প্রথাগত বিদ্যাকে চ্যালেঞ্জ খড়গপুর আইআইটির প্রাক্তনীর



প্রথাগত বিদ্যাকে চ্যালেঞ্জ খড়গপুর আইআইটির প্রাক্তনীর

Saturday October 17, 2015,

6 min Read

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়। বীরভূমের সিউড়ির ভূমিপুত্র। একজন শিক্ষাবিদ। যিনি শিশুদের নিজের মতো করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছেন। নিজের মতো বেড়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছেন। লেভেলফিল্ড স্কুল অর্ঘ্যর ড্রিম প্রজেক্ট। তাঁর মতে, গতানুগতিক শিক্ষা শিশুদের কচি মনকে কিছু না বুঝে মুখস্থ বিদ্যা এবং একঘেঁয়েমির দিকে টেনে নিয়ে যায়। শিক্ষার এই পথকেই চ্যালেঞ্জ করেন অর্ঘ্য। পশ্চিমবঙ্গের এক গ্রামে তাঁর অভিনব শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে শতশত সুকুমার মনে আলো জ্বালিয়েছেন। তাঁর তৈরি করা এই শিক্ষার পথ শিশুমনের কদর করে, তাদের বোঝার চেষ্টা করে, কীভাবে শিশুরা শিক্ষা সহজে আত্মস্থ করতে পারবে জানার চেষ্টা করে।

image


অনেক অসুবিধা সত্বেও অর্ঘ্য নিজের রাস্তাতেই অনড়। তাঁর স্কুলের বাচ্চারা খুশি।পড়াশোনায় আগ্রহ পাচ্ছে। যদিও তাদের বাবা-মায়েদের অনেকে এখনও অর্ঘ্যর তৈরি করা পদ্ধতিতে মানিয়ে উঠতে পারেননি।

জাতীয় স্তরে অ্যাসেট টেস্টের ফল অনুযায়ী বীরভূমের এই স্কুল দেশের সেরা দশটি স্কুলের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। উপনগরীর একটা নতুন স্কুল যেখানে বাচ্চাদের মধ্যে ইংরেজির নুন্যতম জ্ঞানও নেই, সেখানে এই ফল একটা বিরাট পাওনা। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১১য় 'সংকল্প' পুরস্কার পায় লেভেলফিল্ড স্কুল।

শহর এবং গ্রামের স্থানীয় বাচ্চাগুলিকে সাধ্যের মধ্যে উচ্চমানের শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে লেভেলফিল্ড স্কুলের পথচলা শুরু হয়। অর্ঘ্যর মনে পড়ে, 'ইকুইটি রিসার্চ আউটসোর্সিং সংস্থা ইরেভনার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে আমি সংস্থার নিয়োগ এবং ট্রেনিংয়ের দিকটা দেখছিলাম। ৫ বছরে ইরেভনা ১০০ কোটির সংস্থায় গিয়ে দাঁড়ায়, কর্মী সংখ্যা ছিল ৫০০। যেটা দেখে অবাক হয়েছিলাম সেটা হল বেশিরভাগ গ্র্যাজুয়েটই চাকরির জন্য মোটেও তৈরি নন। তাদের ভাবনাচিন্তা, লেখা এবং কথাবার্তা বলার জন্য প্রাথমিক ধারণাগুলি শেখাতে হয়েছিল। ২৫-২৬ বছরে চাকরি করতে আসা ছেলে মেয়েদের এই সব শেখানো মানে ততদিনে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। স্কুলে থাকতেই যা শিখে নেওয়া উচিত'। অর্ঘ্যর উপলব্দি, বেশিরভাগ চাকরিপ্রার্থীই খুব বেশি পড়াশোনা করে না। 'পড়াশোনা না থাকলে কোনও কিছু সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানও থাকে না'।

image


মনে মনে একটা অন্যরকম কিছু করার ভাবনা চলছিল অর্ঘ্যর মধ্যে। আর ঠিক ওই সময় অর্ঘ্যও তাঁর তিন বছরের কন্যার জন্য একটা ঠিকঠাক স্কুলের সন্ধান করছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, 'স্কুলের জন্য চেন্নাই সঠিক জায়গা। অনেক স্কুল বিজ্ঞাপন করে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাসরুম আর বিরাট বড় ক্যাম্পাসের কথা বলে। কিন্তু কেউ জানায় না তারা কীভাবে কী শেখাবে'। একদম অন্যধরনের প্রাথমিক স্কুল এবং কিন্ডারর্গাডেন খোলার কথা ভাবছিলেন তিনি। কলকাতায় সেটা করা বেশ খরচ সাপেক্ষ এবং তাঁর এই অপারেশন বোঝানোর মতো কাউকে সেভাবে পাচ্ছিলেন না। অর্ঘ্য বলেন, 'নতুন কিছু শুরু করতে সবাই ভয় পায়। সফল হয়েছে তেমন প্রজেক্টের আইডিয়া চান। যাকেই বলেছি জানতে চেয়েছেন এই ফরমেটে কটা স্কুল চলে। অবশ্যই আমার উত্তর ছিল, একটাও না। ঠিক এই কারণে আমার নিজের শহর শিউড়িতেই করলাম স্কুলটা'।

