যারা অপমান করেছিল তাদের জবাব দিয়েছেন রেড্ডি সাহেব

যারা অপমান করেছিল তাদের জবাব দিয়েছেন রেড্ডি সাহেব

Wednesday June 01, 2016,

4 min Read

আজ আমরা এমন একজন মানুষের গল্প শুনব যিনি সরকারি ব্যবস্থার প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে দুদুবার সরকারি চাকরি ছেড়েছেন। যে কোম্পানিকে দাঁড় করাতে ঘাম রক্ত জল করেছেন সেখান থেকে গলা ধাক্কা খেয়েছেন। কিন্তু দমে যাননি। অসম্মানে, প্রতারণায় ভেঙে পড়েননি। বরং তারপর খুলেছেন তাঁর নিজের সংস্থা। গোটা দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি পারেন। ইচ্ছে আর সততা থাকলে গোটা পৃথিবী জয় করা যায়। জীবনদায়ী টিকা বানিয়ে রীতিমত বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছেন এই মানুষটি। নাম বড়প্রসাদ রেড্ডি।

image


একজন ইলেক্ট্রনিকাল ইঞ্জিনিয়র। বৈজ্ঞানিক। ভীষণ সৎ। দেশ এবং সমাজের প্রতি সমর্পিত। ভ্রষ্টাচার, বেইমানি, অন্যায়, প্রতারণায় তাঁর ভীষণ ঘৃণা। করদাতা আর সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত পয়সার লুট হতে দেখে বিরক্ত বিতশ্রদ্ধ হয়ে বার বার দুবার সরকারি চাকরি ছেড়েছেন। প্রথমে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি। পরে রাজ্য সরকারি চাকরি। এরপর আর চাকরি না করার মনস্থির করেন। সিদ্ধান্ত নেন উদ্যোমী হবেন, ব্যবসা করবেন। করলেনও তাই। ধুকতে থাকা একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন, দিন রাত্রি এক করে ডুবতে থাকা সংস্থাটিকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। দাঁড়িয়ে যায় তাঁর সংস্থা। গোটা বিশ্বে ওই সংস্থার সামগ্রী বিক্রি হয়। বাজারে একটা ব্র্যান্ডও তৈরি করে ফেলেন। দুর্দান্ত গুণগত মানের জন্যেই খ্যাতি ছড়িয়ে পরে। পুরস্কার পায়। কিন্তু যখনই সংস্থার আভ্যন্তরীন অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠান তখনই তাঁকে কোম্পানি থেকে ঘাড় ধাক্কা খেতে হয়। তাঁকে বেদখল করে দেওয়া হয়। যে মুমূর্ষু সংস্থাকে বাঁচিয়ে তুলতে এত মেহনত করেছেন নিজের সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ করেছেন সেখান থেকেই তাকে বের করে দেওয়ায় ভীষণ ধাক্কা খান। ভাবতে থাকেন, কী করবেন, কী করা উচিত। দিশাহীন হয়ে কখনও ভাবতেন এবার তাহলে চাকরিই খুঁজি আবার কখনও ভাবতেন, এবার বরং একটা নিজস্ব স্টার্টআপ খোলা যাক। এরকম দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় এই বৈজ্ঞানিক ভাবতে শুরু করেন এবার তাহলে গ্রামে চলে যাবেন। চাষাবাদ করবেন। এরকম দ্বৈরথের মধ্যেই এই বৈজ্ঞানিক জেনেভা গেলেন। একজন আত্মীয়ের সঙ্গে ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনে এক জন বিদেশি ভারতীয়দের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করেন। বলেন ভারতীয়রা ভিখিরি, ভিক্ষার বাটি হাতে পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে হাজির হয়। এই অসম্মান জনক মন্তব্যে গভীর মর্মাহত হন এই বৈজ্ঞানিক। কথা গুলো হৃদয়ে গেঁথে যায়। মনে মনে স্থির করেন, ভারত কী করতে পারে তার আসল শক্তি কোথায় সেটা তিনি বুঝিয়ে দেবেন। গোটা দুনিয়া দেখবে ভারতের ঐশ্বর্য। এরকম প্রতিশ্রুতি নিয়েই দেশে ফিরে আসেন। আর তৈরি করেন তাঁর সংস্থা। মা শান্তা রেড্ডির নামে নাম রাখেন সংস্থার। শান্তা বায়োটেকনিক্স। সাধারণ মানুষের জন্যে বানিয়েছেন জীবনদায়ী সম্পূর্ণ অর্গানিক টিকা। ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে গোটা দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছেন ভারতের মৌলিক ঐশ্বর্য। যা পেতে হাপিত্যেস করে বসে থাকে পশ্চিমি দুনিয়া। এই সংস্থা যে টিকা তৈরি করে তার মারফত গোটা দুনিয়ার বাচ্চার প্রাণঘাতী একটি রোগপ্রতিরোধ হয়। পশ্চিমি দু্নিয়ার বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সংস্থা এবং ক্রেতারা এই রোগপ্রতিরোধকারী টিকা নিজেদের সন্তানদের জন্যে সংগ্রহ করেছে। এর মাধ্যমেই ওই অপমানের উত্তর দিতে পেরেছেন এই বিজ্ঞানী। কম খরচে হেপাটাইটিস বি এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী অসুখের টিকা তৈরি করেছে রেড্ডি সাহেবের সংস্থা শান্তা বায়োটেকনিক্স। এর আগে এই সব টিকার খরচ পড়ত অনেক বেশি। বড়লোকেরাই তাদের বাচ্চাদের জন্যে এই টিকা কিনতে পারত। কিন্তু শান্তা বায়োটেকনিক্সএর দৌলতে সেই দামি টিকা আর দামি থাকল না। গরিব মানুষের নাগালে চলে এল। ফলে জীবন আরও সুরক্ষিত হল। এই টিকা তৈরি করা থেকে বাজারে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতে করতেই দাঁড়িয়ে গেলেন বরপ্রসাদ রেড্ডি। প্রচুর সম্মান পেতে থাকলেন। ২০০৫ সালে পেলেন জাতীয় মর্যাদা পদ্মভূষণ।

