ওলা, উবার, জিপগো’র পর এবার রাইড শেয়ারিং এর দুনিয়ায় পা রাখল শুরুয়াতি সংস্থা লিফটো

ওলা, উবার, জিপগো’র পর এবার রাইড শেয়ারিং এর দুনিয়ায় পা রাখল শুরুয়াতি সংস্থা লিফটো

Friday November 20, 2015,

6 min Read

শুধু ওলা বা উবার নয়, বরং অন্যান্য বিবিধ সংস্থাও আজকে দেশের ‘রাইড শেয়ারিং’ এর বাজারে প্রবেশ করছে একটা লক্ষ্যকে মাথায় রেখে – দেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় যানজটের সমস্যার সুরাহা করা। এবং এই ব্যবসায়িক পরিসরে সদ্য পা রাখা এমনই এক সংস্থা হল লিফটো, যদিও শুরুয়াতি এই সংস্থাটি এজাতীয় অন্যন্যা উদ্যোগগুলির তুলনায় খানিক ব্যাতিক্রমী।কারণ শুধুমাত্র প্রাইভেট গাড়িই নয়, বরং লিফটোর সাহায্যে যাত্রীরা ট্যাক্সি বা অটোরিক্সার রাইডও বুক করতে পারেন।


image


অর্থাৎ যাত্রীদের কাছে লিফটো যেকোনো ধরনের গাড়ির রাইড বুক করার সুযোগ করে দিয়েছে। প্রাইভেট কার হোক, কিংবা ট্যাক্সি(ওলা, উবার, মেরু ও ট্যাবক্যাব) বা অটোরিক্সা, সমস্ত কিছুই বুক করা যাবে লিফটো মারফত। এবং অন্য কোনো উপভোক্তার গন্তব্য যদি একই রাস্তায় হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে তার সাথে রাইড শেয়ার করারও ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।

এই বছর সেপ্টেম্বর মাসে গড়ে ওঠা এই শুরুয়াতি সংস্থাটি প্রাথমিকভাবে তৈরি হয়েছে পোয়াই এবং তৎসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা, কিংবা যেসমস্ত মানুষ এই অঞ্চলে নিত্য যাতায়াত করেন, তাঁদেরকে পরিষেবা দেওয়ার জন্য। ২৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নিত্যযাত্রী, যাঁরা পরিবহন বাবদ দৈনন্দিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা খরচ করেন, সেই অংশকে মাথায় রেখেই পরিকল্পিত হয়েছে লিফটোর ব্যবসায়িক রুপরেখা।


গোড়ার কথা –

বিকেশ আগরওয়াল ও নিখিল আগরওয়াল বিগত কয়েকবছর যাবৎ বাস করছেন যথাক্রমে বেঙ্গালুরু ও মুম্বাইতে।দুজনকেই প্রতিদিন ৪৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার যাত্রাপথ অতিক্রম করতে হত। কিছুদিন কারপুলের ব্যবস্থা ব্যবহার করার পর দুজনেই উপলব্ধি করেন যে পরিবহনের এ ধরনের বন্দোবস্ত যাত্রীদের পক্ষে রীতিমত অসুবিধাজনক। “প্রথম কয়েকবারের পরই আপনার আর রাইড শেয়ারের ইচ্ছা থাকবেনা। হয় যাত্রাপথ আলাদা হবে, আর নয়তো সময় মিলবেনা। তাই আমাদের মনে হয় যে, বর্তমান ব্যবস্থাটাকেই যদি ‘রিয়েল টাইম বেসিস’ এ ‘রুট অ্যালগোরিদম’ ব্যবহার করে উন্নত করা যায়, তাহলে আমরা বাজারে একটা দাগ কাটতে পারব,” জানালেন বিকেশ।