জন্মের পর থেকে প্রথম দশ বছর শিউড়িতে কেটেছিল অর্ঘ্যর। ছোট শহরে সুযোগের অভাবে অনেক প্রতিশ্রুতিমান ছাত্র সফল হতে পারেনি। তাঁর বিশ্বাস, 'মেধা সবার মধ্যে সমানভাবে আছে। জীবনের শুরুতেই সেটা খুঁজে বের করা উচিত। সময় যত গড়ায় প্রত্যেকে বড় হয়ে ওঠে। ফলে শহরের পড়ুয়াদের সঙ্গে গ্রামের পড়ুয়াদের ফারাকটা এত বড় হয়ে যায় যেটা জোড়া লাগানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। আমিও চেয়েছিলাম আমার কন্যা শহুরে পরিবেশ থেকে দূরে থাক। প্রথামিকভাবে নিজের জমানো ৫০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে লেভেলফিল্ড স্কুল গড়ি। উদ্দেশ্য ছিল যেখানে শিক্ষার আলো তেমনভাবে পৌঁছায় না সেইসব জায়গায় উন্নতমানের শিক্ষা দেওয়া'।

২০১০ এর এপ্রিলে প্রথম ব্যচে তণুশ্রী নামে কাছের গ্রামের একটি মেয়ে ভর্তি হয়। বাংলা মিডিয়াম থেকে আসা আরও ২০টি ছেলেমেয়ের মতো তণুশ্রীও শিক্ষক যখন ইংরেজিতে কথা বলতেন তাঁর মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। অর্ঘ্য এবং তাঁর টিম গত কয়েক বছরে তণুশ্রীর মেধার বিকাশ ঘটাতে নিজেদের তৈরি নতুন পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে গিয়েছেন। ২০১৩য় অ্যাসেট টেস্টে সারা ভারতে শীর্ষস্থান অধিকার করে তণুশ্রী। সে এখন কথা বলে, যুক্তি দেয়, বিতর্কে অংশ নেয়। এবং সবটাই সাবলীল ইংরেজিতে। তার পড়ার ক্ষমতা বেড়েছে এবং তার বয়সে পড়ার মতো অনেক বই পড়েও ফেলেছে। স্কুলে তণুশ্রী এবং তার দল প্যানেল ডিসকাসশানে প্রথম হয়েছে।

তণুশ্রীর মতো শিক্ষার্থীরা অর্ঘ্যকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগায়। অ্যাসেট টেস্ট ছাড়াও, অলিম্পিয়াড, ম্যাকমিলানের মতো টেস্টও দেয় অর্ঘ্যর স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। শহরের অনেক স্কুলের থেকে ভালো রেজাল্ট হয় তাদের। 'ক্লাস থ্রিতে অংকে আমাদের পড়ুয়াদের সর্বনিম্ন নম্বর ৮৮। ওদের দেখে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। বুঝতে পারি ওরা উন্নতি করছে, বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে। যে পথ নিয়েছি তার জন্য আমার ক্ষমা চাওয়ার কোনও কারণ নেই। আজ আমি শান্তি পাই যখন ওদের টেস্টের মার্ক দেখি, কত ভালো ইংরেজি বলে ওরা। ওদের স্বাধীন চিন্তা ভাবনায় অবাক হয়ে যাই', বলেন তৃপ্ত অর্ঘ্য।

লেভেলফিল্ড তৈরির সময় থেকে অভিভাবকদের অনেক বাধার মুখে পড়তে হয়েছে অর্ঘ্যকে। 'ছেলেমেয়েদের কতটা উন্নতি হয়েছে সেই নিয়ে কথা বলতে বছরে তিনবার তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসি। বেশিরভাগ আলোচনাই স্কুলের পড়ানোর পদ্ধতি নিয়ে কেটে যায়। আমাদের পড়াশোনার পদ্ধতি নিয়ে বাবা-মায়েদের সঙ্গে বড় বড় দল বানিয়ে কথা বলেছি'। তাঁর যুক্তি, 'যদি চার ঘণ্টা পড়ে সঠিক কিছু শেখা যায় তাহলে সেটাই ঠিক পথ। দিনে ১০ ঘণ্টা পড়ার কোনও দরকারই পড়ে না'। তিনি বলেন, ইংরেজি সাহিত্যের জন্য শুধু একটা পড়ানো হয় না। পড়ুয়াদের উৎসাহ দেন সারা বছরে অন্তত ২০ টা বই পড়ার।

