ড্যানিয়েলের M-DUK দেবে বেডশোর থেকে মুক্তি
এ এক প্রেমের কাহিনি। পাশাপাশি একটি আবিষ্কারেরও। স্ত্রীর রোগশয্যার যন্ত্রণা কমাতে কলকাতার এক ইঞ্জিনিয়ার এবং গবেষক ড্যানিয়েল কার্কী নিজে নিজেই বানিয়ে ফেলেছেন এমন এক শয্যা যা ব্যবহার করলে কখনও বেডশোর হবে না।
Tuesday March 21, 2017,
3 min Read
দীর্ঘদিন ধরে রোগশয্যায় শুয়ে রোগীর বেডশোর হওয়া একরকম গোদের ওপর বিষফোঁড়া। রোগযন্ত্রণা দ্বিগুণ হয় বেডশোরের কারণে। কিংবা দিনের পর দিন ক্যাথিটার ব্যবহার করতে করতে রোগীর অন্য উপসর্গ দেখা দেয়। এবার সেই আশঙ্কা থেকে মুক্তির সময় এসে গেল এই বাঙালি গবেষকের হাত ধরে। ম্যাক্সিমাম ডিসচার্য ইউরিন ক্যাচার (M-DUK)-ড্যানিয়েল কার্কীর এই উদ্ভাবন মুক্তি দেবে বেডশোরের যন্ত্রণা থেকে। শুধু তাই নয় ড্যানিয়েলের এই আবিষ্কারের ফলে রোগশয্যায় শায়িত রোগীর ক্যাথিটার বদল করা কিংবা ডায়াপারের ঝঞ্ঝাটও থাকছে না। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে কার্কী এখন শিরোনামে। বহু সংবাদ মাধ্যম তাঁকে নিয়ে খবর করেছে। তাঁর এই রোগশয্যার প্রযুক্তি নিয়েও মানুষের আগ্রহ অপরিসীম।
ড্যানিয়েল বলছিলেন ওঁর কাহিনি। ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর ওঁর স্ত্রী মিষ্ঠু কার্কী হঠাতই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তড়িঘড়ি বেলেঘাটায় একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে তাঁকে ভর্তি করা হয়। সেখানে একরকম অযত্নেই বেডশোর হয়ে যায় মিষ্টুর। ৭৬ দিনে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে বাড়ি আসেন। নিরুপায় হয়ে সাত মাস ক্যাথিটার ব্যবহার করতে হয়। দুদিন ডায়াপার পরানো হয়, ১২ ঘণ্টার মধ্যেই পোশাক থেকে বালিশ সব ভিজে যেত। করুণ ভাবে বলছিলেন ড্যানিয়েল। তখন মাথার ভিতর চলতে থাকে সমস্যার সমাধানের ফন্দি। মাত্র দুদিনে আবিষ্কার করে ফেলেন তাঁর এই MDUC বা ম্যাক্সিমাম ডিসচার্জ ইউরিন ক্যাচার। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রোডাক্টটির গুণগত মান বদলেছে। আরও ভালো আরও পেশাদার হয়েছে এই বেড। ড্যানিয়েল বলছিলেন, মিষ্ঠু যখন ফিরলেন ৭৬ দিনের মাথায় তখন তার পীঠে ৩ ইঞ্চি ছড়ানো আর হাফ ইঞ্চি গর্তযুক্ত বেডশোর ছিল। অস্বাভাবিক যন্ত্রণা। ড্যানিয়েলের বিছানা আর যত্ন সেই যন্ত্রণা থেকে ওঁকে মুক্তি দিয়েছে।
বলছিলেন, সাধারণ কয়েক প্রকার নেটের আস্তরণ দিয়ে বিছানাটি তৈরি। নীচে রয়েছে কয়েকটি পাইপ। আর বায়ু চলাচলের সুবন্দোবস্ত। বিছানায় পড়া তরল চোখের নিমেষে রোগীর বোঝার আগেই নেটের মাধ্যেমে পৌঁছে যাচ্ছে বিছানার নীচে রাখা একটি কালেকশন পাউচে। ফলে বিছানাটিও থাকছে শুকনো। তৈরির খরচ সামান্য, কিন্তু এই অসামান্য কাজটা করতে ড্যানিয়েলের সময় লেগেছিল মাত্র দুটো দিন। এখন আর ক্যাথিটারের ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ছে না। ডায়াপার বদল করারও প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ফলে এই উদ্ভাবনে একটা সুদূর প্রসারী সামাজিক কল্যাণ আছে। সেই সুবাদে ড্যানিয়েল চান, হাসপাতাল গুলিতে ব্যবহৃত হোক এই বেড। এই ম্যাট্রেস এক সঙ্গে অনেকগুলি সমস্যার সমাধান সূত্র। ফলে বাণিজ্যিকভাবেও এই বিছানার একটি বড় বাজার রয়েছে। প্রযুক্তিবিদ, গবেষক ড্যানিয়েলের আরও অনেক পরিচয় আছে। তিনি রঙ্গমঞ্চে আলোর যাদুকর তাপস সেনের সঙ্গেও কাজ করেছেন। ২০০৯ সালে আলোর ডিজাইনের জন্যে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। সারাজীবন ধরেই নানান আবিষ্কার করে গেছেন ড্যানিয়েল। ১৯৬৭ সালে প্রথম আবিষ্কারও বেশ যুগান্তকারী। তখন ড্যানিয়েল স্কুলের ছাত্র। প্রথম আবিষ্কার করেন জামার জন্যে 'পেস্টিং বখরম' কলার এবং কাফ আগে মোটা কাপড় গুজে টেলর মাস্টাররা বানাতেন। কিন্তু ছোট্ট ড্যানিয়েলই শেখালেন কিভাবে কলার এবং কাফে পেস্টিংয়ের টেকনোলজি ব্যবহার করা যেতে পারে। এখন সব ব্ৰ্যান্ড সেই প্রযুক্তিই ব্যবহার করে। পেস্টিং ছাড়া কোনও নামী ব্র্যান্ডের শার্ট তৈরিই হয় না। এসব বলতে বলতে নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছিলেন ড্যানিয়েল কার্কী। তখন যুগান্তরের মত পত্রিকায় ফলাও করে বেরিয়েছিল কার্কীর আবিষ্কারের কথা। তাঁর সেই সব দুর্দান্ত কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন এই বাঙালি গবেষক। আলো নিয়ে কাজ করতে ভালো বাসেন এই ইঞ্জিনিয়ার। হেমামালিনীর অনেক নৃত্যানুষ্ঠানের আলোর কারুকাজ দেখিয়েছেন। ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার হিসেবেও ড্যানিয়েলকে অনেকেই চেনেন।
২০১৪-র সেই ডিসেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত মিষ্টু স্বাভাবিক ভাবে হাঁটাচলা করতে পারেন না। কিন্তু স্বামীর সেবা আর তাঁর দুর্দান্ত আবিষ্কারের দৌলতে অনেকটাই ভালো আছেন এই গর্বিত স্ত্রী। ড্যানিয়েল বলছিলেন, ম্যাক্সিমাম ডিসচার্জ ইউরিন ক্যাচার উইথ বেডশোর প্রটেক্টর মাসের পর মাস কেন, বছরের পর বছর ব্যবহার করলেও বেডশোর হবে না। ফলে রোগযন্ত্রণায় একটু হলেও আরামের হদিস দিলেন কলকাতার এই গবেষক।