সাবান ব্যবহারে মুম্বইয়ে মার্কিন তরুণীর ‘সুন্দরা’
Tuesday September 01, 2015,
4 min Read
ইউনিলিভারের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে প্রায় ৭ কোটি এমন মানুষ রয়েছেন যারা কখনও সাবান ব্যবহার করেননি। ভারতে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে পাঁচ বছরের কম বয়সি একটি শিশু প্রাণ হারাচ্ছে ডায়েরিয়া বা অন্য অস্বাস্থ্যকর শারীরবৃত্তীয় কারণে। সচেতনতার সেই অভাববোধ উপলব্ধি করেই আমি একাজে এগিয়ে এসেছিলাম।
- এরিন জাইকিস, সুন্দরার প্রতিষ্ঠাতা
“সাবান জিনিসটা ঠিক কী? খায় না মাথায় দেয়?” এরিন জাইকিসকে বিস্মিত করে একদল থাই শিশু একথাই জিজ্ঞাসা করেছিল। মিশিগান ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক হওয়ার পরে শিশু পাচার বিরোধী একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়ে কাজ করতে থাইল্যান্ড পাড়ি দিয়েছিলেন মার্কিন তরুণী এরিন জাইকিস। থাইল্যান্ডের একটি গ্রামে স্কুল পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এমনই এক মজাদার পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল এরিনকে। বাথরুমে হাত ধুতে গিয়ে সাবান খুঁজে পাননি এরিন। তার থেকেও আশ্চর্যের চারপাশের কেউ বুঝতেই পারেননি সাবান বলতে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন। যাই হোক পাশের একটি টাউন থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় সাবানের ব্যবস্থা করেন এরিন। এবার গ্রামবাসীদের হাতে সাবান তুলে দেন তিনি। অত্যন্ত কৌতুকের সঙ্গে তিনি লক্ষ্য করেন, প্যাকেট খুলে গ্রামের লোকেরা নখ দিয়ে সেটা খুঁটছে, কেউ-কেউ মাথায় ঠুকছে। সাবান নিয়ে কী করবে সেটাই তারা বুঝে উঠতে পারছিল না। এরিনের কথায়, “সেই অভিজ্ঞতার পরে ঠিক করলাম আমি এই বিষয়টা নিয়েই কাজ করব। পানীয় জলের ব্যবহার নিয়ে অনেকেই কাজ করে থাকেন। কিন্তু সাবান বা এই ধরনের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ সেভাবে তো কেউ করেন না। আসলে আমি বিশ্বাস করি আমাদের ধর্ম যাই হোক না কেন আমরা সকলেই এক, সে আমরা যে দেশেই থাকি বা যে ভাষায় কথা বলি না কেন।” কিন্তু শুধুমাত্র সাবানের জন্যই যে এরিন এই কাজ বেছে নেন এমনটা নয়। আসলে তিনি যে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তার কাজটাই ছিল শিশু পাচার প্রতিরোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধি। কঠোর দারিদ্রের সঙ্গে বেঁচে থাকা সেইসব শিশুর অভিভাবকদের বোঝানোর কাজটাও সহজ ছিল না। শিশু বিক্রি রুখতে গিয়ে তাদের মায়েদের মুখ ঝামটাও সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে। এরিনের কথায়, “সেইসব মায়েরা কড়া ভাষায় আমাকে বলেছিল, আমাদের ছেলেদের ব্যাপারে তুমি নাক গলাচ্ছ কেন? তুমি কখনও বরের হাতে মার খেয়েছ? টানা তিনদিন না খেয়ে কাটিয়েছ?” পরে এরিন ভেবে দেখেন, সত্যিই তাঁর জীবনে এমন কোনও অভিজ্ঞতা নেই। নিজেকেই প্রশ্ন করেন কেন তিনি তাঁর মত তাঁদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন? সেই তুলনায় সাবান বা সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি বিষয়টা অনেকটাই সহজ। যদিও সাবান ব্যবহারের বিরোধিতাও কম হল না। তারা সাবান ব্যবহার করতেই রাজি নন। এরই মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এরিন জাইকিস।