অর্ঘ্য এবং তাঁর টিম বাচ্চাদের ক্লাসিকগুলি বলতে গেলে একরকম নতুন করে লিখছেন। তাতে এক্সারসাইজ থাকছে, নতুন লাইন ঢোকাচ্ছেন, বৈজ্ঞানিক মানদণ্ডে সেগুলিকে মাপার চেষ্টা করছেন এবং পাঠ্যবস্তুগুলিকে কাঠিন্যের মাপকাঠিতে মান নির্নয়ের চেষ্টা করছেন। উঁচু ক্লাসে উঠে বিভিন্ন বিষয় যাতে ভালোভাবে বুঝতে পারে ক্লাস ফোর পর্যন্ত তারই প্রস্তুতি চলে। 'তারা ভালো লিখতে পারে, বলতে পারে, সমস্যার সমাধান করতে পারে'। অন্যান্য স্কুলের মতো গতে বাঁধা পাঠ্য বই নিয়ে বাবা-মায়েরা যখন প্রশ্ন করেন হতাশ হন অর্ঘ্য। ঠাট্টা করেই বলেন, 'ওদের কথা শুনে বইয়ের সংজ্ঞা বুঝতে পারি। তাঁদের মনে মনে থাকে, ওই বোরিং বইগুলি মুখস্ত করতেই হবে। অন্যগুলি বইই নয়। যে কোনও কিছু পড়ে আনন্দ পেলেই তাকে বইয়ের মর্যাদা দেওয়া যাবে না'। এমনকী ইতিহাস, ভূগোলে পড়ানোর সময়ও বিষয়ের মধ্যে বেঁধে রাখেন না অর্ঘ্য। 'ইংরেজি সাহিত্য ক্লাসেও সীমান্ত সমস্যা চল আসতে পারে যেগুলি ইতিহাস, ভূগোল এবং কোথাও কোথাও বিজ্ঞানের বিষয়', বলেন রাজ্যের এই উদ্যোক্তা।

স্কুলের জন্য তিনি শিক্ষক-শিক্ষকা হিসেবে বেছেছেন তাঁদের যারা ভালো কলেজে পড়েছেন, ভালো কথা বলেন এবং সাধারণ জ্ঞান আছে। বিএড ডিগ্রি নিয়ে তাঁর কোনও মাথা ব্যথা নেই। তাঁর কাছে বিএডও গতানুগতিক শিক্ষারই একটা পথ মাত্র। স্বীকার করেন, নিজের সিদ্ধান্তে তিনি অনড়। 'কারণ আমি আমার নিজের সংস্থায় কাজ করছি। তার জন্য কারও কাছে আমার দক্ষতা প্রমাণ করতে হবে না। কোনও পার্টনারও নেই। কারও নাক গলানোর ব্যাপারও নেই। ফলে আমি যাভালো মনে করি তাই করি'। ভালো মান বজায় রাখার পরও স্কুলের ফি-ও সাধ্যের মধ্যে। স্কুলের মধ্যে আড়ম্বর নেই খুব একটা। বিভিন্ন ক্লাসের জন্য সময় ভাগ করে দিয়ে অল্প জিনিসেই কাজ চালানোর ব্যবস্থা করেছেন। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার থেকে দক্ষতার দিকে নজর দিয়েছেন অর্ঘ্য। ক্লাসরুমের উপযুক্ত করে তোলার জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এর ফলে টিচারাও দক্ষ হয়ে ওঠেন। 'আমাদের পলিসি হল, বই নয়, বাড়িতে পড়া নয় এবং প্রইভেট টিউশন নয়। পড়ার দক্ষতার ওপর জোর দিই। যেসব অপ্রচলিত উৎস রয়েছে যেমন জাপানিস পাজল, সাহিত্য, ডকুমেন্টারি এবং সিনেমা দেখতে পড়ুয়াদের উৎসাহ দিই'।

বর্তমানে লেভেলফিল্ড স্কুলে লোয়ার কেজি থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ুয়ার সংখ্যা ৩০০। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত বাড়ানোর পাশাপাশি সামনের বছর অন্য জেলা এবং কলকাতাতেও লেভেলফিল্ডের শাখা খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। একবার এই মডেল সফল প্রমাণিত হলে বিভিন্ন ব্যবসায়ীক সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় শাখা খোলার ইচ্ছে আছে অর্ঘ্যর। বিভিন্ন পাঠ্য এবং নানা ধরনের অংকের জন্য প্রযুক্তির মাধ্যমে অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করতে চান তিনি এবং আইফোন ও অ্যানরয়েডের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে তাঁর।

আইআইটি খড়গপুর এবং আইআইএম আমদাবাদের এই প্রাক্তনী বলেন, 'পরীক্ষা পদ্ধতিতে সবচেয়ে বড় বদল দরকার। পরীক্ষা পদ্ধতি বদলানো গেলে, সবকিছু আপনা আপনি বদলে যাবে। মুখস্থ বিদ্যার ওপর নির্ভর করে যদি পরীক্ষায় বসা হয় তাহলে যতই শেখানো হোক না কেন বোঝার সঙ্গে সঙ্গে শেখা কখনই হবে না। আমরা ভারতীয়রা বড্ড বেশি পরীক্ষা নির্ভর। পরীক্ষায় ভালো করার জন্য আমাদের যত চেষ্টা। পরীক্ষাটাকে যদি চিন্তা নির্ভর করে দিতে পারি, তাহলেই তরুণ প্রতিভার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটবে'।