৭ অ-সাধারণ ভারতীয়ের গর্বের গাঁথা

৭ অ-সাধারণ ভারতীয়ের গর্বের গাঁথা

Saturday November 21, 2015,

4 min Read

টিম ওয়াই এস বাংলা

আমরা যদি একটু খতিয়ে দেখি তবে আমাদের চারপাশে প্রেরণার কোনও অভাব নেই। যেসব অন্ত্রেপ্রেনিওররা অনবরত ঝুঁকি নেন, তাঁদের কাছে এই মানুষগুলির জীবনের সংঘর্ষ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনের মতোই অনুসরনযোগ্য।


image


আজ আমরা এমন কিছু সাধারণ মানুষের কথা জানব যাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসাধারণ কাজ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

প্রীতি পাটকর— যৌনকর্মীদের গর্ভে জন্ম নেওয়া ৯০ শতাংশ মেয়েরা এটাই বিশ্বাস করে বড় হয় যে দেহ ব্যবসাই তাদের ভবিতব্য। সমাজ তাদের একদিকে কোণঠাসা করে। অন্যদিকে তাদের পরিস্থিতি বদলে সরকারের উদ্যোগও যৎসামান্যই থাকে। প্রীতি পাটকর এদের জীবনে শিক্ষার আলো এনে বাঁচার মতো বাঁচতে শেখানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।


প্রীতি পাটকর

প্রীতি পাটকর


যেখানে আমাদের মতো বেশিরভাগ মানুষ ভারতে যৌনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেন, সেখানে পাটকর চিন্তা করলেন একটু অন্যভাবে। ১৯৮৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই মুম্বইয়ের লালবাতি এলাকায় যাতায়াত শুরু করেন। সমাজের সেই ব্রাত্য শ্রেণির অভাব অভিযোগ শুনতেন যেখানে পারতপক্ষে কেউ পা মাড়াতে চায় না। তাদের প্রতি এই অবিচারের প্রতিবাদে যৌন কর্মীদের সন্তানদের জন্য বিশ্বের প্রথম নাইট কেয়ার সেন্টারের সূচনা করেন তিনি।

চেওয়াং নরফেল- লাদাখের সৌন্দর্য আর স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ আমরা অনেক সময়েই ভুলে যাই যে শীতকালে কী অসম্ভব জলকষ্টেই না ভোগে এই স্বর্গরাজ্য। লাদাখের প্রাকৃতিক জলের একমাত্র ভাণ্ডার হল পাহাড়ের হিমবাহ গলা জল। ১৯৮৭ সালে নরফেল ফুকসে ফু গ্রামে প্রথম কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করেন।


চেওয়াং নরফেল-

চেওয়াং নরফেল-


এর ফলে যে জলাভাবের সমস্যা মিটল তাই নয়, কৃষি সংক্রান্ত সমস্যারও সুরাহা হল। তাঁর এই সামান্য আবিষ্কার লাদাখের বাস্তুতন্ত্রকেও রক্ষা করল।এখন আর শীতকালে কৃষকদের বিকল্প কাজের খোঁজে অন্যত্র যেতে হয় না। মহিলাদেরও দীর্ঘ পথ হেঁটে জল সংগ্রহ করতে হয় না।সবথেকে বড় কথা, অনিয়মিত জল সরবরাহের জন্য আর সঙ্কটে পড়তে হয় না এলাকার মানুষকে।

যাদব পায়েঙ্গ- বালুতটে গাছ লাগানোর অদ্ভুত জেদ ছিল তাঁর। ১৯৭৯ সালে অসমে তাঁর জন্মস্থানে ভয়াবহ বন্যার পর প্রচুর সাপ ভেসে এসেছিল। তখনই তিনি ঠিক করেন এই ঊষর ভূমিকে গভীর জঙ্গলে রূপান্তরিত করবেন। কিন্তু বন দফতর থেকে কোনো সাড়া পাননি।


যাদব পায়েঙ্গ

যাদব পায়েঙ্গ


কিন্তু লক্ষেয অবিচল যাদব পড়াশোনা, ঘরবাড়ি ছেড়ে একাকী জীবন কাটাতে শুরু করেন। সকাল সন্ধে বালুতটের গাছে জল দেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত পরিচর্যা করতেন। গ্রামের থেকে লাল পিঁপড়ে সংগ্রহ করে এনে সেগুলিকে ওই বালিয়াড়িতে ছেড়ে দেন। অবশেষে সাড়া দিল প্রকৃতি। দ্রুত গাছগাছালি ছেয়ে গেল এলাকায়, বাদ গেল না একশৃঙ্গ গণ্ডার এমনকী, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারও। ২০০৮ সালে যাদবের এই অসামান্য কীর্তির কথা জানতে পারে অসমের বন দফতর।

শীলা ঘোষ

কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় ঘরে তৈরি পাঁপড়, ফ্রায়েম ফেরি করেন তিনি। ছিয়াশি বছরের শীলা ঘোষ কিন্ত মনের দিক থেকে এখনও যুবতী। যেই ফুটপাথে বসে তিনি বিক্রিবাটা করেন সেখান থেকে তাঁর বাড়ির দূরত্ব ২ ঘণ্টা।


