কাজু কিংয়ের একটা যুদ্ধ জয়ের কাহিনি

কাজু কিংয়ের একটা যুদ্ধ জয়ের কাহিনি

Friday July 01, 2016,

7 min Read

সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো এক রাজপুত্রের কাহিনি শুনব আজ। যে মার্সিডিজে চরে স্কুলে যেতো অথচ পকেটে একটা ফুটো পয়সাও থাকত না। বন্ধুরা দুয়ো দিত। কিন্তু বাবার শিক্ষাই ছিল এরকম। বাবা জনার্দন পিল্লাই চাইতেন ছেলে জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে মুখোমুখি দেখে বড় হোক। চাইতেন ধন ঐশ্বর্যের কোনও কুপ্রভাব যেন ছেলের ওপর না পড়ে। লোহা যেমন আগুনে পুড়ে পুড়ে ইস্পাত হয় তেমনই ইস্পাত হয়েছেন রাজমোহন পিল্লাই। পরবর্তী কালে যাকে সকলে কাজু কিং নামে চেনেন সেই রাজমোহন পিল্লাইয়ের কাহিনি আজ আপনাদের শোনাব আমরা।

image


কোটিপতি বাবাকে একদিনে নিঃস্ব হয়ে যেতে দেখেছেন। শ্রমিক দরদী আদর্শকে বিক্রি হয়ে যেতে দেখে ডুকরে উঠেছেন। সততার প্রতিমূর্তি বলে জানতেন যে দাদাকে তাকে গর্হিত অপরাধে গ্রেফতার হতে দেখেছেন। তিহার জেলের চার দেওয়ালের ভিতর রহস্যজনক ভাবে তাঁকে প্রাণ দিতেও দেখেছেন। তবুও নিজেকে হেরে যেতে দেননি। সামাজিক, পারিবারিক, আর্থিক কোনও বিপদেই বিচলিত না হয়ে উদ্যম-সাহস-ধৈর্যে ভর করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন রাজমোহন। ধারে দেনায় ডুবে থাকা বাবার সংস্থাকে দাঁড় করিয়েছে তিলে তিলে। বাবার ধার করা এক কোটি মার্কিন ডলারের পাই পয়সা চুকিয়ে দিয়েছেন। নিজের সংস্থাকেও দিয়েছেন আকাশ ছোঁয়ার মত শক্তি।

