না খেতে পাওয়া মানুষগুলোর নিজের লোক চন্দ্রশেখর

ইওরস্টোরি বাংলার পাতায় আপনারা রবিনহুডদের গল্প পড়েছেন। নিরন্ন মানুষের মুখে আহার তুলে দেওয়ার এক অনাবিল আনন্দ নিয়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা রবিনহুডদের কাহিনি পড়ে আমাদের সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করেন। তাঁরাও চান খাবার অপচয় বন্ধ করে নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে। নিরন্ন এই শব্দটি এখনও যাদের কষাঘাত করে না তাদের কথা হচ্ছে না। হচ্ছে এমন মানুষদের কথা, যারা আবেগে মানুষ এবং জীবনে মানবিক।

না খেতে পাওয়া মানুষগুলোর নিজের লোক চন্দ্রশেখর

Monday January 30, 2017,

3 min Read

এক মানবিক মাস্টারমশাইয়ের খোঁজ পেলাম। যিনি নিজেই এখন প্রতিষ্ঠান। দেশে বিদেশে রীতিমত শোরগোল ফেলে দিয়েছেন কেবল মাত্র তাঁর কাজ দিয়ে।

আমি বলি আমি চিনলাম কী করে, একদিন আমার কাছে একটি হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ এসেছিলো। সৌম্য দর্শন এক ভদ্রলোকের ডিপি থেকে। তাতে লেখা:-

“মাইথন, শীতকালে পিকনিকে জমজমাট, বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসেন। ছোট্ট রমেশ, ভুলভুলি, পরভীনরা এখন খুব ব্যস্ত পিকনিকের জন্য জল তুলতে, জ্বালানি যোগাড় করতে। কিন্তু এদের কোনও পিকনিক হয় না। এদের পিকনিক করব। সেদিন জল দেবো আমরা, খাবার দেবো আমরা, বাসন মাজবো আমরা, আর শিশুরা মাতবে আনন্দে।”
image


চিনে ফেললাম একটা মানুষ। নাম চন্দ্রশেখর কুণ্ডু। চাকরি সূত্রে থাকেন আসানসোল। আদ্যোপান্ত কলকাতার ছেলে। চিরকাল নরম মনের মানুষ। তাই বন্ধুও জুটে যায় সহজেই। বয়স চল্লিশ। নিউ আলিপুর কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যায় স্নাতক, পরে তথ্য প্রযুক্তিতে স্নাতকোত্তর করে আসানসোলের একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীদের কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয় এই শিক্ষককে লোকে এখন চেনেন একজন নেতা হিসেবে।

চন্দ্রশেখর বলছিলেন, 500 আর 1000 টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত আদৌ যুগান্তকারী কিনা সে নিয়ে বিতর্ক হয়েছে অনেক। কিন্তু খাদ্য ও খাদ্যশস্য অপচয় বন্ধ হলে খাবারের দাম যে সবার নাগালে আসবে ও দেশের অগ্রগতি হবেই, তাতে কোনও বিতর্ক নেই। ওরা এই ইস্যুতেই কাজ করছেন।

গত দুবছরে দেশে 21,963 মেট্রিক টন খাদ্য শস্য নষ্ট হয়েছে। চন্দ্রশেখর বলছেন এই পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে খোদ এফ সি আই দপ্তর থেকে। রীতিমত আরটিআই করে এই পরিসংখ্যান যোগার করেছেন চন্দ্রশেখর। এবং জানতে পেরেছেন এই খাদ্য শস্য নষ্ট হওয়ার কারণ সঠিক পদ্ধতিতে এফ সি আই সংরক্ষণ করতে পারেনি। আর এই খাদ্য শস্য নষ্ট না হলে প্রায় এক কোটি ছাত্রছাত্রীদের এক মাস ধরে মিডডে মিল খাওয়ানো যেত।
যে দেশে সাড়ে উনিশ কোটি মানুষ রোজ রাতে খেতে পায় না। অর্ধাহারে অনাহারে রোজ মানুষ মরে সে দেশে এই অপচয় চন্দ্রশেখরকে অবাক করে।

