শিব ঠাকুরের দয়ায় ১২০ কোটির ব্যবসা আমিশ ত্রিপাঠির

শিব ঠাকুরের দয়ায় ১২০ কোটির ব্যবসা আমিশ ত্রিপাঠির

Thursday November 23, 2017,

4 min Read

একটা দুটো নয় জনা কুড়ি কি তার বেশি সংখ্যক প্রকাশকের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। কেউ তার বই ছাপতে চায়নি। মুখের ওপর সপাটে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ মনেই করেনি তার লেখা বই বাজারে বিক্রি হতে পারে। আর আজ আমিশ ত্রিপাঠি সব থেকে জনপ্রিয় লেখক। কীকরে সম্ভব হল এই আশ্চর্য যাত্রা শোনাচ্ছিলেন সেই কথা খোদ আমিশ ত্রিপাঠি।

image


আমিশের এখন আর মনেও পড়ে না প্রত্যাখানের সংখ্যাটা। বলছিলেন সংখ্যাটা অনেক, প্রায় নাম জানা সব প্রকাশকই তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো। কেউ লেখা পড়ে। কেউ না পড়েই শুধু লেখার বিষয় শুনে ভেঙচি কেটেছিল। এ হেন প্রত্যাখানে ভেঙে তো পড়েনইনি বরং আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন আমিশ ত্রিপাঠি। 

বলছিলেন, প্রথম বই ইমমর্টাল্‌স্‌ অব মেলুহা নিজেই ছাপান। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ৪ লক্ষেরও বেশি বিক্রি হয়েছে বইটি। ১২০ কোটি টাকার আমিশ অ্যান্ড কোম্পানি মাথা তুলেছে। মুম্বাইয়ের ফ্ল্যাটে ১২ জনের টিম কাজ করছে। ক্রমাগত তৈরি হচ্ছে একের পর এক আইডিয়া। 

অনুবাদের কাজ চলছে। তামিল, হিন্দি, বাংলা, ওড়িয়া, গুজরাটি, অসমিয়া, মালয়ালাম, মারাঠি, কন্নড়, স্প্যানিশ, পুর্তুগিজ, ইন্দোনেশিয়ান, পোলিশ, দেশ বিদেশের নানান ভাষায় অনুবাদ চলছে। মেলুহায় থেমে নেই। একের পর এক বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০১০ এর গোড়ায় শিব গাঁথার প্রথম খণ্ড The Immortals of Meluha প্রকাশিত হয়। সিরিজের দ্বিতীয় বই The Secret of the Nagas প্রকাশিত হয় ২০১১-র অগাস্টে। তৃতীয় খণ্ড The Oath of the Vayuputras বেরোয় ২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে। শিবের নানান গল্প নিয়ে লেখা এই তিনটি খণ্ড। দেশের অন্যতম প্রোডাকশন হাউজ Dharma Productions ২০১২ সালে The Immortals এর মুভি সত্ত্ব কিনে নেয়। সেই সত্ত্ব শোনা যাচ্ছে ইতিমধ্যেই হাতবদল হয়ে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত পরিচালক সঞ্জয়লীলা বনসালীর কাছে চলে এসেছে। এ বছরের অগাস্টে অমিশের প্রথম নন ফিকশন Immortal India প্রকাশিত হয়েছে।

২০১৫ সালে অমিশের লেখা রামচন্দ্র সিরিজের প্রথম বই Scion of Ikshvaku বেস্ট পপুলার বই হিসেবে Crossword Book Award পায়। রামায়নের কাহিনি নিয়ে এই উপাখ্যান কয়েকটি সিরিজে প্রকাশিত হচ্ছে। ফোর্বসের সেরা ১০০ জন ভারতীয়র তালিকায় পরপর চারবার জায়গা পেয়েছেন অমিশ।

ফলে অতি প্রত্যাখ্যাত ইমমর্টাল্‌স‌্ অব মেলুহা ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। দুসপ্তাহে বেস্ট সেলারের তালিকায় ঠাঁই পাওয়ার আনন্দই ছিল অন্যরকম। সাধারণ পাঠক থেকে নবীন প্রজন্ম সকলের নজর কেড়েছে। পুরানের কাহিনির প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। শুধু তাই নয় এই একটি বই ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমিশের বই পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন অনেক সৃজনশীল মানুষ। পুরাণের চরিত্রগুলি নিয়ে একের পর এক কাহিনি নতুন করে উঁকি দিয়েছে শিল্পের নানান অঙ্গনে। ভারতীয় টেলিভিশনের পর্দা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শিব দুর্গা কালী কৃষ্ণ আর নানান সব পৌরানিক কাহিনি।