শীলা ঘোষ

শীলা ঘোষ


একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পর নাতি নাতনিদের মুখে দু‍বেলা দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে এভাবেই নিরলস পরিশ্রম করেন তিনি। ভিক্ষাবৃত্তিতে রুচি নেই তাঁর। তাঁর বিশ্বাস সংসার চালাতে এখনও যথেষ্ট সক্ষম তিনি।

পালাম কল্যাণসুন্দরম— দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর প্রেরণা পেয়েছিলেন মায়ের থেকে।৭৩ বছরের কল্যাণসুন্দরম ভারতের ‘শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরিয়ান’-এর স্বীকৃতি পান।তামিলনাড়ুর কুমারকুরুপারা আর্ট কলেজে ৩৫ বছর শিক্ষকতা করে বেতনের সমস্তটাই দান করেছেন চ্যারিটিতে। নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটানোর জন্য অন্য কাজ করেছেন।


পালাম কল্যাণসুন্দরম

পালাম কল্যাণসুন্দরম


এমনকী অবসরগ্রহণের পরও লেখালেখি থেকে উপার্জিত অর্থ অনাথ শিশুদের পড়াশোনা খাতে জমা করেন। তাঁর মতে, টাকা রোজগারের ক্ষমতা তখনই আনন্দ দেয় ‌যখন তা গরিব ও দুস্থদের দান করা যায়। চেন্নাইয়ের সইদাপেটের ছোট্ট বাড়ি থেকে নিয়মিত অফিসের জন্য বেরোন কল্যাণসুন্দরম। সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির উন্নতিসাধনই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।

চিকিৎসক মালা— জীবন বড়ই অনির্দিষ্ট। পরমুহূর্তে কী অপেক্ষা করে রয়েছে জানি না। চিকিৎসক মালার ক্ষেত্রেও তাই। মেডিক্যালের পড়াশোনা শেষ করে সেনায় যোগ দেন। আধিকারিক হন। কিন্তু এরপর প্রেমে পড়ে বিয়ে করেন।নিজের কেরিয়ার ভুলে সুদূর ওমানে গিয়ে বসবাস শুরু করেন।


চিকিৎসক মালা

চিকিৎসক মালা


কিন্তু ওমানে বিবাহবিচ্ছেদের পর সমস্যা শুরু হয় তাঁর জীবনে। দিল্লি ফিরে আসেন। তাতেও রক্ষা হল না। বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে তাঁর। কিন্তু চিকিৎসক মালা মনে করেন এই দুর্ঘটনা তাঁর জীবনকে নতুন দিশা দেখিয়েছে।আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধব, মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে উত্তরাখণ্ডের পার্বত্য এলাকা রানিক্ষেতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে গিয়ে শুরু করেন সেলাইয়ের কাজ। সৃজনশীলতা দিয়ে শুধু নিজেরই নয়, আশপাশের মানুষের দক্ষতা বাড়িয়ে রোজগারের দিশা দেখান।

পুজা টাপারিয়া-- সেটা ছিল ২০০৪ সাল। শিশুদের যৌন নির্যাতনের ওপর একটি নাটক দেখতে গিয়ে জীবনটাই আমূল বদলে গেল পুজা টাপারিয়ার। ওই নাটকটি তাঁকে এতটাই নাড়িয়ে দিয়েছিল যে অর্পণ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে ফেলেন। শিশুদের যৌন নির্যাতন থেকে মুক্তি দেওয়াই লক্ষ্য অর্পণের।


পুজা টাপারিয়া

পুজা টাপারিয়া


২০১২ সালে মাত্র ৮ বছরের মধ্যে অর্পণ প্রত্যক্ষভাবে ৭০ হাজার এবং পরোক্ষে ২ লক্ষ ১২ হাজার মানুষের মধ্যে যৌন নির্যাতন নিয়ে সচেতনতা প্রসারে সক্ষম হয়। এদের মধ্যে রয়েছে শিশু, অভিভাবক, শিক্ষক এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও।আর্থিক লাভ উপেক্ষা করে এই ন্যক্কারজনক বাস্তবকে সমাজ থেকে উপড়ে ফেলাই অর্পণের একমাত্র লক্ষ্য।

এরকম অব্যক্ত অসংখ্য কাহিনি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু যা করণীয় তা হল এধরনের ঘটনাকে সামনে নিয়ে এসে সমাজকে প্রেরণা জোগানো।স্বাধীনতার স্বাদ তখনই পুরোপুরি নেওয়া সম্ভব যখন অতীত আর বর্তমানের নায়কদের সম্পর্কে আলোচনা করে গর্ব অনুভব করা যায়। কে বলতে পারে আমাদের মধ্যেও তাঁদের মতো কোনো সত্ত্বা লুকিয়ে আছে যে স্বাধীন হতে চাইছে ?

লেখক : রিচা মাহেশ্বরী

অনুবাদ: শিল্পী চক্রবর্তী

    Share on
    close