সংস্থার কর্মীদলের গড়ে ওঠা –

কোর টিমের সদস্য , সংস্থার সিইও এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা নিখিল আইআইটি দিল্লি ও আইআইএম লক্ষ্ণৌ এর প্রাক্তনী্‌। পেশাগত ক্ষেত্রে রয়েছে নয় বছরের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং সেক্টরে কাজ করার অভিজ্ঞতাও। সংস্থার আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সংস্থার সিওও বিকেশ প্রথমে বিটস পিলানি ও পরে এআইএম ম্যানিলায় পড়াশোনা করেছেন। এছাড়া মার্কেটিং ও মিডিয়া সেলসে ছয় বছর কাজো করেছেন। এবং কোর টিমের আরেক সদস্য হলেন নন্ধা কুমার এস। এস আর এম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এই প্রাক্তনী বর্তমানে লিফটোর সিটিও। মোবাইল টেকনলজি ডেভেলপমেন্ট নিয়ে দশ বছরেরও বেশি কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।

“যেহেতু আমরা একটি শুরুয়াতি সংস্থা, তাই আমরা চাই যে আমাদের সাথে যাঁরা যুক্ত হতে চাইছেন, তাঁরা যেন খোলামেলা মানসিকতার অধিকারী হন এবং সহজেই নতুনের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হন। আমরা এমন কর্মী চাই যাঁরা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে পারবেন ও লক্ষ্যপূরণের জন্য নিজে থেকে এগিয়ে এসে কাজের ভার নিতে পারবেন,” বললেন বিকাশ।


প্রযুক্তি ও ভিন্নতা –

বিকেশের মতে, ওনাদের সংস্থার ইউএসপি হল ওনাদের তৈরি করা ‘রুট ম্যাচিং অ্যালগোরিদম’, যার উপর নির্ভর করে কাজ করে ওনাদের সংস্থার অ্যাপ। বিকাশ আরো জানালেন যে প্রযুক্তিগতভাবে বলিষ্ঠ ওনাদের এই অ্যাপ উপভোক্তাদের কাছে নির্দিষ্ট অবস্থান, পিক আপ পিয়েন্ট, ড্রপ পয়েন্ট ও রাইড ট্র্যাকিং মেকানিজম সংক্রান্ত তথ্য পৌঁছে দিতে সক্ষম। বিকেশের মতে, লিফটো ব্যবহারের অভিজ্ঞতা অ্যাপের মাধ্যমে ট্যাক্সি বুক করার অভিজ্ঞতার সমতুল্য।

যাত্রীদেরকে কেবলমাত্র নিজেদের গন্তব্যস্থল ও যাত্রার সময় জানাতে হয় অ্যাপ’ এ। এবং একই সময়ে একই পথে অন্য কোনো যাত্রী রয়েছে লিফটোর অ্যাপ সেটা এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই জানিয়ে দেয়। এবং পরে যে যাত্রী উঠছে, তাঁর বিস্তারিত প্রোফাইল, তাঁর পিক-আপ টাইম ও পিক আপ পয়েন্ট – এই সবকিছুই লিফটোর প্রথম যাত্রী আগাম জানতে পেরে যাবেন এই অ্যাপ মারফত। এবং যে যাত্রী পরে উঠবে, তাঁর ‘লিফট’ নেবার অনুরোধে আপনি রাজি হলে পর, তিনি গাড়িতে উঠলে কেবলমাত্র আপনাকে লিফটো অ্যাপে ‘স্টার্ট রাইড’ অপশানে ক্লিক করতে হবে।

