালো লাগলো।