রহিমা বিবি বাংলার মুসলিম মেয়েদের রোল মডেল
Saturday February 20, 2016,
3 min Read
"কোনও ব্যক্তির একটি পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদিন চলিবে?"- বেগম রোকেয়া
নারী ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র নামে যে সংস্থাটি এই রাজ্যের দরিদ্র মুসলমান মেয়েদের জীবনকে শিক্ষিত ও উন্নত করতে গত তিন দশক ধরে কাজ করে আসছে, বর্তমানে সেই সংগঠনটি চালাচ্ছেন ৯ জন তরুণী। এঁদের সকলের মাথার ওপর সংগঠনের সম্পাদিকা হিসাবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন বছর আটত্রিশের রহিমা বিবি। নারী ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র নামে এই সংগঠনটি মহিলা পরিচালিত। পরিচালন বোর্ডের নয়জন সদস্যের মধ্যে ৯ জনই মুসলমান সম্প্রদায়ের শিক্ষিত নারী। সম্পাদিকা রহিমা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার পর পুরো সময়ের কর্মী হিসাবে সংগঠনের কাজ শুরু করেন।
হাওড়া নলপুর গ্রামের বাসিন্দা রহিমা। তাঁর পিতৃপুরুষের আদিভিটা এখানেই। রহিমার বাবা মহম্মদ মইনুদ্দিন ছিলেন গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের মাস্টারমশাই। তাঁরই হাতে গড়া সংস্থা নারী ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র।
কীভাবে সেদিন কাজটা শুরু হয়েছিল? রহিমা জানালেন, এই গ্রামে কোনও লাইব্রেরি ছিল না। গ্রামবাসীদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে বাবা একটি লাইব্রেরি গড়ে তুললেন। মোটে ১৩টি বই নিয়ে শুরু হয়েছিল তাজমহল লাইব্রেরি। এখন সেখানে বইয়ের সংখ্যা ১০ হাজারের ওপর। গ্রামবাসীদের অনেকেরই নিয়মিত পড়াশোনার অভ্যাস তৈরি হয়েছে।
বাবার হাতে গড়া মেয়ে রহিমা। ছোটবেলা থেকেই মানুষের জন্যে কাজের প্রতি আগ্রহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা পেরিয়ে তাই চাকরি-বাকরির খোঁজ করেননি। হাতেকলমে সামাজিক কাজের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। রহিমার কথায়, আমি সব দেখে দেখে শিখেছি।
নারী ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের কাজ রাজ্যের বিভিন্ন জেলাগুলিতে ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। জানা গেল, ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সালের ভিতর তপশিলি জাতি, উপজাতি, সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়, মা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছেন ওঁরা। মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের ৬৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও ৪২৮টি গ্রামে পুওরেস্ট এরিয়া সিভিল সোসাইটি প্রোগ্রামের কাজ চলছে। এছাড়াও, জননী সুরক্ষা প্রকল্প, রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা, পারিবারিক হিংসা, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা অথবা বিপর্যয় মোকাবিলা ও তথ্যের অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কাজও বাস্তবায়িত করছে রহিমার সংগঠন।
রহিমা বললেন, নারী ও শিশুর বিকাশে সহায়তা করাই লক্ষ্য। এই রাজ্যের তিনটি পিছিয়ে পড়া জেলা মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর। সেখানে কাজ করতে গিয়ে আমরা বুঝতে পারছি, দেশ স্বাধীন হওয়ার এতদিন পরও বহু মেয়ে উন্নয়নের সুফল পাননি। এছাড়া, তফশিলি জাতি, জনজাতি এবং মুসলমানরা অনগ্রসর অবস্থায় রয়ে গিয়েছেন। নারীশিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ক্ষেত্রে ভারতের সামগ্রিক উন্নয়ন হলেও পুরুষ মানুষ এই ক্ষেত্রগুলিতে যে সুযোগ পেয়েছেন, তার তুলনায় মেয়েরা অনেক পিছিয়ে। যেমন, এই রাজ্যে মেয়েদের সাক্ষরতার হার ৭১.১৬ শতাংশ। অন্যদিকে, পুরুষের সাক্ষরতার হার ৮২.৬৭ শতাংশ। ১৯৫১ সালের জনগণনায় পুরুষ ও নারীর সাক্ষরতার ফারাক ছিল ১৮.৩০ শতাংশ। ২০১১ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান অনুসারে তার হার দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশ।
এই পরিস্থিতিতে মুসলমান মেয়েদের অবস্থা আরও করুণ। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান মেয়েদের সাক্ষরতার হার মোটে ৫০ শতাংশ। এটি এই রাজ্যের গড় সাক্ষরতার হার ৬০ শতাংশের থেকেও অনেকটা নীচে। মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ কম থাকায় তা নারীর মর্যাদালাভের পক্ষে এক বিরাট বাধা বলে মনে করেন রহিমা বিবি। তাছাড়া, এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরিষেবার দশাও করুণ। এ বিষয়ে সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে প্রতি বছর দুলক্ষ প্রসূতির মৃত্যু হয়। তার ভিতর ১৭ শতাংশই ভারতের। জন্মের পরও এদেশে প্রতি বছর ১৩ লক্ষ শিশুর মৃত্যু হয়। প্রসূতি মা ও জন্মের পর শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হল অপুষ্টি।
পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা প্রতি চারজনের ভিতর একজন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। রহিমা বলেন, মুসলমান মেয়ে বলতে এখানে অশিক্ষা, বাল্যবিবাহ, অনেকগুলি ছেলেমেয়ের মা কিংবা বোরখা ঢাকা মুখের নারীকেই বোঝায়। সামান্য কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া এই রাজ্যে সফল মুসলমান মেয়েদের খুঁজে পাওয়া কঠিন।
রহিমা জানালেন, মেয়েদের অগ্রসরে ও নারী স্বাধীনতায় রক্ষণশীলতার বাধা আছে। যদিও ইসলাম নারীকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পুরুষের সমানাধিকারই দিয়েছে। আমরা এই বিষয়গুলি সম্পর্কে মেয়েদের সচেতন করবার কাজে লেগে রয়েছি। সাফল্যও পাওয়া গিয়েছে। মেয়েরা চেতনাসম্পন্ন হচ্ছেন। হয়তো আজ থেকে ১০০ বছর পরে মুসলমান মেয়েরা সমানাধিকারের মর্যাদা পাবেন।
রহিমাকে নিয়ে পরিচালন কমিটিতে রয়েছেন যে নয়জন তরুণী, তাঁরা সকলেই বিবাহিত। সংসারের কাজ সামলান পাশাপাশি সংগঠনও। ভিতর ও বাহির সমান দক্ষতার সঙ্গে সামলে আজ ওঁরা মেয়েদের কাছে এক একটি দৃষ্টান্ত স্বরূপ।