টলি পাড়ার ভরতবাবু আজ জিরো থেকে হিরো

টলি পাড়ার ভরতবাবু আজ জিরো থেকে হিরো

Wednesday October 07, 2015,

4 min Read

চোদ্দ বছর বয়স থেকেই লড়াই শুরু। ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানে কাজ করতেন। তারপর এঁকেবেঁকে সেই চলার রাস্তাটা গিয়ে উঠল টলিউডের স্টুডিও পাড়ায়। বাহাত্তরে পৌঁছেও তিনি ক্লান্ত নন। ভরত বাগ। টলিউডের সবাই তাঁকে এক ডাকে চেনেন। 

সত্তরের দশকের 'অমানুষ', 'অনুসন্ধান থেকে' শুরু করে হাল আমলের 'পিকু'। টালিগঞ্জের সমস্ত বড় শুটিংয়ে জেনারেটর সাপ্লাই করেন ভরতবাবুর কল্যাণী এন্টারপ্রাইজ। আক্ষরিক অর্থেই এটি তাঁর 'জিরো' থেকে 'হিরো' হওয়ার কাহিনি।

image


আজ থেকে বহু বছর আগের কথা। দেশ তখনও স্বাধীন নয়। সন ১৯৪৩। নোদাখালির এক কৃষক পরিবারে জন্ম ভরত বাগের। বাবা, মা, সাত ভাই, এক বোনের সংসার। পড়াশুনো করার সামর্থ্য যে তাঁদের নেই তা খুব অল্প বয়সেই টের পেয়েছিলেন। বড় হয়ে কী করবেন জানতেন না। শুধু জানতেন বাবা, দাদাদের মতো মাঠে গিয়ে চাষবাস তাঁর কম্ম নয়। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছেই মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে নোদাখালির কিশোর ভরত বাগকে টেনে আনে কলকাতায়। বছর তিনেক একটি ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানে কাজ করেন। সেখানেই জেনারেটর এবং বিভিন্ন ধরণের আলোর খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানতে শেখা। তবে দোকানের কাজ তাঁর ভালো লাগেনি। কয়েক বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা আর সঞ্চিত কিছু অর্থ। একে সম্বল করেই নিজের ব্যবসা শুরু করলেন। ১৯৬১ সালে ৫১বি মহিম হালদার স্ট্রিটে খুলে বসলেন ভরত ইলেক্ট্রনিক্স। কাজের পাশাপাশি তাই সংসার পাতার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। ১৯৭৫ সালে কল্যাণী মণ্ডলের সঙ্গে বিয়ে হয় ভরতবাবুর।

ভরত ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যবসার আয়তন বাড়ছিল। যে উদ্দেশ্যে একদিন ভরত বাগ কলকাতায় এসেছিলেন তা সফল হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। কাজের সূত্রে নানা ধরণের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হতে শুরু হল। এই সময় ভরতবাবুর সঙ্গে আলাপ হয় টলি পাড়ার গণেশ দা-র। এই গণেশ দা-র হাত ধরেই প্রথমবার স্টুডিওপাড়ায় আসেন ভরতবাবু। এত আলো। এত ঝলমলে তারকা খচিত টলিউড তখন গোটা দেশের সিনেমাওয়ালাদের পাখির চোখ। উত্তম-সুচিত্রা-শর্মিলা-সুপ্রিয়া কে নেই, স্টুডিও পাড়া তখন গমগম করত।

সেই পরিচয়ের সূত্রেই শুটিংয়ে জেনারেটর সাপ্লাই করতে শুরু করেন ভরত ইলেক্ট্রনিক্স। ভরতবাবুরও টালিগঞ্জে যাতায়াত বাড়তে থাকল। খুব অল্পদিনেই স্বভাবগুণে বহু মানুষর সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল তাঁর। বিভিন্ন ছবিতে জেনারেটর সাপ্লাইয়ের কাজ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকল ছবির আলোকসজ্জার কাজও। সেই সময় ভ্রান্তি বিলাস, শতরঞ্জ কে খিলাড়ির মতো ছবিতে লাইটিং-ও করেছেন ভরত বাগের এন্টারপ্রাইজ।

সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বহু বড় ছবির কাজ করেছে তাঁর কোম্পানি। দায়িত্ব সামলেছেন Hope 86-এর মতো বড় অনুষ্ঠানের। এই অনুষ্ঠানের সূত্রেই মুম্বই, কলকাতার নামজাদা প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পপতিদের সঙ্গেও আলাপ হয় ভরত বাগের। তাঁদের বাড়ির অনুষ্ঠান থেকেও ডাক আসতে থাকে। 'তবে একটা অনুষ্ঠান এখনও মনে থেকে গেছে। ৯০-এর দশকে ভিক্টোরিয়ায় হওয়া মিত্তলদের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান। তাতে আমরা জেনারেটর সাপ্লাই করেছিলাম। শাহরুখ খান এসেছিলেন। তখনকার দিনে ওই মাপের অনুষ্ঠান ভাবাই যেত না।' বললেন ভরতবাবু।