১৯৬৪ সালে কেরলে জন্ম। ছোটবেলা থেকেই একটি বিচিত্র শিক্ষার মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছেন রাজমোহন। যেমন বলেছি আগে, মার্সিডিজে চরে স্কুলে এলেও পকেটে পয়সা থাকত না। বন্ধুরা দুয়ো দিত। তাই বলে এমন ভাবার কারণ নেই যে দারিদ্ৰ আর বঞ্চনার শিকার হয়েছেন তিনি তাঁর শৈশবে। না বরং তিনি বড় হয়েছেন একটি নির্দিষ্ট নীতির ওপর ভর করে। বাবা চারটি কারণে পয়সা দিতেন। লেখাপড়ার জন্যে, টেনিস খেলার যেকোনও প্রয়োজনে, কোথাও যেতে হলে সেখানে থাকার খরচ আর চতুর্থ খেলা সংক্রান্ত যেকোনও প্রয়োজনে। ফলে তাঁর বয়সের অন্য বড়লোকের সন্তানদের মতো মজা করতে পারতেন না। ইচ্ছেমত খরচ করতে পারতেন না। তা বলে দামি আইসক্রিম পেতেন না এমন নয়। বাইরে গেলে পাঁচতারা হোটেলে থাকতেন না তাও নয় তবুও আপাত স্বাধীনতা ছিল না। তার ওপর ক্লাস টেনে যখন পড়তেন তখন থেকেই বাবার নির্দেশ মত বাবার কাজে সহযোগিতা করতে বাধ্য ছিলেন। ব্যবসা সংক্রান্ত সমস্ত ফোন ধরাটাই তখন কাজ ছিল। তারপর বাবার সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত সমস্ত মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতে হত। নীরব দর্শকের মত। বাবার পাশের চেয়ারে শান্ত সুবোধ বালকের মত চুপ করে বসে থাকাটাই তার তখনকার কাজ। একটু একটু করে বাড়তে থাকল দায়িত্ব। এবার জনার্দন পিল্লাই সাহেবের নির্দেশ হল রাজমোহনকে তাদের ফ্যাক্টারিতে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। খুব বিরক্তই হয়েছিলেন রাজমোহন। ওদের কাজু বাদামের কারখানা ছিল। সেখানে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করা মানে শ্রমিকদের সঙ্গে থাকা। কাজুর বস্তা ওঠানো নামানোর কাজে শ্রমিকদের সাহায্য করা। রীতিমত ঘাম ঝরানোর কাজ। বৃষ্টি পড়লে রোদে শুকোতে দেওয়া কাজু বাদাম তৎপরতার সঙ্গে তুলে আনা। প্রসেসিং এর কাজে সাহায্য করা। আর শ্রমিকদের সঙ্গে একই রকম খাবার ভাগ করে খাওয়া, একই রকম ভাবে মাটিতে ফরাস পেতে শোওয়া। একদিন এরকমই দুপুরের বিশ্রামের সময় শুয়েছিলেন মাটিতে। ঘুমচ্ছিলেন রাজমোহন আর ওর পাশে একটি সাপ এসে হাজির। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। ঘুম ভেঙে দেখেন সাপটা ফণা তুলে বসে আছে রাজমোহনের পাশে। চমকে যান রাজমোহন। কিন্তু বিচলিত না হয়ে খুব বেশি ভয় না পেয়ে ধীরে ধীরে সরে আসেন। সাপটাও ধীরে ধীরে চলে যায়। এসব শোনার পরও বাবা জনার্দন পিল্লাইয়ের মন গলে না। পরের দিন ফের শ্রমিকের কাজ করতে পাঠান। বাবার ওপর তখন রাগ হত রাজমোহনের। অভিমান হত। কিন্তু তবুও বাবার অবাধ্য হননি।

গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর প্রথম গুরু দায়িত্ব পেলেন রাজমোহন। ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাজু কেনার দায়িত্ব। মানুষের সঙ্গে কথা বলার অভ্যাস, মানুষকে সম্মান করার অভ্যাসগুলো এবার কাজে লাগতে শুরু করল। বাবার এতদিনের প্রায়োগিক শিক্ষার মানে বুঝলেন। এরপর বিদেশে পাঠানো হয় তাঁকে। কিছু দিন ব্রাজিলের একটি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় কাজ করেন। আমেরিকার সব থেকে বড় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ করাখানা ছিল ওটাই। সেখানে থাকার সময় বামপন্থী মত আদর্শের প্রেমে পড়ে যান। মনে হতে থাকে শ্রমিক স্বার্থের প্রশ্নে আরও উদার হওয়া জরুরি। দেশে ফিরে এসে এই নিয়ে বাবার সঙ্গে তার প্রায়ই তর্ক হত।