আমিশ থিতিয়ে যাওয়া পুরানের কাহিনিগুলো নিয়ে শুরু করেন নতুন করে জারণের কাজ। নতুন করে আবিস্কারের আনন্দে একের পর এক কাহিনি প্রকাশিত হতে থাকে। জানা না জানা একের পর অনুষঙ্গ গল্পের রসে চুবিয়ে পাঠকের প্লেটে সাজিয়ে দেওয়ার আনন্দ উপভোগ করতে থাকেন আমিশ। সমালোচনাও শুনেছেন অনেক। কারণ পুরানের মান্যতা নিয়েই নানা মুনির নানা মত। বলছিলেন সব সমালোচনায় কান দেন না এই আই আই এম কলকাতার প্রাক্তনী। তিনি শুধু গঠনমূলক সমালোচনাকেই আমল দেন। কারণ তিনি মনে করেন এই ধরণের গঠনমূলক সমালোচনা তাঁকে সমৃদ্ধ করে। তিনি নতুন করে আরও জানার চেষ্টা করেন।

তাঁর বই বাজারে জনপ্রিয় করে তোলার জন্যে বিশেষ ধরণের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিলেন এমবিএ আমিশ। খোলামেলা ভাবে সেকথাও শেয়ার করলেন। বললেন শুধু লিখলেই যে হবে না, সেটা প্রকাশকের দরজায় দরজায় ঘোরার সময়ই টের পেয়েছিলেন। বই যে একটি প্রোডাক্ট এবং তার বাজারে বিক্রি হওয়াটা যে জরুরি সেটা জানতেন। তাই বই ছাপানোর কথা ভাবার প্রথম দিন থেকেই বিক্রির স্ট্র্যাটেজি কী হবে সেটাও ভেবে ফেলেন এই মেনেজমেন্টের ছাত্র। লেখালিখির আগে ১৪ বছর বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করেছেন। মূলত ফিনান্সিয়াল সেক্টরে, যেমন ডিবিএস ব্যাঙ্কে ছিলেন, আইডিবিআই ফেডারাল লাইফ ইন্সিওরেন্সে কাজ করেছেন। ফলে সাহিত্যের আবেগে ভেসে, পুরানের কাল্পনিক আকাশে উড়েও ব্যবসার মাটি থেকে পা টা সরাননি। বই বিক্রির জন্য‍ মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির হোমওয়ার্ক করে রেখেছিলেন ত্রিপাঠী।

The Immortals of Meluha স্টলে আসার সপ্তাহ খানেক আগে বইটির প্রথম চ্যাপ্টারের ছাপানো স্যাম্পেল কপি নিয়ে বইয়ের দোকানে দোকানে দিয়ে এসেছিলেন। দোকান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন বন্দোবস্ত করে এসেছিলেন যাতে ওইসব দোকানে যারাই বই কিনে কাউন্টারে বিল জমা দিতে যাবেন তাঁদের প্রত্যেককে ফ্রি স্যাম্পেল দেওয়া হবে। তাছাড়া ছোট বড় সমস্ত রিটেলারদের সঙ্গে নিজে গিয়ে গিয়ে কথা বলেছেন, নিয়মিত মেল অথবা ফোনে যোগাযোগ রেখেছেন। প্রথম বইয়ের প্রচারের জন্যে স্যোশাল মিডিয়াকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। তৌফিক কুরেইশির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে ট্রেলার ফিল্ম বানিয়ে ইউটিউবে আপলোড করেছেন। বাজারে নতুন লেখক, তাঁর প্রথম বইয়ের জন্যে এর চাইতে ভালো মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি আর কীই বা হতে পারত? এরপর আমিশের যত বই প্রকাশিত হয়েছে তার সবকটার মার্কেটিং ছিল এতটাই ব্যাপক। যেমন ধরুন দ্বিতীয় বই প্রকাশের আগে ভিডিও ট্রেলার বানিয়ে মাল্টিপ্লেক্সগুলিতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। শাহরুখ খানের রা-ওয়ান সহ সেই সময় রিলিজ হওয়া সব সিনেমার আগে বাজত সেই ট্রেলার। ২০১৩ সালে The Oath of the Vayuputras প্রকাশিত হওয়ার আগে Vayuputras নামে আস্ত একটি মিউজিক অ্যালবাম বানিয়ে ফেলেছিলেন। সনু নিগম, তৌফিক কুরেশি, পলাশ সেন, বিক্রম ঘোষের মত শিল্পীদের কাজ নিয়ে তৈরি হয়েছিল ওই অ্যালবাম। এটাই ছিল প্রথম কোনও অরিজিনাল সাউন্ডট্র্যাক যেটা বইয়ের সিরিজের জন্য তৈরি হয়েছিল।