স্বাতী আগারওয়াল আর সুনয়না জালান। একজন দিল্লির আরেকজন কলকাতার মেয়ে। বিয়ের পর থেকে কলকাতাই নিজের শহর। ধানবাদের এক ব্যবসায়ী পরিবারের পুত্রবধূ হয়ে আসেন দুজনেই। কাছাকাছি বয়সের সুবাদে বন্ধু হয়ে ওঠেন। শুধু তাই নয় দুজনের পছন্দেও বেশ মিলমিশ। শাড়ি, ফেব্রিকের রং —এর প্রতি দারুণ টান ছিল দুজনেরই। সেই থেকেই একটু একটু করে স্বপ্ন দেখা শুরু। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই। ছাপোষা গৃহবধূ থেকে পেশাদার ফ্যাশন ডিজাইনার হয়ে ওঠার অসাধ্য সাধন করেছেন ওরা। ভারতীয় বয়ন শিল্পের পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনাই এঁদের প্রাথমিক লক্ষ্য।
এই দুই মহিলা উদ্যোগপতির এক দশকের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ ওদের ব্র্যান্ড SWATI & SUNAINA এখন ফ্যাশন দুনিয়ায় যথেষ্টই পরিচিত। শুধু শাড়ি নয়। লেহেঙ্গাও ডিজাইন করছে SWATI & SUNAINA। আন্তর্জাতিক স্তরে ওদের পোশাকের কদর আছে। এবং এতটাই, যে শুধু ওদের পোশাক কিনতে অর্ধেক পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে হলেও ক্রেতারা আসেন ৪৬৫ কেয়াতলা রোডে ওদের স্টোরে। ওরা বলছেন এই তো সবে শুরু। কিন্তু এই শুরুর একটা সুদীর্ঘ শুরু আছে। সব সাফল্যের আরম্ভের মত। সেই গল্প প্রায় দশ বছর আগে আপনাকে নিয়ে যাবে বেনারসের তস্য গলিতে। সেখানে এই দুই বান্ধবী আবিষ্কার করেন নিজেদের গন্তব্য।
২০০৭ এর কথা বলছি। তখনও শুরু হয়নি ওদের উদ্যোগ। বেনারসের গলিতে দেখা পেয়ে যান প্রায় অনাদরে লুটিয়ে থাকা আর প্রায় উবে যাওয়া এক বয়ন ঐতিহ্যের। ওরা ঠিক করে ফেলেন একটা কিছু করতেই হবে। নিজেদের তাগিদে যত না তার থেকে বেশি এই বেনারসি শিল্পকে বাঁচানোর তাগিদ টের পান। বয়নশিল্পীদের একটি দলকে সঙ্গে নিয়েই শুরু করেন যাত্রা। বাড়ি বসেই শুরু হয় সেই মিশন। জরির হালকা শাড়ি দিয়ে শুরু। একটু একটু করে আধুনিকতা আর সৃজনশীলতাকে মিলিয়ে দিলেন ওরা। একটু একটু করেই মাথা তুলল স্বাতী সুনয়নার ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ভেঞ্চার। প্রায় ৯ বছর চলল এভাবে। পায়ের তলার জমিটা শক্ত হতেই ২০১৬ সালে কেয়াতলা রোডের ছোট্ট সাজানো ছবির মতো বুটিকে স্বপ্নের বৃত্তটা সম্পূর্ণ হল। যত্ন আর মমতার ছোঁয়া পাবেন বুটিকের পরতে পরতে। ব্রোকেডের সোফা কভার থেকে পর্দা, আদ্যিকালের আসবাব, চিন থেকে আনা ওপিয়াম বক্স, জরির লেস আপনাকে টাইম মেশিনে চড়িয়ে দেবে।