তবে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকেই ব্যবসায় নানা সমস্যা দেখা দিল। ইউনিয়নের দাদাগিরিতে ভণ্ডুল হতে থাকল কাজ। ব্যবসাও মার খাচ্ছিল। ২০০১ সালে শ্রমিক ইউনিয়নের অশান্তির জেরেই ভরত ইলেক্ট্রনিক্সের গেটে তালা ঝুলল। চল্লিশ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ল। ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি পর্যন্ত আর ফিরে পেলেন না। খুব অল্প বয়স থেকে কষ্ট করে নিজের চেষ্টায় বড় হয়েছেন ভরত বাগ। অভিজ্ঞতাই তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আটান্ন বছর বয়সে এসেও তাঁকে ফের শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে ঘর খোঁজা শুরু করলেন। প্রথমে সতীশ মুখার্জী রোড, তারপর আজাদগড়, তারপর কিছুদিন নিজের বাড়ি থেকেই ছোটখাটো কাজ করতে লাগলেন। আর্থিক সমস্যা তো ছিলই। ভরত ইলেক্ট্রনিক্স আচমকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আগে থেকে বরাত নিয়ে রাখা বহু শুটিং, অনুষ্ঠানে জেনারেটর পাঠাতে পারেননি। তাই নতুন কোম্পানি খুললে পুরনো জায়গাগুলি থেকে আর অর্ডার আসবে কিনা তা নিয়েও সংশয় ছিল। ব্যবসার খাতিরে হওয়া পুরনো সম্পর্কগুলো ফের ঝালিয়ে নেওয়ার কাজও শুরু করলেন। অবশেষে মাস ছয়েক পর, ২০০১ সালেই নিজের স্ত্রীর নামে নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন ভরত বাগ। নাম দেন কল্যাণী এন্টারপ্রাইজ'।

image


নতুন জায়গায় একেবারে অত্যাধুনিক মানের জেনারেটর এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন ভরতবাবু। 'নিজে গিয়ে মুম্বই থেকে জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিলাম। আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন মুম্বইয়ের এক জেনারেটর ব্যবসায়ী, আরিরাজ দমন। কাজের সূত্রেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। কল্যাণী এন্টারপ্রাইজের শুরুর দিনগুলিতে তাঁর সাহায্য ছাড়া এগোনো মুশকিল হত।' কৃতজ্ঞতার সুরে জানালেন ভরত বাগ।

নতুন করে শুরু করতে হলেও পুরনো জায়গা ফিরে পেতে ভরতবাবু সময় লাগেনি। তবে আগের সংস্থার ক্ষতি তাঁকে অনেক সতর্ক করে দিয়েছিল। ভরতবাবু বলেন, 'আর কোনওদিন স্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ করব না ঠিক করে নিয়েছিলাম। এখন আমার সঙ্গে কাজ করে শ্যালক নিমাই মণ্ডল এবং ম্যানেজার স্বপন তালুকদার। অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে চুক্তিতে কাজ হয়। এই ভালো।' নিজের সংস্থার সব খুঁটিনাটি বাহাত্তর বছরের ভরত বাগের নখদর্পণে। এখনও বিভিন্ন ইভেন্ট,পার্টির পাশাপাশি মেগাসিরিয়াল, রিয়্যালিটি শো, ফিল্মে জেনারেটর দেয় তাঁর সংস্থা নিজে কোমরে হাত দিয়ে সব সরেজমিনে তত্ত্বাবধান করেন। 

অনেক বছর ধরে শুধুই পরিশ্রম করে চলেছেন। চড়াই উতরাই পেরিয়েছেন। কয়েকবার প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার মুখোমখি হয়েও বেঁচে ফিরেছেন। প্রত্যেকটা অভিজ্ঞতাই তাঁর মনের জোর আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বার্ধক্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগিয়ে চলেছেন বাহাত্তরের এই তরুণ। ভাবটা এমন বয়স হয়েছে, টলিপাড়ায় যাতায়াত কমেছে, তাবলে পিছিয়ে থাকব কেন, এখনও ইন্ডাস্ট্রির খুঁটিনাটি খবর রাখেন ভরত বাগ। আর ভরতের খবর রাখে গোটা টলিউড পাড়া।