হায়দরাবাদে তাঁর বাসভবনে বসেই খোস মেজাজে নিজের জীবনের নানান গল্প বলছিলেন। একের পর এক প্রতারণার বিরুদ্ধে লড়াই, কূট জটিল ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়ার কাহিনির পাশাপাশি জেনেভার সেই সভার গল্পও বলছিলেন রেড্ডি সাহেব। বলছিলেন, হুয়ের সেই সম্মেলনের আগে তিনি নাকি হেপাটাইটিস নামটাই জানতেন না। নিজে ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়রিং পড়েছেন। ব্যবসায় আগ্রহ ছিল। ৯০ দশকের প্রথম দিকে দেশের যে পাঁচ কোটি শিশু এই রোগের শিকার আর চিনে সংখ্যাটা সাড়ে পাঁচ কোটি, এসব জানতেন না তিনি। জানলেন, দুটো দেশে এই টিকা তৈরি হয়। ফলে দাম বেশি। গরিবের জন্যে আকাশ কুসুম ছিল। কিন্তু ওই বিদেশির কথায় রীতিমত ইলেক্ট্রিক শক খেয়েছিলেন বরপ্রসাদ। যে বলেছিল ভারতীয়রা ভিখিরি এবং হাতে বাটি নিয়ে পশ্চিমি দেশে ভিক্ষে করতে আসে তার কথা গুলোয় এক ঝটকায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বরপ্রসাদের। ফিরে এসে তাই প্রতিজ্ঞা করেন এই টিকাই তৈরি করবেন এবং অহঙ্কারি পশ্চিম বিশ্বকে দেখিয়ে দেবেন ভারত কী দুর্দান্ত পারে। পশ্চিমবিশ্বের কাছে হাত পাতে না। আর আমাদের এই পারাটাই ওদের কোমরও ভেঙে দিতে পারে। এবং সেটা করেই দেখিয়ে দিলেন রেড্ডি সাহেব। ১৯৯৭ সালে বেরল হেপাটাইটিস বি-র টিকা। সম্পূর্ণ স্বদেশী। কম খরচে। গরিব মানুষের নাগালের ভিতর। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তাজ্জব বনে গেল পশ্চিমি দুনিয়া। তাঁর সংস্থার দুর্দান্ত সাফল্যের পর দেশেও বায়ো টেকনোলজি নিয়েও উৎসাহ বাড়ল।