আসল খাজানা কিন্তু একটু ভেতরে ছোট্ট একটা ঘরে। ‘আসলি জরি শাড়ি’ সেই ঝলমলে কালেকশন খুলে বসতেই আনন্দে স্বাতী আর সুনয়নার চোখ চিকচিক করে ওঠে। ‘২০১৪ থেকে কাজ চলছে জরি শাড়ির। শিকরগহ, মেহরাব, রঙকাট বাহারি সব নাম। ফ্রান্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে ওদের ডিজাইন করা লাল মেহরাব পরেছিলেন ঐশ্বরিয়া রাই’,খুশিতে ডগমগ সুনয়না। শাড়িগুলি আসলে স্বাতীদের কাছে ‘বুনট কেশ-শিল্প’। ‘এটা আমাদের বিশ্বাস। প্রত্যেক শাড়ির এক একটা বিশেষত্ব আছে। এক একটি ডিজাইনের ৮ থেকে ১২ টি শাড়ি তৈরি হয়। সবকটির সঙ্গে থাকে সার্টিফিকেট’, বলছিলেন স্বাতী। শাড়ির বাক্সেও থাকে চমক। এক একটি বাক্সে আসল জরির তালের মধ্যে রাখা হয় শাড়ি, সঙ্গে শাড়িটির ইতিহাস লেখা ছোট্ট একটা ডায়েরি থাকে, আর থাকে শুদ্ধতার সনদ (অথেনটিসিটি সার্টিফিকেট), ডিজাইনের নম্বর, সিরিয়াল নম্বর, যিনি শাড়িটি বুনেছেন সেই শিল্পীর নাম। কত দিন সময় লেগেছে তৈরিতে তার উল্লেখ। শাড়িটি এভাবেই এক একটা ডকুমেন্টারি হয়ে যায়। ফলে প্রত্যেকটা বাক্সই আসলে শাড়ির প্রামাণ্য দলিল। রং নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন ওরা, পছন্দ করেন গাঢ় রং। তবে হালকা রঙে প্যাস্টেল কালেকশনও আছে, বলছিলেন সুনয়না।
ওদের প্রত্যেক কালেকশনের ২টি করে শাড়ি নিজেরাই রেখে দেন। নিজেরাই স্বীকার করলেন ওরা আদলে শাড়ির পাগল, দুজনেই, স্বাতী এবং সুনয়না। সারা দিন শাড়িতেই থাকতে ভালোবাসেন। হেন কোনও শাড়ি নেই যেটা ওদের ওয়াডরোবে নেই।
মজা দেখুন, ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিন্তু নেই। শুধুমাত্র ভারতীয় বস্ত্র শিল্পর পুরনো ঐতিহ্যকে ভালোবেসে, তার অলিগলি ঘুরতে ঘুরতেই এখন পুরোদস্তুর ডিজাইনার হয়ে গিয়েছেন। দীর্ঘদিনের বদ্ধমূল ধারণাগুলো সুকৌশলে ভেঙেছেন। হ্যান্ডলুমের শাড়ি ভারী যে হয়না সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন ওরা। বিয়ের শাড়ি থেকে প্রতিদিনের ব্যবহারে হ্যান্ডলুম কতটা আরামদায়ক বুঝিয়ে দিয়েছে ওদের ব্র্যান্ড। রংকাট, কটন জামদানীর বুনন শৈলীকে নিজেদের ডিজাইনে ঢেলে সাজিয়েছেন।
মারোয়াড়ী বাড়ির বউ হয়ে আসার সুবাদে ব্যবসাটা ভালোই রপ্ত করেছেন ওরা।‘স্বামী আর দুই কন্যার কাছ থেকে সবসময় সাপোর্ট পেয়েছি। চলার পথে যেটা সবচেয়ে জরুরি’, বলেন সুনয়না। ‘শাড়ি নিয়ে যা কিছু শিখেছি সব শাশুড়ির কাছ থেকে পাওয়া। ওঁর কালেকশন দেখলে যেকারও হিংসে হবে। নতুন কোনও শাড়ি তাঁত থেকে এলেই আগে শাশুড়ির পরামর্শ নিই’, হাসিমুখে স্বীকার করলেন স্বাতী। শাড়ি, টেক্সটাইল, ব্যবসা কিছুই জানা ছিল না দুজনের কারও। ওদের সব শেখা তাঁতিদের কাছ থেকে, মনোযোগী ছাত্রীর মত সব শিখে ফেলেছেন ওরা। আর কর্মীদের সঙ্গে ওদের বিশ্বাসের আন্তরিক সম্পর্কও দুর্দান্ত। যখন এসব বলছিলেন বেশ তৃপ্ত শোনাচ্ছিল স্বাতীর গলা।
Related Stories
August 20, 2017
August 20, 2017
Stories by Hindol Goswami
August 20, 2017
August 20, 2017
August 20, 2017
August 20, 2017