নিষিদ্ধপল্লী থেকে ৩,৫০০ মেয়েকে সমাজে ফিরিয়েছেন সুনীতা

নিষিদ্ধপল্লী থেকে ৩,৫০০ মেয়েকে সমাজে ফিরিয়েছেন সুনীতা

Wednesday May 25, 2016,

6 min Read

সুনীতা কৃষ্ণণকে অনেকেই চেনেন। টেড টকে অনেকেই শুনেছেন ওর কথা। আজ ইওরস্টোরি বাংলার পাতায় আমরা পড়ব ড. সুনীতা কৃষ্ণণের কাহিনি। ১৫ বছর বয়সে গণধর্ষিতা হয়েছিলেন। কিন্তু নিজেকে গুটিয়ে রাখেননি। নিজের গায়ে কখনও লাগতে দেননি ‘গণ ধর্ষণের শিকার’ এই তকমা। বরং নিজেকে বলেন Rape Survivor, অদম্য সাহস আর আত্মবিশ্বাসে ভর করে সুনীতা প্রায় সাড়ে তিনহাজার মহিলাকে দেশের বিভিন্ন নিষিদ্ধপল্লীর অন্ধ গলি ঘুপচি থেকে উদ্ধার করেছেন।

image


বলছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। যাদেরকে টেনে বের করে এনেছেন এই অন্ধকার বলয় থেকে তাদের মধ্যে যেমন রয়েছে তিন বছর বয়সের বাচ্চা তেমনি আছেন ষাটোর্ধ মহিলা। যৌন নিপীড়ণ দমনের যে কঠিন লড়াই গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে লড়েছেন তাতে গোটা দেশ স্তম্ভিত।

আটবছর বয়সে মানসিক ভারসাম্যহীন শিশুদের নাচ শিখিয়েছেন। বয়স যখন বারো বস্তির বাচ্চাদের জন্যে খুলেছেন স্কুল। পনের বছর বয়সে দলিত এবং পিছিয়ে থাকা মহিলাদের অধিকার নিয়ে লড়তে গিয়ে গ্রামের উচ্চবর্ণের পুরুষদের দ্বারা গণ ধর্ষিতা হয়েছেন। আটজন মিলে তাঁকে ধর্ষণ করেছে। তাঁর কাজ তাঁর ভাবনা তাঁর সদিচ্ছাকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে ধর্ষকরা। কিন্তু দমে যাননি ১৫ বছরের সেই কিশোরী।

তিনি গণধর্ষিতা তাই তাঁকে একঘরে করে দিয়েছিল তাঁর প্রতিবেশিরা। তাঁর প্রতি পরিবারের লোকজনের আচরণও বদলে গিয়েছিল। তাঁকেই উল্টে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল সমাজ। এই ঘটনার পর টানা তিন মাস নিজের সঙ্গে লড়াই করেছেন। নিজেকে বুঝিয়েছেন। ধুলো ঝেড়ে উঠে, লড়েছেন যে কোনও যৌন নিপীড়ণের বিরুদ্ধে। নিজের পরিচয় গোপণ করেননি। বরং নিজের জীবনের কঠিন সত্যটাকেই সামনে দাঁড় করিয়ে গোটা দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছেন যারা তাঁকে ধর্ষণ করেছিল তারা তাঁকে দমিয়ে দিতে পারেনি। এটা তাঁর লজ্জা নয়। সমাজের লজ্জা।

মহিলাদের ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হিসেবে গড়েছেন প্রজ্জ্বলা নামের একটি সংস্থা। এই সংস্থার হাত ধরেই বদলে গিয়েছে হাজার হাজার মহিলার জীবন।

