সব শিশুর উন্নতমানের শিক্ষাই লক্ষ্য জয়ের

বাবা-মা ভেবেছিলেন, স্নাতক স্তরের পাঠ চুকলেই ইঞ্জিনিয়ার হবে ছেলে। মাস গেলেই মোটা মাইনে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শেষ বছরে এসে ছেলে হাঁটলেন এক অন্য পথে। কারিগরি বিদ্যার পথে না হেঁটে ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। যোগ দিলেন ‘টিচ ফর ইন্ডিয়া’-র মিশনে। সেই থেকে বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই তাঁর পরিবার। উত্তর প্রদেশের শিক্ষক জয় মিশ্রের পরিজন এখন গোটা দেশ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের উন্নত শিক্ষা দেওয়াই তাঁর জীবনের ব্রত।

সব শিশুর উন্নতমানের শিক্ষাই লক্ষ্য জয়ের

Sunday September 20, 2015,

3 min Read

জানতে কৌতুহল হয়, কী এমন হল যে রাতারাতি বদলে দিল জয়ের জীবন? নিজের মুখেই কৈশোর থেকে যৌবনে পা দেওয়া জয় জানিয়েছেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শেষ বছরে টিচ ফর ইন্ডিয়া ভিশন স্টেটমেন্ট’ সম্পর্কে জানতে পারেন তিনি। সংস্থার কর্মীরা তাঁকে জানান, দেশের সব শিশুকে সেরা শিক্ষা দেওয়াই তাদের লক্ষ্য। শুনতে ভালো লাগলেও আদৌ বিষয়টি সম্ভব কিনা তা নিয়ে জয়ের মনে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কাকতালীয়ভাবে এই সময়ই ‘ভারতে উচ্চশিক্ষার মান’ বিষয়ক একটি গবেষণামূলক কাজ করছিলেন জয়। গবেষণাপত্রে ‘টিচ ফর ইন্ডিয়ার ভিশন স্টেটমেন্ট’-টাও লিখে রাখেন তিনি। পরে প্রজেক্ট গাইডের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। ঘণ্টাখানেকের আলোচনায় জয় বুঝতে পারেন অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও লক্ষ্যের প্রতি আস্থা থাকলেই ‘টিচ ফর ইন্ডিয়া’-র ভাবনা বাস্তবায়িত হতে পারে। আর দেরি না করে টিএফআই-এর লক্ষ্যে জুড়ে যান তিনি। যদিও প্রথমবার তাঁর বৃত্তি প্রশিক্ষণের আবেদনে সাড়া দেয়নি সংস্থা। পরবর্তীকালে অর্থাৎ ২০১৩ সালে ফের আবেদন করেন জয়। এবার আর তাঁকে খালি হাতে ফিরতে হয়নি। টিএইফআই-এর বৃত্তি পান উত্তর প্রদেশের এই যুবা।


ছাত্রছাত্রীদের মাঝে জয়

ছাত্রছাত্রীদের মাঝে জয়


মাত্র পাঁচ সপ্তাহের শিক্ষক হওয়ার প্রশিক্ষণে বুঝতে পারেন, ছাত্র সামলানোর ঝক্কি কী। যদিও সেই প্রশিক্ষণ ঠিকঠাকভাবে কাজে লাগাতে আরও দু বছর। ইতিমধ্যেই শিশুদের উন্নত মানের শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে ‘প্রজেক্ট ম্যানেজার’-এর দায়িত্ব পেয়েছেন জয়। ছেলের এই কাজে যার পর নাই খুশি ছিলেন বাবা। কিন্তু পড়ার ঋণের কথা ভেবে চিন্তা কমেনি মায়ের। ব্যাঙ্কের ইএমআই-এর কথা ভেবে তিনি তখনও ভ্রু কুঁচকাচ্ছেন।


এই শিশুরাই দেশের ভবিষ্যত

এই শিশুরাই দেশের ভবিষ্যত


ত‌বে এসব ভেবে আর সময় নষ্ট করতে চান না জয়। আপাতত ক্লাসের বাইরের শিক্ষাটাও ক্লাসেই দিয়ে যেতে চান তিনি। ইতিমধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছেন, ক্লাসের বাইরে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় কাটায় শিশুরা। সে কারণে অভিভাবকদের আচার-ব্যবহার শিশুমনে প্রভাব ফেলে। যা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চরিত্র গেঁথে যায়। দেখা যায় অনেক স্কুল পড়ুয়া অল্প বয়সেই বিড়ি-সিগারেট খেতে শুরু করে। বন্ধুদের সঙ্গে গালাগাল দিয়ে কথা বলে অনেক ছাত্র। বুঝতে অসুবিধা হয় না এসব ‘উত্তরাধিকার‌’ সূত্রে পায় শিশুমন।


জয়ই এখন এই শিশুদের অভিভাবক

জয়ই এখন এই শিশুদের অভিভাবক


শিশুদের এই আবহাওয়া থেকে মুক্ত করতে ইতিমধ্যেই কতগুলি আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছেন জয়। পুণে মিউনিসিপ্যালিটির সহযোগিতায় আয়োজিত এই আলোচনার মূল লক্ষ্য ছিলেন অভিভাবকরা। যার আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সংবাদ‌’। শিশুদের উন্নতমানের শিক্ষা দিতে অভিভাবকদের ভূমিকাই এখানে বোঝানো হয়। একইভাবে ‘পরিবর্তন’ নামের একটি শিক্ষা অভিযান চালান জয়। পুণের সিরান্ডাবাই দঙ্গত পাটিল স্কুলে চলে এই প্রজেক্ট। ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে এখান যুক্ত করা হয় শিক্ষক, স্কুলের প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদেরও। এক সময় জয়ের চিন্তাধারায় মুগ্ধ হয়ে নড়েচড়ে বসে স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটি। শেষে সিদ্ধান্ত হয় স্কুলের শিক্ষার মান উন্নয়নে সারা বছর ধরে এই ধরনের শিবিরের আয়োজন করা হবে। এখানেই অবশ্য থমকে যায়নি জয়ের সাফল্য। শিক্ষকের কর্তব্যের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা দেখে জয়কে বর্ষসেরা শিক্ষকের সম্মান দিয়েছে পুণে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন। আগামী দিনে গোটা মহারাষ্ট্রে বাস্তবায়িত হতে চলেছে তাঁর শিশুশিক্ষার মডেল। ইতিমধ্যেই গোটা রাজ্যের শিশুদের উন্নতিসাধনে জয়কে প্রজেক্ট প্ল্যান করতে বলেছে টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সস-এর এক দল ছাত্র।

তবে এত কিছুর পরও জয়ের মন পড়ে রয়েছে জন্মভিটে উত্তর প্রদেশে। তাঁর আশা, ভবিষ্যতে জৌনপুরে একটা স্কুল গড়বেন তিনি। অভাব অনটনের জন্য যে শিশুরা স্কুলছুট হয়ে যায়, এই স্কুল হবে তাঁদের আদর্শ স্থান। এখানেই শেষ নয়, আগামী দিনে রাজনীতিতে এসে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে চান তিনি। কারণ বছর তিরিশের এই তরুণ তুর্কি বুঝেছেন , সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে হলে সিস্টেমে ঢুকতে হবে।