অন্যদিকে যেসব যাত্রী পরে উঠছেন, অর্থাৎ যাঁরা প্রথমে ওঠা কোনো যাত্রীর থেকে লিফট নিচ্ছেন, তাঁদেরকে নিজেদের গন্তব্যস্থল জানাতে হয়। তাঁরা পছন্দমত গাড়ি(এসি, নন এসি, অটো প্রভৃতি) বাছাইয়ের সুযোগ পান এবং তাঁদেরকে সম্ভাব্য ‘ওয়েটিং টাইম’ জানিয়ে দেওয়া হয়। গাড়ি বাছাই হয়ে গেলে পরে উনি, যে ব্যাক্তি লিফট দিতে চাইছেন, তাঁর প্রোফাইল দেখতে পাবেন এবং নিজের পিক-আপ লোকেশান জানতে পারবেন। এবং নিজের পছন্দমত রাইড পেয়ে গেলে ওনাকে একটা রিকোয়েস্ট জানাতে হবে এবং উনি একজনের গাড়িতে লিফট পেয়ে যাবেন।


সূত্রপাত ও চাহিদা -

প্রাথমিক পর্যায়ে এই অ্যাপ ব্যবহারের সুযোগ পোয়াই এবং পোয়াই এর আশেপাশের অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিকাশ জানালেন, সকালের যাত্রীরা, যাঁরা পোয়াই থেকে বিকেসি, লোয়ার পারেল, নরিমান পয়েন্টের মত অফিসপাড়ায় যান, বা পশ্চিমের অন্যান্য শহরতলি অঞ্চলেরর দিকে যাতায়াত করেন, মূলত সেই অংশই এই পরিষেবার সুবিধা পান।“মুম্বাই এর এইসমস্ত অঞ্চলের অফিসগুলি থেকে বিকেলবেলা যেসমস্ত মানুষ ফেরেন, তাঁরা আমাদের অ্যাপ ব্যবহার করতে এবং ‘ম্যাচিং রাইড পার্টনার’ এর সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন,” জানালেন বিকেশ।

শহরের সবথেকে ব্যস্ত সময়, যখন অটো বা ট্যাক্সি পেতে যাত্রীদের সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়, লিফটো সেই ব্যস্ত সময়ে বিকল্প পরিষেবা দেয়। সপ্তাহের কর্মদিবসগুলির সবথেকে ব্যস্ত সময়েই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ লিফটোর পরিষেবা ব্যবহার করেন। এই সময়েই সবচেয়ে রাইড বুক হয়।

“এইমুহুর্তে শুধুয়াত্র গুগল্‌ প্লে-স্টোর থেকে লিফটো পাওয়া যায়, যদিও আমরা iOS ভার্সন বানানোর কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছি। আশা করা যায় জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে ওটাও চালু হয়ে যাবে,” বললেন বিকেশ।

প্রথম মাসের পরই লিফটোর কর্মীদল প্রত্যক্ষ করল যে ওনারা গড়ে প্রত্যহ ৫০ টি মত ‘ট্রানসাকশান’ পাচ্ছেন, এবং প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ রাইড পোস্ট হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ১৬৫০০’র থেকেও বেশি রাইড পোস্ট হয়েছে ওনাদের সিস্টেমে।লিফটো এইমুহুর্তে দৈনন্দিন ‘ট্রানসাকশান’ দ্রুত ১০০ তে পৌঁছানোর লক্ষ্যে এগোচ্ছে।


বিনিয়োগ ও ভবিষ্যৎ -

লিফটো টিম সম্প্রতি ৮৫ লক্ষ টাকার বিনিয়োগ যোগাড় করেছে। বিকেশ জানিয়েছেন যে, শুরুয়াতি ব্যবসার দুনিয়ার তাবড় কিছু সংস্থা তাঁদের সাহায্য করেছে।

এই সংস্থা সেন্ট্রাল মুম্বাই থেকে মার্কেটিং ও সংস্থার দৈনন্দিন কাজ নিয়ন্ত্রণ করলেও, আগামী বছর মার্চ মাসের মধ্যে ওনারা শহরের আরো বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের দফতর চালু করবেন। ওনাদের পরিকল্পনা রয়েছে ২০১৬ এর মাঝামাঝির মধ্যে দিল্লি/এনসিআর, বেঙ্গালুরু, পুণে, হায়দ্রাবাদ, কলকাতার মত বড় বড় মেট্রোপলিটান শহরগুলিতে নিজেদের সংস্থাকে লঞ্চ করার এবং তার দুবছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে পা রাখার।


