ওদের পুজোয় দুগ্গা ‘ট্রান্সজেন্ডার’

ওদের পুজোয় দুগ্গা ‘ট্রান্সজেন্ডার’

Monday October 19, 2015,

2 min Read

এপাড়ার প্রতিমা এতই বড় যে উঁকি দেয় আকাশে। ওপাড়া আবার গলা ছেড়ে বলে, ‘ওরে পাগল, মায়ের আবার বড় ছোট কী’? মোক্ষম প্রশ্ন, সুনিপুণ উত্তর, ঢাক-বাদ্যি, মন্ত্র-তন্ত্র, শঙ্খের আওয়াজে কলকাতায় এখন শুধুই দুর্গানাম। ভক্তিরসে হাবুডুবু। সদ্য পিচ ঢালা রাস্তা পিছলে যায় টুনি বাল্বের আলোয়। আনন্দনগরীতে কাশফুলের শোভা না থাকতে পারে, কিন্তু থিমের সাজে কমতি নেই। অমুক স্পনসর, তমুক বিজ্ঞাপনের দৌলতে পুজো যেন শিল্প। উড়ে যায় কোটি কোটি টাকা। এতসব আয়োজন, প্রচারের তীব্র আলোকবৃত্তের বাইরে কিন্তু কলকাতাতেই এবার লেখা ‌হয়ে গেছে এক নতুন ইতিহাস। উদ্যমী যুবকবৃন্দের পুজোয় দুগ্গা ট্রান্সজেন্ডার। অর্ধেক নারী, অর্ধেক পুরুষ। ভূ-ভারতে যা আগে হয়নি, তা প্রথম করে সাহসী খাতায় নাম তুলল উদ্যমী যুবকবৃন্দ।

ছোট একচালা প্রতিমা। ভুল বলা হল, প্রতিমা শব্দটা তো স্ত্রীলিঙ্গ, তাই একে মূর্তি বলাই ভাল। অর্ধেকটা তার নারীর শরীর। মায়ের মতোই শান্ত-শীতল। বাকি অর্ধেক পুরুষ। দীপ্ত পেশি, নাকের নীচে উঁকি দিচ্ছে পুরুষালি গোঁফ। এমন মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে যে কেউ হয়তো বলে ফেলবেন ‘আয়োজকদের বুকের পাটা আছে বটে।’ বিলেতের বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রেও এই পুজো নিয়ে জোর আলোচনা। জানা গেল, উদ্যমী যুবকবৃন্দের আড়ালে সলতে পাকানোর কাজটা করেছে রূপান্তরকারীদের এক সংগঠন ‘প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট’।


image


সাধারণ যুক্তি-বুদ্ধিতে আমরা ভাবি, পৃথিবীতে যা সংখ্যায় বেশি, সেটাই স্বাভাবিক। সেজন্যই হয়তো মেয়েলি পুরুষদের নিয়ে এত থাট্টা-বিদ্রুপ। যে মেয়ের আচরণ পুরুষালি, তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের মাথাব্যথা। হয়তো সেজন্যই উদ্যমী যুবকবৃন্দের পুজোকে সামনে রেখে রূপান্তরকামীরা বলতে চান, ‘তোমরাও স্বাভাবিক, আমরাও স্বাভাবিক। তোমরা যদি আমাদের অস্বাভাবিক বলে ভাব, তবে আমরা বলব তোমরাও অস্বাভাবিক। বিজ্ঞানের দৃ্ষ্টিতে, যুক্তির আলোয় দেখলে বুঝতে পারবে, রূপান্তরকামীরাও মানুষ। তোমাদের মতোই মানুষ।’

শুনতে শুনতে যেন ঘোর লেগে যায়। উদ্যমী যুবকবৃন্দের অর্ধনারীশ্বর মূর্তির হাতে অস্ত্র-শস্ত্র। পুরাণ অনুযায়ী, দেবতাদের অস্ত্রে সজ্জিত হয়েছিলেন দেবী দুর্গা। সুরাপানে তখন মহিষাসুর মত্ত। তাঁর চণ্ডরূপ প্রখর, প্রচন্ড। ছলে-বলে কৌশলে মহামহিম অসুরের বুকে শূল হানার জন্য দরকার ছিল নারীর মোহময়ী রূপ। তাই তিনি সৌন্দর্যের প্রতিমা। দরকার ছিল পুরুষের অস্ত্র, পুরুষের শক্তি। হয়তো সেজন্যই রূপান্তরকামীদের প্রথম পুজোয় দুর্গা হাজির নারী-পুরুষের সম্মিলিত রূপ নিয়ে।

নতুন চেহারায় এই দুর্গা মূর্তি। তাঁর পায়ে অঞ্জলি দিয়ে কী চাইবেন আপনারা? প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্টের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে যে উত্তরটা পাওয়া যাচ্ছে, তা এরকম, ‘এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে শুধুমাত্র পুরুষ কিংবা উচ্চবর্ণের হাতে। লিঙ্গ-ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে গিয়ে আমরা বলতে চাই, পৃথিবী হোক সব্বার। যে যেমনভাবে জন্মায়, সে তেমনভাবেই বাঁচুক। বাঁচুক মানুষের সম্মান নিয়ে। মানুষের অধিকার নিয়ে।’

জানি না রূপান্তরকামীদের প্রার্থনা ঈশ্বরের দরবারে মঞ্জুর হবে কিনা। তবে ভেদাভেদের প্রাচীর ডিঙিয়ে যে প্রার্থনা সব্বার কথা বলে, তা পবিত্র। এমন প্রার্থনা যেন ছড়িয়ে পড়ে মুখে-মুখে।