মুচকি মুচকি হাসতেন জনার্দন। কপট রাগ করতেন। একদিন ছেলেকে ডেকে একটি ঠাণ্ডা পানীয়ের কারখানার দায়িত্ব দিয়ে দিলেন জনার্দন। একটি বহুজাতিক সংস্থার জন্য ঠাণ্ডা পানীয় তৈরি হত। সম্প্রতি ওই কারখানাটি কিনেছিলেন জনার্দন। শ্রমিকদের বেতন ছিল দৈনিক ৭ টাকা। রাজমোহন বৈপ্লবিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওই কারখানার দায়িত্ব এবং মালিকানা পেয়ে প্রথমেই শ্রমিকদের বেতন তিনগুণ বাড়িয়ে দিলেন। আর বললেন তাঁদের কারখানায় যে পরিমাণ কাজ হচ্ছে তা ওই কারখানার ক্ষমতার ৪২ শতাংশ মাত্র। সেটা ৬০ শতাংশ করতে হবে। তাহলে ব্রেক ইভেনে পৌঁছনো যাবে। শ্রমিকদের কাজের পরিমাণ বাড়ানোর অনুরোধ করলেন। কিন্তু কী হল কিছু দিনের মধ্যে ওনমের সময়ে শ্রমিকরা তাঁদের বেতন আরও বাড়ানোর দাবি করতে থাকলেন। এইবার বিপাকে পড়লেন রাজমোহন। বললেন এমনিতেই লোকসানে চলছে কারখানা, যে টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে তা উঠে আসছে না, কাজের পরিমাণও বাড়েনি। এরকম পরিস্থিতিতে বেতন বাড়ানো সম্ভব নয়। আরও চাপ তৈরি করতে শুরু করে দিলেন শ্রমিকরা। এতটাই যে ভাঙচুর হল কারখানা। হরতাল ডাকলেন শ্রমিকরা। বৈপ্লবিক দরদী হতে গিয়ে দারুণ বিপাকে পড়লেন রাজমোহন। কিছুদিন পর শ্রমিকদের নেতা খবর পাঠালো। আলোচনায় সমস্যার সমাধান চান। এলেন। এবার বাবা পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজকীয় চেয়ারে। উল্টোদিকে শ্রমিক নেতা। পাশে শান্ত সুবোধ বালকের মত রাজমোহন। নীরব। কথা হল। ওরা চাইছিলেন অন্তত ৩০ টাকা হোক দৈনিক বেতন। জনার্দন সাহেব কঠিন ভাবে প্রত্যাখ্যান করে দিলেন। আলোচনা বিফল হল। শ্রমিক নেতা বাড়ি ফিরে গেলেন। আরও কিছু দিন পর আবার খবর এলো। একই বার্তা আলোচনায় সমস্যার সমাধান চান শ্রমিক নেতা। এবারও বাবা একই চেয়ারে। পাশে রাজমোহন। কিন্তু টেবিলের ওপর দশহাজার টাকার বান্ডিল। শ্রমিক নেতা কথা বলবেন কি, চোখ স্থির হয়েছিল ওই টাকার বান্ডিলের দিকে। বাবা শুরু করলেন। ১০ টাকা দৈনিক বেতনে কাজ করতে হবে। শ্রমিক নেতার মুখ চুন। বলতে শুরু করলেন একথা বলতে গেলে শ্রমিকরা তাকে খুন করে দেবে। একথা শোনার পরই আস্তে আস্তে টেবিল থেকে টাকা সরাতে শুরু করে দেন জনার্দন। আর শ্রমিক নেতার ভোল পাল্টাতে থাকে। ফ্যাকাসে হয়ে যায় মুখ চোখ বলতে থাকেন, আর একটু যদি বাড়িয়ে দেওয়া যায় ইত্যাদি। স্থির হয় সাড়ে পনের টাকা দেওয়া হবে দৈনিক মজুরি। শ্রমিক নেতার বিক্রি হয়ে যাওয়া দেখে বৈপ্লবিক ভাবনার রাজমোহনেরও হাল বেহাল হয়ে যায়। চোখের সামনে রাজনৈতিক আদর্শ ভাঙতে দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। বাবার কাছ থেকে আরও একবার শিখলেন কাউকে তার যোগ্যতার বেশি পাইয়ে দিতে নেই। বেতন বাড়িয়ে দিলেই শ্রমিকদের কর্ম কুশলতা বাড়ে না। কর্মচারীদের উৎসাহিত করলে, প্রেরণা দিলে কাজের পরিমাণ এবং গুণগত মান দুইই বাড়ে।