আইনি দিক -

আমাদের দেশে একদিকে রাইড শেয়ারিং ও ট্যাক্সি/প্রাইভেট গাড়ি এগ্রিগেশানের ব্যবস্থা যেমন ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনই এই সংক্রান্ত সরকারি নীতির প্রণয়ন এই জাতীয় সংস্থাগুলির কাছে কিছুমাত্রায় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।জিপগোর মত সংস্থাকে যেরকম প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে, তাতে এই ধরনের সংস্থাগুলি কি আদৌ নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে? বিকেশ কিন্তু ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি জানালেন যে মোটর ভেহিকল অ্যাক্ট, ১৯৮৮ তে কারপুল, রাইড শেয়ারিং বা লিফট দেওয়া সংক্রান্ত কোনো ধারার উল্লেখ নেই। উনি আরো বললেন, এই আইন সরাসরিভাবে এজাতীয় পরিষেবার বিরোধী নয়।

এই আইনের ৬৬ নং ধারায় ‘কন্ট্রাক্ট ক্যারেজ’ ও ‘পাবলিক সার্ভিস ভেহিকল’(সেকশান ২, ৭ নং পয়েন্টে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে)সংক্রান্ত নিয়মাবলীর উল্লেখ রয়েছে। যেসব গাড়ি যাত্রী পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়, বা যেসব গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয় বা পারিতোষিকের বিনিময়ে পরিষেবা দেয়, সেইগুলি এই ধারার আওতায় পড়ে।

কিন্তু কারপুলিং এর ক্ষেত্রে, পুলকার হিসাবে ব্যবহৃত গাড়িগুলি এই আইনের আওতায় আসা উচিত নয়। কারণ, যে ব্যাক্তি লিফট দিচ্ছে, সে কেবলমাত্র নিজের গাড়িতে পরিবহণের খরচটা ভাগ করে নিচ্ছে আরেকজনের সাথে। এখান থেকে কোনোভাবেই তার পক্ষে নিজের জন্য লাভ করা, বা এটাকে একটা লাভজনক স্থায়ী ব্যবসায় পরিণত করা সম্ভব নয়। প্রাইভেট গাড়ি চালাতে কিলোমিটার প্রতি ১০ টাকার বেশি খরচ হয়, এবং গাড়ি চালিয়ে ১০ টাকার বেশি নেওয়া হলেই কেবলমাত্র সেটাকে ‘পারিতোষিক বাবদ প্রদত্ত মূল্য’র বিনিময়ে গাড়ি চালানো বলে অভিহিত করা যেতে পারে।


বাজারের অবস্থা -

তত্ত্বগতভাবে কারপুলিং এর মত ব্যবসা ‘শেয়ার্ড ইকোনমি’ এর আওতায় পড়ে। প্রাইসওয়াটার হাউসকুপারের একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্ববাজারে এর মোট অর্থমূল্য ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৫ এর মধ্যে এটাকে ৩৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসায় উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ভারতও এই বাজার অর্থনীতির থেকে যথেষ্ট মাত্রায় উপকৃত হবে। বিগত কয়েকবছরে মিবাডি, রাইডিংগো, পুলসার্কল বা কারপুল আড্ডার মত সংস্থাগুলিকে দেখা গেলেও ছবিটা পাল্টেছে ব্রাজিলিয়ান ট্রিপডা ও ফরাসী ‘ব্লাব্লা’র মত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি আসার পর থেকে। ভারতের বাজারে কারপুলিং এর প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গ চর্চায় উঠে এসেছে এর মধ্যে দিয়েই।



লেখক - সিন্ধু কাশ্যপ

অনুবাদ - সন্মিত চ্যাটার্জি