“আমি মনে করি সকলেরই সাবান ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া উচিত। সাবান ব্যবহার আমাদের আত্মসম্মান বাড়ায়। প্রত্যেক শিশুরও এর প্রয়োজন রয়েছে। যাতে তারা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে। এটা আমাদের মতো শ্বেতাঙ্গদের ধারণা বা ভারতীয় ভাবনা, এভাবে দেখাটা ভুল, এটা একটা সর্বজনীন বিষয়”, বললেন এরিন। এছাড়া সোপ রিসাইক্লিংয়ের বিষয়টিও নাড়া দেয় এরিনকে। ফেলে দেওয়া সাবানকে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছুই করা যায়। এরিনের কথায়, হোটেলে অব্যবহৃত সাবানের দিকে তাকান। শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই সামান্য ব্যবহার হওয়া সাবানের সংখ্যাটা ১০০ কোটির কাছাকাছি। সেইসব সাবান ফেলে দেওয়া হয়। এইসব সাবান রিসাইক্লিং করলে পরিবেশেরও উন্নতি হয়। এই সাবান সংগ্রহের কাজে ভদ্রস্থ একটা মজুরির বিনিময়ে প্রান্তিক মহিলাদের কাজে লাগাই। ফলে কর্মসংস্থান হল। এবার এইসব মহিলাদের শিখিয়েপড়িয়ে জনস্বাস্থ্য সচেতনতার কাজে লাগান হয়। আমি মনে করি, জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত কাজটা সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের নিজের ভাষাতেই ভাল হয়। মানুষ সহজে তা বুঝতে পারেন এবং গ্রহণ করেন।
২০১৩ সালে সুন্দরা গড়ে তোলেন এরিন। কীভাবে কাজ করে সুন্দরা? এককথায় বলা যায় কর্মপদ্ধতির মধ্যে কোনও জটিলতা নেই। প্রথম ধাপে মুম্বইয়ের বেশ কয়েকটি হোটেল থেকে অব্যবহৃত বার সাবান সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে বড় হোটেল যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে বুটিক। এরপর সেই সংগৃহীত সাবান মুম্বইয়ের শহর থেকে একটু দূরে কালওয়ায় ওয়ার্কশপে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সেইসব সাবান শোধনের কাজ করেন বস্তিবাসী মহিলারা। অবশ্য এজন্য তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ঝাড়াইবাছাই করার পরে সেইসব সাবানের মণ্ড আর একটি মেশিনে ঢোকান হয়। এবার বেরিয়ে আসে নতুন বার সাবান। এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগে বড়জোর ৭ মিনিট। এইসব সাবান প্রতি মাসে তুলে দেওয়া হয় মুম্বইয়ের ৩০টির মতো স্কুলকে। সেইসঙ্গে চলতে থাকে স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রচারও।এই কাজের সুফল বহুমুখী। কীভাবে? এরিনের কথায়, ‘পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটছে (অব্যবহৃত সাবান মাটিতে না ফেলার জন্য), হোটেলগুলির সুনাম হচ্ছে (সামাজিক উন্নয়নে এগিয়ে আসার জন্য), বস্তিবাসী মহিলাদের লাভ হচ্ছে (কাজের বিনিময়ে তাঁরা মজুরি পাচ্ছেন) এবং পুরো কমিউনিটি লাভবান হচ্ছে (বিনামূল্যে সাবান মিলছে, সঙ্গে স্বাস্থ্য সচেতনতার শিক্ষা)।
এতসব তো হচ্ছে। সুন্দরার চলছে কী করে? সুন্দরাকে নিয়মিতভাবে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে কয়েকটি সংস্থা। এর মধ্যে কয়েকটি কর্পোরেট সংস্থাও রয়েছে। সুন্দরার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বেশ কয়েকজন। আরও কয়েকজনকে পে রোলে নিতে চান এরিন। বাড়াতে চান সাবান সংগ্রহের পরিমাণ। এজন্য আরও হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাও চলছে। তবে এতকিছু করেও নিজেকে বস হিসাবে ভাবতে চান না এরিন। তিনি মনে করেন, পৃথিবীতে বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। তারই মধ্যে একটি সমস্যার তিনি সমাধান করার চেষ্টা করেছেন আন্তরিকভাবে।
এপ্রসঙ্গে স্লামডগ মিলিওনেয়ার ছবিটির প্রসঙ্গও এনেছেন ইরিন। তাঁর কথায়, “ভারতীয়দের অনেকেই ছবিটা সম্পর্কে খারাপ ধারণা রাখেন। তাঁদের বক্তব্য, এর মাধ্যমে অপমান করা হয়েছে দেশকে। আবার আমার জায়গা থেকে এই সিনেমা চোখ খুলে দেওয়ার মতো।অনেক দেশে মানুষ কী খারাপ অবস্থার মধ্যে রয়েছে তা জানতে পেরেছি”। ঠিক একইভাবে শ্বেতাঙ্গ বলে কখনও কখনও খারাপ কথা শুনতে হয়েছে এরিনকেও। কিন্তু তিনি গা করেননি। সমাজসেবার কাজে এগিয়ে চলেছেন। আগামীদিনে আরও ছড়িয়ে দিতে চান তাঁর এই উদ্যোগ।