ভারতকে চিনতে চিনতেই রাজীবের মুদ্রা ভাণ্ডার

ভারতকে চিনতে চিনতেই রাজীবের মুদ্রা ভাণ্ডার

Tuesday February 23, 2016,

4 min Read

"মুদ্রা রাক্ষস! আপনিও কি তাই মনে করেন? তবে যাই হোক, এক একটা মুদ্রার শরীরে লেগে থাকে জয়, পরাজয়, লজ্জা, ঘৃণা, লোভ, রিরংসা আর গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্রের কাহিনি। একথা অনস্বীকার্য। সুখকর মুহূর্তের যেমন সাক্ষী থাকে মুদ্রা তেমনি মুদ্রার জন্যেই অনেক লড়াই চাক্ষুষ করেছে ইতিহাস। হাজার হাজার বছর আগের কোনও ইতিহাস ঘাঁটতে চাইলে। সেই সময়কার মুদ্রার খোঁজ করুন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখুন। কারণ, মুদ্রার গড়ন দেখলেই বোঝা যায় তখনকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। বোঝা যায় সেসময় কীভাবে শাসন চলত।" এই সব বলছিলেন পুরাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ রাজীব বানু। ঠাকুমাকে কয়েন জমাতে দেখেছেন বটে, তবে হাজারো ইতিহাস ঘেঁটে, পুরাতত্ত্ব খুঁজে বেড়ালেও নিজে কোনওদিন কয়েন জমানোর কথা ভাবেননি। অথচ সেই রাজীবের সংগ্রহে এখন দু হাজারের বেশি নানা সময়ের, হরেক গড়নের রূপা, তামা, শীসাসহ নানা ধাতুর মুদ্রা। কীভাবে কয়েন সংগ্রহে উৎসাহ সেই গল্প শোনাচ্ছিলেন রাজীব। সংগ্রহের কয়েন দেখাতে দেখাতে তারই কিছুটা শোনা গেল এই পুরাতত্ত্ব গবেষকের মুখে।

image


সেবার কাজ করতে গিয়েছিলেন উত্তর ভারতে। তখনই বুঝতে পেরেছিলেন ইতিহাস খুঁজে বের করতে কতটা অনুঘটকের কাজ করে মুদ্রা। সেই শুরু। কয়েনের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে ক্রমশ। ‘গান্ধার, কুন্তলা, কাশি, কোশলা, কুরু, মগধ, পাঞ্চাল, শাক্য, অবন্তী, সুরাসেনা, সৌরাষ্ট্র, বিদর্ভ ছাড়াও আর অনেক ছোট ছোট জনপদ ছিল প্রাচীন ভারতে, যার মধ্যে গান্ধার, কাশি, কোশলা, অবন্তী, মগধ, সৌরাষ্ট্র, সুরাসেনা ও বঙ্গ জনপদের একাধিক মুদ্রা তাঁর সংগ্রহে রয়েছে। তার পরবর্তী সাম্রাজ্য, যেমন মৌর্য, এরান-বিদিশা, কৌশাম্বীর মগ, পাঞ্চালা, উজ্জয়িনী প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচলিত তামার মুদ্রা এবং তাদের ভগ্নাংশও সংগ্রহ করেছেন। তারপর বিদেশি শক্তি যখন ভারত দখল করে, এবং তাদের মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। ব্যাট্রিয়, ইন্দো-গ্রীক, ইন্দো-সিথিয়ান, ইন্দো-পার্থিয় মুদ্রার প্রচলন শুরু হয় ভারতে, এদের কিছু কিছু শাসকের মুদ্রা যেমন আজেস ১, অ্যাপোলোটোডস ১, গন্ডোফারেস ১, ব্যাট্রিয়ঃ আওল দ্রাকমা, ম্যানন্ডার ১ প্রভৃতিও সংগ্রহ করে ফেলেছেন। তাই রাজীবের মুখে চওড়া হাসি।

সংগ্রহে রাখা মুদ্রার গল্প শোনাতে গিয়ে কখন যেন ইতিহাসে ডুব দিলেন। বলছিলেন, ‘এরপর চিনের এক ভ্রাম্যমান উপজাতী ভারতের উত্তর সীমান্তে এসে বসতি স্থাপন করে। এদের একটি শাখা কিউ-সুয়াং (কুশান) ইন্দো-পার্থিয়দের পরাজিত করে এবং ভারতে বিশাল কুশান সাম্রাজ্য স্থাপন করে। এদের রাজাদের মধ্যে কুলুজ কদফিসেস, ভীমা কদফিসেস, কানিষ্ক, হুবিষ্ক, বাসুদেবদের সময়কার কিছু মুদ্রা এবং কৌশাম্বী, যৌদ্ধেয়, তক্ষশীলা, গুপ্ত, হুণ, সাসান, গাধিয়া, প্রতিহার রাজবংশের মুদ্রাও আছে আমার সংগ্রহে’, বলে চলেন রাজীব।

