পিছিয়ে পড়া সহপাঠীদের শিক্ষক ১৩ বছরের অমন

পিছিয়ে পড়া সহপাঠীদের শিক্ষক ১৩ বছরের অমন

Wednesday September 09, 2015,

4 min Read

স্কুল শেষ হওয়ার ঘণ্টা বাজবে আর ছাত্রছাত্রীরা দুরদাড়িয়ে বেরিয়ে আসবে। পড়াশোনা অনেক হয়েছে, এবার একটু খেলা যাক। মোটামুটি সব শৈশব আর ছাত্রজীবন এমনটাই হয়ে থাকে। আমরা আজ যার সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করাব সেই অমন সিং কিন্তু একটু অন্যধরনের। বয়স মোটে তেরো। এই বয়সেই সে হয়ে উঠেছে চেঞ্জ-মেকার। বিএমসি'র (বৃহন্মুব্বই মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন) স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে অমন।মহারাষ্ট্রের মধ্যে সেরা ১০-এ জায়গা করে নিয়েছে সে। সেটা বড় কথা নয়। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পরে সহপাঠীদের নিয়ে লার্নিং সার্কেল চালায় অমন। শুধু সহপাঠী নয়. সেই লার্নিং সার্কেলে যোগ দেয় স্কুলের সঙ্গে সংযোগহীন আশপাশের বহু ছেলেমেয়ে।


সহপাঠীর  সঙ্গে অমন (ডানদিকে)

সহপাঠীর সঙ্গে অমন (ডানদিকে)


খাদি সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা অমন তাঁর বাবার সঙ্গে বরিভেলিতে থাকে।পরিবারের অন্যদের দেখাশোনার জন্য মা থাকেন গ্রামের বাড়িতে। মা'এর সঙ্গে তাই বছরে বারদুয়েকের বেশি দেখাই হয় না। লার্নিং সার্কেলের (এলসি) এই ধারণা তাঁদের দিয়েছেন মোহিনী পাণ্ডে-তাঁদের স্কুলেরই এক শিক্ষিকা। বরিভেলির একসার তালাও মিউনিসিপ্যাল স্কুলে গত দু'বছর ধরে অমনদের পড়াচ্ছেন মোহিনী। লার্নিং সার্কেলের শুরুটা সেখানেই। বিভিন্ন ।পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা এইসব ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা অন্য স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছেন মোহিনী। পড়ুয়াদের ভিতর থেকেই শিক্ষক তৈরি করা এবং স্থানীয় এলাকাগত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খোঁজা। সমস্যা যেমন রয়েছে, তার সমাধানও করতে হবে নিজেদের।


অমন (মধ্যিখানে), মোহিনী (ডানদিকে)

অমন (মধ্যিখানে), মোহিনী (ডানদিকে)


ASER (Annual Status of Education Report)-এর ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে ২০১৪ সালে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে ভর্তির হার ক্রমবর্ধমান। গত ৬ বছরে এই বৃদ্ধির হার প্রায় ৯৬শতাংশ। এটা ভালো দিক হলে অন্ধকারও কম নয়। সরকারি স্কুলগুলিতে দেখা যাচ্ছে, ছাত্রছাত্রীরা খুব একটা শিখে উঠতে পারছে না। তাল মেলাতে পারছে না সিলেবাসের সঙ্গে। সরকারি স্কুল এবং প্রাইভেট স্কুলগুলির মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া সরকারি স্কুলগুলির ছাত্রছাত্রীদের শেখায় ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। অমন ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু বুঝতে পারেন, তাদের সহপাঠীদের মধ্যে বেশিরভাগই কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সিলেবাসের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। ফলে পড়াশোনায় তারা পিছিয়ে পড়ছে। মোহিনী বিষয়টি নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেই দীর্ঘ আলোচনা করেন। শেষপর্যন্ত ঠিক হয়, মেধাসম্পন্ন পড়ুয়ারাই পিছিয়ে পড়া সহপাঠীদের শেখানোর দায়িত্ব নেবে।তারাই নেবে শিক্ষকের ভূমিকা। এমনই একটি লার্নিং সার্কেল চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় অমন। যাতে সে তার সহপাঠী তথা স্কুল সংযোগহীন বন্ধুদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। অমন বলেন,'আমার সহপাঠীদের মধ্যে যারা পড়াশোনায় পিছিয়ে রয়েছে তাদের আর সহায়তার প্রয়োজন। এটা আমি বুঝতাম। এটাও বুঝতাম, শিক্ষকদের পক্ষে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে বিশেষ নজর দেওয়া সম্ভব নয়। মোহিনী দিদি আমাদের শেখান যে সমস্যার সমাধান নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে।তাই সহপাঠীদের জন্যই লার্নিং সার্কেলের দায়িত্ব নিতে আমি এগিয়ে আসি'।


