সেভ লাইফ ফাউন্ডেশনঃ ভারতে রাস্তায় বিপন্ন মানুষের জীবন বাঁচানোর মহৎ উদ্দেশ্য
২০০৭ সালে ৫ই এপ্রিল এক পথ দুর্ঘটনায় ১৬ বছরের শিবম বাজপেয়ির মৃত্যু হয়। শিবম দাদ্বশ শ্রেণির ছাত্র ছিল এবং আইএএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্কুলে যাওয়ার সময় একটা গাড়ি তাকে ধাক্কা মারে সে রাস্তায় পড়ে যায় এবং ঐ অবস্থায় সে নিজেকে বাঁচাতে কোনওরকমে একটি গাছের ধারে গিয়ে আশ্রয় নেয়। প্রায় ৪৫ মিনিট ওই অবস্থায় পড়ে থাকার তার জীবন যুদ্ধ শেষ হয়। শিবমের মা-এর শেষ ভরসা ছিল সে। কারণ শিবমের বাবা নেই, শিবম যখন ৬ মাসের শিশু তখনই তাঁর বাবা মারা যায়। ভারতে প্রতি চার মিনিটে একটি করে পথ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে, তাই বিশ্বের দরবারে ভারতের একটি লজ্জাজনক উপনাম জুটেছে “পথ দুর্ঘটনার রাজধানী”।
Monday September 07, 2015,
4 min Read
২০১২ সালে ভারতে ১,৩৫০০০ জন মানুষ পথ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। পথ দুর্ঘটনার প্রবণতা বিশেষত সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে অর্থাৎ ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এরাই দেশের ৩.২ % মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনে অংশগ্রহণকারী। শিবমের মামাতো ভাই পীযূষ তিওয়ারি এই ঘটনায় গভীরভাবে শোকাহত। যখন সে জানতে পেরেছিল শিবমকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সে বেঁচে যেত তখন তাঁর শোক ক্রমেই ঘৃণায় পরিণত হয়েছিল। ওই ৪৫ মিনিটে কমপক্ষে সেখান দিয়ে ১০০ জন মানুষ যাতায়াত করেছেন, কেউ পুলিশ ডাকেনি, অ্যাম্বুলেন্স ডাকেনি, এমনকি প্রাথমিক শুশ্রূষাটুকুও করেনি। সে অত্যন্ত বিষাদগ্রস্ত হয়ে প্রাত্যহিক জীবনে এই ধরনের অমানবিক ঘটনার কারণ জানার চেষ্টা করেন। পীযূষ মর্মাহত হয়ে পথ দুর্ঘটনায় আহতদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য একটি সংস্থা তৈরি করেন। ২০০৮ সালে সেভ লাইফ ফাউন্ডেশন নামক একটি দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে তোলেন তিনি। ২০০৯ সালে স্থানীয় পুলিশ অফিসার ও চিকিৎসকদের সহায়তায় আপৎকালীন চিকিৎসার ব্যবস্থা করে এই সংস্থা। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল পথ দুর্ঘটনায় যাতে কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়। অ্যাপোলো, ম্যাক্স হাসপাতাল ও এইম-এর সঙ্গে সহযোগিতা করে এই সংস্থা পথ দুর্ঘটনায় আহতদের রক্ত নিয়ন্ত্রণ, হৃদপিন্ড সংক্রান্ত চিকিৎসা ইত্যাদির কৌশল শিখছে। এখানে কর্মরত পুলিশদের ট্রেনিং এর জন্য আহত ব্যাক্তি উপর চিকিৎসা করার সুযোগ দেওয়া হয়, তা সফল হলে পুলিশের তরফ থেকে একটি সংশাপত্র দেওয়া হয়।
এই সংস্থার আর একটি সফল উদাহরণ হল- ১৮ বছরের একটি ছেলে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, পুলিশেরা দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করে সিআরপি চিকিৎসা প্রয়োগ করেন এবং ক্রমেই সুস্থ হয়ে ওঠেন ওই কিশোর। ২০১১ সালে দিল্লি হাইকোর্টে বিস্ফোরণে ৬ জন মারা যান এবং দিল্লি পুলিশের জীবন রক্ষা ট্রেনিং এর জন্য ৪৫ জন আহতকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে বলে পীযূষ জানিয়েছেন।