যখন বয়স ষোলো। ততদিনে জীবন দেখার ভঙ্গিমাটা বদলে গিয়েছিল সুনীতার। ভাবনা, চিন্তা, স্বপ্ন সব ছিল অন্যরকম। দিনে কলেজ তো নিশ্চয়ই যেত। কিন্তু রাত হলে চলে যেত নিষিদ্ধপল্লীতে। দেহ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মেয়েদের জীবনের সংকটগুলোই ঠাহর করার চেষ্টা করত। সুযোগ পেলেই কথা বলত ওদের সঙ্গে। কী করে এই চক্রব্যুহ থেকে ওদের বের করে আনা যায়, স্বাধীন মুক্ত আলোকিত পৃথিবীতে ওদের ফিরিয়ে আনা যায় সেই ভাবনাই ছিল সুনীতার। কতবার দালালদের চক্করে পড়েছেন। পতিতাপল্লীর মাসীদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েছেন। মার খেয়েছেন। তবু দমে যাননি। নিষিদ্ধপল্লীতে বন্দি মেয়েদের মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে স্থির ছিলেন সুনীতা। এভাবেই একবার ব্যাঙ্গালুরুর একটি নিষিদ্ধপল্লীতে ঢুকে পড়েন। সেখানে দেখা হয় বারো তের বছরের একটি মেয়ের সঙ্গে। মানসিক ভারসাম্যহীন। উঠোন জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারা শরীরে ক্ষতচিহ্ন। স্কার্ট ব্লাউজ পরা। ব্লাউজ থেকে উঁকি মারছে দশটাকার নোংরা একটা নোট। টাকা দিয়ে কী হয় সে জানে না। চোখে মুখে ভাবলেশ হীন। ওই বাড়ির যিনি কর্ত্রী তিনি এবার নিজে থেকেই বললেন সুনীতাকে, তুমি যদি সত্যিই মেয়েদের মুক্তি দিতে চাও তবে সবার আগে এই মেয়েটিকে দাও।

শুরু হল লড়াই। সুনীতা এর আগে মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েদের সঙ্গে কাজ করেছেন। ফলে ওই মেয়েটির কাছ থেকে ওর গ্রামের নাম আন্দাজ করতে পারলেন সুনীতা। খোঁজ নিয়ে জানার চেষ্টা করলেন ওর বাড়ির লোকজনের ঠিকানা। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে কিছুই পেলেন না। কিন্তু দমে না গিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। সুনীতার বাবা রাজু কৃষ্ণণ। ভারত সরকারের সার্ভে ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন। বাবার অফিসের এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে একটি গাড়ি ধার নিলেন। প্রথমে গেলেন ওই নিষিদ্ধপল্লীতে। মেয়েটাকে তুললেন গাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে আরও চারপাঁচজন মহিলা ওই গাড়িতে উঠে পড়ল। ওই ছোট্ট মেয়েটাকে তার গ্রামে নিয়ে যাওয়ার এই কাজে সাহায্য করতেই এগিয়ে এল ওই চারপাঁচজন। সকলেই দেহব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সাহস আর নিজের প্রতি বিশ্বাস আরও বেড়ে গেল সুনীতার। কথা মতো ওই গ্রামে গিয়ে পৌছনর পর শুরু হল অন্য আরও এক লড়াই। জানা গেল ও ওই গ্রামেরই এক জমিদারের মেয়ে। সম্পন্ন পরিবার। কিন্তু কোনও এক পথ দুর্ঘটনায় ওর মা বাবা দুজনেই মারা যান। তারপর এক আত্মীয় ওদের সমস্ত সম্পত্তি কেড়ে নেয়। মেয়েটিকে ফেলে দেয় হাইরোডে। সেখান থেকে কেউ একজন মেয়েটিকে বেঙ্গালুরুর একটি নিষিদ্ধপল্লীতে বিক্রি করে দেয়।

এবার লড়াই ছিল গ্রামের পঞ্চায়েতের মারফত মেয়েটিকে তার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার। সেই লড়াই দারুণ ভাবে জিতলেন সুনীতা। সেই শুরু। আর সেই থেকে এখনও পর্যন্ত নিষিদ্ধপল্লী থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মহিলাকে উদ্ধার করে ফেলেছেন সুনীতা। এই সব মহিলাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন এইডস আক্রান্ত। কঠিন জটিল যৌন রোগে ভুগছেন। এইচ আই ভি পজিটিভ। আবার অনেকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। তাঁদের চিকিৎসার ব্যেবস্থা থেকে শুরু করে সামাজিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজটাই করেন সুনীতা।

কাজের ট্রেনিং দিয়ে এই সব মহিলাদের কর্মদক্ষতা বাড়িয়েছেন। বিভিন্ন কারখানায় কাজ করছেন এই সব মেয়েরা। কেউ ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করেন। কেউ বা রাজমিস্তিরি। কেউ অন্য হাতের কাজ শিখে সমাজে প্রতিষ্ঠার লড়াই লড়ছেন। কিন্তু সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল সুনীতা এবং তার প্রজ্জ্বলার প্রয়াস।