চিন্তিত উদ্বিগ্ন চন্দ্রশেখর খোদ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে ফেলেন। খাদ্য শস্য নষ্ট বন্ধ করার জন্য ও রান্না করা খাবার নষ্ট বন্ধের জন্য কোমর বেধে নেমে পড়েন এই কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষক। জন্ম নেয় একজন সত্যিকার সমাজকর্মী। রাজনীতির তোয়াক্কা না করে, কেবল মানুষের টানে নিজের অজান্তেই তৈরি করে ফেলেছেন মানবিক একটি সেনাদল। তৈরি হয়েছে সংগঠন। নাম দিয়েছেন ফুড এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (ফিড)।

সোশ্যাল মিডিয়াকে আশ্রয় করে জনচেতনা তৈরি করার কাজটা দারুণ করছেন চন্দ্রশেখর। একটা অন্তরায়, তিনি কাজের সূত্রে থাকেন কলকাতার থেকে অনেক দূরে। আর তাই কর্পোরেট দুনিয়ার কাছে পৌঁছনর অবকাশও সীমিত। তার মধ্যেই তিনি এবং তাঁর বারো তেরোজন স্বেচ্ছাসেবীর দল কামাল করে দিচ্ছে। তাঁর ফেসবুকের বন্ধুরাও তাঁর মিশনকে সফল করার জন্যে প্রচারে নেমেছেন।

চন্দ্রশেখর বলেন, রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লেখায় দারুণ কাজ হয়েছে। নড়ে চড়ে বসেছে ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া। পাশাপাশি জনচেতনা বাড়ানোর প্রয়াসও কাজে লাগছে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সংস্থার ক্যান্টিন। বিভিন্ন রেস্তরাঁ। অব্যবহৃত খাবারের পার্সেল দিয়ে চন্দ্রশেখরের মিশনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে চাইছেন ওরা। এই ফেব্রুয়ারি থেকে সিআইএসএফ তাদের ক্যান্টিনের বাড়তি খাবার দেবে চন্দ্রশেখরের সংস্থাকে। ইতিমধ্যেই ওলা রাজি হয়েছে ওদের লজিস্টিক পার্টনার হতে। দেশে বিদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে চন্দ্রশেখরের কাহিনি। যত লোক জানতে পারছেন চন্দ্রশেখরের নিঃস্বার্থ এই প্রয়াসের কথা, ততই বাড়ছে তার শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা। বাড়ছে দল।

image


কিন্তু কীভাবে চন্দ্রশেখর এলেন এই কাজে, জানতে চেয়ে পেলাম একটা বাবার পরিচয়। বছর দেড়েক আগে ওর ছেলের জন্মদিনে বাড়িতে প্রচুর খাবার নষ্ট হয়েছিল। সেই দৃশ্য ওকে জাগিয়ে দিয়েছে। তারপর শুরু হয় খাদ্য অপচয় নিয়ে পড়াশুনো। তথ্য যোগাড় করতে থাকেন বিভিন্ন জায়গা থেকে। আরও চোখ খোলে। আরও বিমর্ষ হয়ে পড়েন। সেখানেই থেমে থাকেননি। তৈরি করেন তিন মিনিটের একটা শর্ট ফিল্ম। যা বুঝেছেন, যা উপলব্ধি হল তাই সমাজের আর পাঁচটা মানুষকে বোঝাতে উঠে পড়ে লেগে পরেন আসানসোলের এই শিক্ষক। আরও আরও করে জড়িয়ে পড়েন ক্ষুধার্তের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার কাজে। আর এভাবেই সবার অলক্ষ্যে জন্ম নেয় একজন নেতা। একজন সামাজিক উদ্যোগপতি।