মানুষের জীবন রক্ষা করে তাদের সংস্থা বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছে, এই বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে পীযূষ আমেরিকাতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই সংস্থাকে পুরো সময় দিয়ে সাহায্য করতে ভারতে ফিরে আসেন। পুলিশ অফিসারদের ট্রেনিং-এর পাশাপাশি পীযূষ ‘সুপথিক আইন’ চালু করার কথা ভাবেন যাতে পথ দুর্ঘটনায় আহতদের সাহায্য করতে কেউ পিছপা না হন। এই ধরনের আইন ভারতের বাইরে আমেরিকা, ইসরায়েল, কানাডা, আর্জেন্টিনা ও অস্ট্রেলিয়াতে রয়েছে। ভারত এই আইন প্রয়োগের মূল কারণ লোকজন পুলিশি ঝামেলার ভয়ে পথ দুর্ঘটনায় আহতদের সাহায্য করার বদলে এড়িয়ে যান। সেভ লাইফের একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে ভারতে ৭৭% মানুষ পথ দুর্ঘটনায় আহতদের সাহায্য করতে অনীহা প্রকাশ করেন বিনা কারণে। কিন্তু ৮৮% মানুষ আইনি জটিলতা, পুলিশের অসহযোগিতার কারণে সাহায্য করতে ভয় পান। প্রায় দুবছর কঠোর ও অক্লান্ত গবেষণা ও জনগনের উৎসাহের পর সেভ লাইফ ফাউন্ডেশন সুপ্রিম কোর্টে সুপথিক আইন মামলা রুজু করেন। সুপথিক হওয়ার নীতি নির্ধারণের ভার রয়েছে সরকারি আইনজীবী ভি এস আগরওয়ালের উপর। এই মামলার পরবর্তী দিন ২৩শে আগস্ট। পীযূষ আশা করছেন তারাই জয়ী হবেন। বর্তমানে সেভ লাইফের সহায়তায় ৪৫০০ জন পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেওয়া গেছে, আরও ২৫০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা তারা ভাবছেন। পীযূষ তাঁদের এই পরিষেবা হায়দরাবাদ ও বেঙ্গালুরুতে শুরু করার কথা ভাবছেন। পুলিশরাও নিজেদের সহায়তার জন্য স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ করছেন। সেভ লাইফ গত মাসে সফলতার মুখ দেখেছে, সুপ্রিম কোর্ট, সরকারকে এক আইন তৈরির দ্বায়িত্ব দিয়েছে। আরটিআই প্রয়োগ করে সেভ লাইফ গাড়ি করে রড নিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে পেরেছে, রড নিয়ে যাওয়ার সময় এগুলি প্রায় ১ থেকে ২ মিটার বেরিয়ে থাকে যা থেকে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ১০টি রাজ্যে ৩৭০৭ জন এই ধরনের দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। প্রায় সব দেশেই আপতকালীন পরিষেবার জন্য বিশেষ একটি নম্বর থাকে, কিন্তু ভারতে সে রকম কিছু নেই। তাই সেভ লাইফ, সরকারের সহযোগিতায় সেই ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে। যে নম্বর সরাসরি থানা বা হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। মহারাষ্ট্রে সেভ লাইফের করশূন্য নাম্বার হল ১৮০০, এটির নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র কোলাবাতে রয়েছে। হু, ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস্ট, অ্যাপোলো, ম্যাক্স ভারতী ও মেকমাইট্রিপ ইত্যাদি সংস্থা সেভ লাইফের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। এছাড়াও ব্যক্তিগত অনুদানও তারা পায়। পীযূষ আরও ভালোভাবে কাজ করার জন্য স্থানীয় অংশীদারের পরিকল্পনা নিয়েছেন। এছাড়াও তারা তাদের তথ্য গুলি প্রকাশ করার কাজ করছে। পিযূষ হয়তো তাঁর ভাই শিবমকে হারানোর যন্ত্রনা ভোলেননি, কিন্তু তাঁর কাজের মাধ্যমে কিছুটা শান্তি পেয়েছেন। যদি আপনি কখনও পথ দুর্ঘটনার সাক্ষী হন তাহলে মানবিক হয়ে সেই আহত মানুষটিকে সাহায্য করুন।