পশ্চিমবঙ্গে মন্তেসরি বিপ্লব ঘটিয়েছেন কুসুম
Sunday September 13, 2015,
3 min Read
শিক্ষাবিদ, চিত্রগ্রাহক, শিল্পের গুণমুগ্ধ এবং জ্যোতিষী। ভাবতে অবাক লাগলেও এই সবকটি পরিচয়ই আসলে একজন নারীর। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মন্তেসরি ,'বাল নিলয়া' র চালিকাশক্তি তিনি। কুসুম ভাণ্ডারি। শহর কলকাতার একমাত্র কর্মরত মন্তেসরিয়ান।
'স্নাতক হওয়ার পর স্থানীয় একটি প্লে স্কুলে কাজ করার পাশাপাশি মন্তেসরি ট্রেনিং নিতে শুরু করি। সেই সময় ম্যাডাম মন্তেসরি অ্যাসোসিয়েশন এবং অ্যাসোসিয়েশন মন্তেসরি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিরা কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁদের কাছে একটি কোর্স করি। মারিও মন্তেসরির প্রতিনিধি মিস্টার উস্টেনের কাছে ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। কাজ শিখতে শিখতেই আমার হবু শাশুড়ি, যিনি বাল নিলয়ার প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর সঙ্গে পরিচয়। ১৯৭৬ সালের ঘটনা। ট্রেনিং শেষ হতেই বিয়ে হয়ে গেল। আর আমার হাতে এসে পড়ল বাল নিলয়ার দায়িত্ব।' বললেন কুসুম ভাণ্ডারি।
আজ যেখানে 'বাল নিলয়া' দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই জায়গাটিই বদলে দিয়েছিল কলকাতা শহরের প্রাথমিক শিক্ষার সংজ্ঞা। সত্তরের দশকে এই বাড়িতেই ম্যাডাম মন্তেসরির ছেলে মারিও মন্তেসরির পদধূলি পড়েছিল। একসময় স্কুলের দায়িত্বে থাকা কুসুমের শিক্ষকতা এবং শিশুমনকে বুঝতে শেখার হাতেখড়িও এখানেই। এগিয়ে চলার পথে এই শিক্ষাই যে তাঁর কাজে লেগেছে, তা অকপটে স্বীকার করেন কুসুম।
আজ কুসুম ভাণ্ডারি একজন নামকরা শিক্ষাবিদ, যিনি তাঁর জীবনের অধিকাংশই সমাজের সব স্তরের শিশুদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত করেছেন। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত এই কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার জোরেই আজ কুসুম একজন সৃজনশীল শিক্ষাবিদ এবং সুদক্ষ প্রশাসক। প্রি-প্রাইমারি স্তরে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও যে কম্পিউটারকে উপযোগী করে তোলা যায়, সেই ধারণা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। কুসুম একজন সুচিন্তক। মানবজীবনে শিক্ষার সুদূরপ্রসারী ভূমিকার কথা মাথায় রেখে বছর কুড়ি আগে UNESCO Club of Eastern India গড়ে তোলেন এই কুসুম ভাণ্ডারিই।
শুধুমাত্র একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেও কুসুমের নতুনকে জানার ইচ্ছে প্রবল। জীবনের অন্য অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর অবাধ বিচরণ। এক আত্মীয়ের ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলা শুরু করেছিলেন। তবে নেহাতই শখে তোলা সেই ছবিগুলিই প্রশংসা কুড়োতে লাগলো। নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস চলাকালীন তাঁর তোলা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির কয়েকটি ছবি, কীভাবে যেন জায়গা করে নিয়েছিল ইলাস্ট্রেটেড উইকলির পাতায়। এরপর হার্ভার্ড থেকে ফোটোগ্রাফি কোর্সও করেন কুসুম। কুম্ভমেলায় তোলা কিছু ছবি নিয়ে ১৯৮৫ সালে প্রথমবার একক প্রদর্শনী করেন কুসুম ভাণ্ডারি। পদাতিক হলে সেই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন। এরপর নানা বিষয় নিয়ে বহুবার প্রদর্শনী হয়েছে তাঁর ছবির। শ্যাম বেনেগল, বিজয় তেন্ডুলকর, অ্যালিক পদমসির মতো বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিকে লেন্সবন্দি করেছেন কুসুম।
এতেই শেষ নয়। নিছক কৌতুহলের বশে জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনো শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে জ্যোতিষবিদ্যার বৈজ্ঞানিক এবং অত্যাধুনিক ক্ষেত্রগুলির সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে জ্যোতিষশাস্ত্রকে ছকে বাঁধা ভবিষ্যৎগণণার উর্দ্ধে নিয়ে গিয়ে, মানুষের ব্যক্তিসত্ত্বার বিকাশে সহায়ক করে তুলেছেন কুসুম। তাঁর কাজের এই ব্যাপ্তির জন্য কাউন্সিল অফ অল্টারনেটিভ সিস্টেমস অফ মেডিসিনের তরফে ডক্টর অফ ফিলোজফি ইন অ্যাস্ট্রো মেডিক্যাল সায়েন্সেস ডিগ্রি পেয়েছেন কুসুম ভাণ্ডারি। এখন তিনি দ্য টেলিগ্রাফের রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন, গ্রাফিটিতে নিয়মিত কলাম লেখেন।
কুসুমের বহু গুণমুগ্ধ রয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে হারুকি মুরাকামির অন্ধ ভক্ত। জাপানি এই লেখকের একই বই বারবার পড়েও আবার পড়তে ইচ্ছে করে তাঁর। তবে এরই পাশাপাশি বাংলার শিল্পও তাঁর কাছে চর্চার বিষয়। কে বলতে পারে,হয়তো এই বিষয়েও ফের নতুন কিছু করে সকলকে চমক দেবেন কুসুম!