সুনীতা জন্ম থেকেই হাজার একটা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। বেঙ্গালুরুর একটি গরিব ঘরে জন্মেছেন। গোটা পরিবারে একমাত্র তাঁর বাবাই লেখাপড়া শিখেছেন। চাকরি করতেন। গোটা পরিবারের দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থা। বাবা মায়ের আদর পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু জন্মেছেন শারীরিক একটি অসুবিধে নিয়ে। পা বেঁকা। ঠিক ঠাক দাঁড়াতে পারতেন না। ফলে পরিবারের অন্য লোকজন এজন্যে সুনীতাকে খারাপ চোখেই দেখত। হাজার একটা মানা ছিল। খেলতে দেওয়া হত না। পায়ের অসুবিধের সঙ্গে লড়াই করেই বড় হয়েছেন সুনীতা।

সকালে গ্রামের যেই স্কুলে পড়তেন সেই স্কুলেই রাতে গরিব ঘরের বাচ্চাদের ডেকে এনে পড়াতেন। বারো বছরের এই বাচ্চার সমাজসেবার খবর ছড়িয়ে পড়তেই স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে পুরস্কৃত করে। এভাবেই বস্তির বাচ্চাদের স্কুল শুরু হয়। কিন্তু এখানেই থেমে না থেকে যত এগিয়েছেন সুনীতা তার কাছে পুরস্কারের মানে বদলে গিয়েছে। যত নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের উদ্ধারের কাজ করেছেন যত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়েছেন ততই তাকে আক্রান্ত হতে হয়েছে। সুনীতা বলছিলেন, এই সব আক্রমণগুলোই তার কাছে পুরস্কার। এতবার এত নৃশংস ভাবে মার খেয়েছেন যে ভালো করে ডান কানে শুনতেও পান না সুনীতা।

বলছিলেন এটা তার কাছে একটা প্যারামিটার। আক্রমণ মার এগুলোকে তাঁর মনে হয়েছে তার কাজের এক একটা ইন্ডিকেটর। শুধু কি গুণ্ডা মস্তানদের মার খেয়েছেন সুনীতা! মার খেয়েছেন পুলিশেরও। ১৯৯৬ সালে বেঙ্গালুরুতে মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতা চলাকালীন এই পতিযোগিতার প্রতিবাদ করেছিলেন। একদিকে এই সমাজে মেয়েদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চলে আর অন্যদিকে মেয়েদের পণ্য হিসেবে দেখানোর উৎসবও হয়। এই সমাজিক বৈপরিত্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন সুনীতা। আর তখনই তার ওপর নেমে আসে প্রশাসনের অত্যাচার। মাদক রাখার মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে সুনীতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। টানা ৬০ দিন হাজত বাস করতে হয়। এক পোশাকে। সেই দুর্বিষহ দিন গুলোতে জেল খানায় মহিলাদের ওপর অত্যাচার অপরাধের সরেজমিনে দেখে আসেন সুনীতা। জেল থেকে বেরনর পর তাঁর জন্যে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে সুনীতাকে বাধ্য হয়েই জন্মভূমি বেঙ্গালুরু ছেড়ে চলে আসতে হয় হায়দরাবাদ। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর প্রজ্জ্বলার কাজ।

এরপর থেকে হায়দরাবাদই হয়ে ওঠের তাঁর কাজের প্রধান শহর। ব্রাদর ওয়ার্গিসের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সুনীতা দলিত পীড়িত নারী জাগরণের কাজ চালিয়ে যান। বস্তির বাচ্চাদের শিক্ষিত করে তোলার কাজ করেন। হায়দরাবাদের নিষিদ্ধপল্লীর মেয়েদের মুক্তি দেওয়ার কাজ করেন। এখানেই গঠিত হয় তাঁর সংস্থা প্রজ্জ্বলা।

তাঁর সংগঠনের বিভিন্ন আন্দোলন দেশের পলিসি মেকারদেরও নতি স্বীকার করতে বাধ্য করে। স্বীকৃতি পেয়েছে তাঁর লড়াইও। কিছুদিন আগে পদ্মশ্রী সম্মানও পেয়েছেন সুনীতা কৃষ্ণণ।