image


শুরুটা হয়েছিল স্কুল থেকেই। মেন্টরের ভূমিকায় মোহনী আর শিক্ষকের ভূমিকায় কয়েকজন ছাত্র। দেখা গেল, ইংরেজি বলার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীরা উন্নতি করছে। অন্য বিষয়গুলিতেও ইউনিট পরীক্ষায় ভালো ফল মিলতে লাগল। আসলে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে গিয়েছিলেন মোহিনী। ভালো করে বুঝে নিয়েছিলেন তাদের সমস্যাগুলি। সেটাই সুফল দিতে লাগল। এবার আরও বড় আকারে। পার্শ্ববর্তী এলাকায় এমন বহু অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে রয়েছে যাদের সঙ্গে স্কুলের সংযোগ নেই। লার্নিং সার্কেল ডানা মেলল স্কুলের বাইরেও।এখানেও শিক্ষকের ভূমিকায় ছাত্রনেতারা। স্কুল ছুটির পরে প্রতিদিন দেড় ঘণ্টার পঠনপাঠন। সহপাঠী থেকে স্কুল সংযোগহীন অন্য পড়ুয়া, সবাই মিলিত হচ্ছেন কোনও একটি ফাঁকা জায়গায় বা শিক্ষকের বাড়িতে।যদি বিশেষ কারণে কোনও ছাত্রনেতা অনুপস্থিত থাকেন, তাহলেও স্কুল বন্ধ হয় না। সেক্ষেত্রে গ্রুপের অন্য কেউ সেই দায়িত্ব পালন করে।

কীভাবে চলে এই সার্কেল? অমনের কথায়,' গ্রেড লেভেল অনুযায়ী আমরা পড়ুয়াদের ছোট ছোট গ্রুপে ভেঙে দিই। যোগদানকারীদের প্রশ্নপত্র তুলে দেওয়া হয়। তারা উত্তর লেখে। এরসব সব ছাত্রনেতারা তা দেখে টেস্ট পেপার্স সেট করেন।সেই অনুযায়ী তৈরি করা হয় পড়ুয়াদের। দেখে নেওয়া হয় উন্নতির বহরটা। শুধু তাই নয়, অংশগ্রহণকারীরাও তাদের মতামত জানায়। ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যেকের গ্রেড লেভেল আমরা জানি। সেই গ্রেড লেভেল কীভাবে বাড়ান যায় সেটার দিকেই আমরা নজর দিয়ে থাকি'।

এভাবেই এগিয়ে চলেছে মোহনী পাণ্ডে-অমনদের লার্নিং সার্কেল। স্কুলের বাইরে এক অন্য স্কুল। যার যেখানে ঘাটতি তা পূরণ করা। বন্ধুর মতো শিখিয়ে দেওয়া ও নেওয়া। শিখছেন অমনরাও। বিশেষ সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েদের কোথায় সমস্যা, কী করলে সেই সমস্যা কাটবে তার উপায় খুঁজছেন তারা। বড় হয়ে কী হতে চাও?প্রশ্নটা করা হয়েছিল অমনকে। তার উত্তর সে রাজনীতিতে নামতে চায় এবং একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখে।বয়সের বিচারে অমনের স্বপ্নটা হয়তো বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু কিছু করতে গেলে স্বপ্ন তো দেখতেই হয়।