image


এরকম ভাবেই চলছিল জীবনের পাঠ। এর মধ্যে উপস্থিত হল একটি বিপর্যয়। ১৯৮২ সালের কথা রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক জটিলতার জেরে জনার্দনের সংস্থার কাছ থেকে রাশিয়ার কাজু কেনার কনসাইনমেন্ট ক্যান্সেল হয়ে যায়। আর তাতেই মুখ থুবড়ে পড়েন কোটি পতি উদ্যোগপতি জনার্দন পিল্লাই। ওভারসীজ ব্যাঙ্ক থেকে এক কোটি মার্কিন ডলার ধার নিয়ে ওই কনসাইনমেন্টের জন্যে বিনিয়োগ করেছিলেন জনার্দন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সমস্ত মাল নষ্ট হতে বসে। বিনিয়োগ ডোবে। রাতারাতি দেউলিয়া হয়ে যান জনার্দন। শারীরিক ভাবেও নিতে পারেন না এই বিপর্যয়। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ব্যবসা সামলানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। পরিবারের কাঁধে তখন এক কোটি ডলারের ধার। চ্যালেঞ্জটা নেন রাজমোহন, ব্যবসার বুদ্ধি, অকথ্য পরিশ্রম করে কোনও ক্রমে ধার চোকানোর চেষ্টা করছেন। ধীরে ধীরে টাকা শোধ করছেন। এরই মধ্যে সিঙ্গাপুরে একটি অপরাধে জড়িয়ে পরেন রাজমোহনের বড় দাদা রাজেন পিল্লাই। রাজেনও তখন অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী। আন্তর্জাতিক স্তরে বিস্কুট শিল্পে তিনিই তখন স্টার। লোকে বিস্কুট কিং নামেই তাঁকে জানে। সিঙ্গাপুর থেকে কোনও ক্রমে পালিয়ে চলে আসেন দেশে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান। গ্রেফতার হন। তিহার জেলে ছিলেন। সেখানে ১৯৯৫ সালে রহস্যজনক ভাবে তাঁর মৃত্যু হয়। পিল্লাই পরিবারের সে ছিল এক দুর্দিন। গোটা পরিবার ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। আত্মীয় স্বজনদের ব্যবহার বদলে যাচ্ছিল। পুরনো কর্মচারীরাও ভরসা হারিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। বন্ধু বান্ধবরাও এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। সেই দিশেহারা শোক সন্তপ্ত পরিবারের একমাত্র মেরুদণ্ডের মত ছিলেন ওই শান্ত স্বভাবের আপাত নীরব অথচ ইস্পাত কঠিন মনোবলের অধিকারী রাজমোহন।

১৯৮৭ থেকে ২০০৭ এই কুড়ি বছরের অনলস পরিশ্রমে বাবার সমস্ত দেনা চুকিয়ে দিতে সমর্থ হলেন তিনি। ব্যবসায়িক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর ব্র্যান্ড। বিটা গ্রুপ। ২ হাজার কোটি টাকার বিশাল সাম্রাজ্য তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। একা। বাবার শেখানো পথে হেঁটেই পরিবারের সুদিন ফিরিয়ে এনেছেন রাজমোহন পিল্লাই। আজ রাজমোহন পিল্লাই গোটা দুনিয়ার চোখে হাতে গোণা সফল ব্যবসায়ীর একজন। কাজু বাদামের ব্যবসার সাফল্যের জন্যে লোকে তাঁকে কাজু কিং নামে জানে। শুধু কাজু বাদামের ব্যবসা নয়, বিটা গ্রুপ এখন ফুড প্রসেসিং থেকে শুরু করে গোটা দুনিয়া জুড়ে এন্টারটেইনমেন্ট লজিস্টিকস এবং কনসাল্টিংয়ের ব্যবসা করে। এই এর পিছনে তাঁর লড়াই তাঁর লোহা থেকে ইস্পাত হওয়ার কাহিনি যারা জানেন তারা অন্যরকম অনুপ্রেরণা পান।

একটি অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে তিনি আমাদের বলছিলেন, পিতৃঋণ শোধ করতে গিয়ে তিনি যে শ্রম করেছেন, পারিবারিক ব্যবসা এবং নিজের ব্যবসা দুটোকেই সমান তালে বাঁচানোর অনলস চেষ্টা করেছেন সেটাই তাঁকে সাফল্য এনে দিয়েছে। এবং সব থেকে মজার কথা হল তিনি যখন ওভারসীজ ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করলেন, তখন ব্যাঙ্ক তাঁকে তাঁদের বাড়ি ঘর, জমি জমা সমস্ত সম্পত্তির দলিল দস্তাবেজ ফিরিয়ে দিল। যা তাঁর বাবা ধার নেওয়ার সময় ব্যাঙ্কে জমা রেখেছিলেন। যেটার সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না রাজমোহনের। হাতে কাগজ পত্র পেয়ে বাবার দেওয়া আশীর্বাদটা উপরি পাওনা হিসেবে পেয়ে গেলেন কাজু কিং।