কথায় কথায় জানা গেল ইদানীং রাজীব ডুবে রয়েছেন পাঞ্চাল রাজ্য এবং পশ্চিম ক্ষত্রপের মুদ্রা নিয়ে গবেষণায়। ‘পাঞ্চালদের রাজ্যপাট কবে থেকে শুরু তার সঠিক সময় ও শাসকদের ক্রম জানা এখনও সম্ভব হয়নি বলে তাদের পরিচয় নিয়ে নানা মত আছে। গবেষক কে. এম. শিমালির মতে, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ থেকে ১২৫খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এদের মুল ধারাটি চলে। এরপর কুষাণ সাম্রাজ্যের উত্থানের সময় এই রাজ্য সম্বন্ধে কিছু জানা যায়নি। তবে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাঞ্চাল রাজবংশকে আবার প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। পাঞ্চাল রাজ্যে প্রতিটি শাসকের মধ্যে একই ধরণের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। এই মুদ্রাগুলিতে লিখিত ব্রাহ্মী লিপি পাঠোদ্ধার করে প্রায় ২৬জন শাসকের নাম জানা যায় - অগ্নিমিত্র, অনামিত্র, অশ্বমিত্র, ভানুমিত্র, ভদ্রঘোষ, ভুমিমিত্র, দমগুপ্ত, ধ্রুবমিত্র, ইন্দ্রমিত্র, জয়াগুপ্ত, জয়ামিত্র, ফাল্গুনীমিত্র, প্রজাপতিমিত্র, রুদ্রগুপ্ত, রুদ্রঘোষ, শিবগুপ্ত, শিবনন্দীন, শ্রীনন্দী, সূর্যমিত্র, বঙ্গপাল, বরূণমিত্র, বাসুসেনা, বিষ্ণুমিত্র, যজ্ঞপাল, যুগসেনা এবং অচ্ছুত। এই শাসকের মুদ্রাগুলির একদিকে তিনটি প্রতীক চিহ্ন এবং তার নিচে শাসকের নাম লেখা থাকত। আর মুদ্রার উলটো দিকে থাকত দেবদেবী মূর্তি অথবা দেবদেবীর নাম বোঝাই প্রতীক চিহ্ন। এই সিরিজের মুদ্রা আমার সংগ্রহে রয়েছে প্রায় ৫০০টি। তাঁর মধ্যে বেশ কিছু শাসকের প্রতিটি মুদ্রার ভগ্নাংশও আছে। নামবিহীন দুর্লভ কিছু পাঞ্চাল মুদ্রাও রয়েছে আমার সংগ্রহে’, গল্প করছিলেন তরুণ গবেষক।

‘পশ্চিম ভারতের সাতবাহন রাজাদের ইতিহাস পড়তে পড়তে এই বংশের সমসাময়িক শক রাজবংশের ইতিহাস জানার তাগিদে শুরু করি পশ্চিম ক্ষত্রপ নামক শক রাজবংশ নিয়ে পড়াশোনা। প্রথম শতাব্দী থেকে শুরু করে ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পশ্চিম ভারতের মালব ও সৌরাষ্ট্রে (বর্তমান গুজারাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশ) রাজ্যপাট চালিয়েছে এই রাজারা। এই রাজবংশ ক্ষহর্ত এবং কর্দমক নামক দুটি শাখায় বিভক্ত। প্রথম শাখায় ৩ জন ও দ্বিতীয় শাখায় ২৮ জন শাসক শাসন করেছিলেন। এই রাজবংশের অধিকাংশ শাসকের একাধিক রুপোর মুদ্রা, এবং বিভিন্ন পরিমাপের বেশ কিছু শীসার মুদ্রা আমার সংগ্রহে আছে’, সংগ্রহের হিসেব দিচ্ছিলেন রাজীব।‘প্রাচীনকাল সোনা ছিল ভারতে সহজলভ্য। সেই সোনা রপ্তানি করে ভারতে আসত রূপো। হয়তো সেই জন্যই প্রথম যুগে ভারতের মুদ্রাগুলি ছিল রুপোর। এই রূপো গলানোর পর পিটিয়ে, তাতে একাধিক ছাপ দিয়ে তৈরি হত মুদ্রা। এইগুলি “পাঞ্চ মার্কড কয়েন” নামে পরিচিত। মুদ্রাগুলিতে সূর্য, পাহাড়, গাছ, হাতি, ষাঁড়, শরীসৃপ, নারী-পুরুষ, ময়ূর ছাড়াও ব্যাবহার করা হয়েছে বিভিন্ন জ্যামিতিক রেখাচিত্র’, তখনও গল্পে বুঁদ পুরাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ।

বাংলার পুরাতত্ত্ব নিয়েই ওঁর মৌলিক আগ্রহ। তাও আশৈশব। সম্প্রতি ভারত চিনতে চিনতে ঢুকে পড়েছেন এক বিশাল ইতিহাসের স্রোতে। সেখানে জিজ্ঞাসা, আবিস্কার আর অনুমানের এক অসামান্য মিলন উপভোগ করছেন। তবে সংগ্রহ বাঁড়াতে গিয়ে কখনও বিনিময়ে বিশ্বাস করেননি রাজীব। সংগ্রহের বহর ক্রমশ বাড়ছে। নিজের বাড়িটাই এখন ছোটখাটো সংগ্রহশালা। তাতে অবশ্যই কারও হাত লাগানোর অনুমতি নেই। নিজেই সাজিয়ে গুছিয়ে রাখেন বাড়ির একটি কামরায়। দু বছরের পুত্র সন্তান এখনই আধো আধো বোলে কয়েন বলে বটে, তবে রাজীবের ইচ্ছে ছেলে আগ্রহী না হলে কোনও সংগ্রহশালার হাতে তুলে দেবেন তাঁর এই অমূল্য ভাণ্ডার। গবেষণার স্বার্থে আরও অনেক প্ল্যান মাথায় ঘুরপাক খায় ওঁর। একটি ভার্চুয়াল সার্ভারে স্বযত্নে সংগ্রহের কয়েনের একটি ক্যাটালগও বানিয়ে রাখছেন রাজীব। সেটাও দীর্ঘদিন ধরেই একটু একটু করে এখন অনেকটা। তবে সেখানেও প্রবেশ অবাধ নয়।