দোলের অতিথি ‘সেবায়’ মোক্ষলাভ নবদ্বীপ, মায়াপুরের

দোলের অতিথি ‘সেবায়’ মোক্ষলাভ নবদ্বীপ, মায়াপুরের

Wednesday March 23, 2016,

3 min Read

ফাগের রঙে রঙিন গোটা বাংলা। এক পার্বণে এত রঙের বাহার আর দুটি পাওয়া ভার। এই রঙ শুধু হৃদয় নয়, দোলা দেয় অনেক ক্ষেত্রেই। এই যেমন নবদ্বীপ, মায়াপুর। দোল উৎসবে ভাগীরথীর এপার–ওপার অতিথিদের আপ‍্যায়নেই নিজেদের রুটি–রুজির পথ খুঁজে পায়। বসন্ত রাগে লক্ষ লক্ষ ভক্তের নগর পরিক্রমার সুবাদে দুই শহরের প্রায় সব শ্রেণির মানুষ সারা বছরের রোজগারের ব‍্যবস্থা করে ফেলেন।

image


বছরভরই এখন রং। ফাগুনে যা আরও গাঢ়। পথে পথে নেমে পড়ে ভক্ত ও পর্যটকদের দল। মহাপ্রভুর নাম নিয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে বেড়ানো। নামেই যে তাদের মোক্ষলাভ। মৃদঙ্গের তালে তালে আনন্দগানে ভুবন মুখরিত হয়। এটাই যে নবদ্বীপ, মায়াপুরের বসন্ত উৎসব। যেখানে দ্বিধা–দ্বন্দ্ব ভুলে সকলেই পথে নেমে পড়েন। একসঙ্গে হাঁটে কানাডা, কাকদ্বীপ। ভক্তের পরিচয় যে এখানে একটাই। বাস, ট্রেন, নৌকায় স্রোতের মতো মানুষ আছড়ে পড়ছে একবার মহামণ্ডল পরিক্রমার স্বাদ নিতে। মহাপ্রভুর স্মৃতি বিজড়িত নদীর পূব–পশ্চিমের শহর এখন ‘অতিথিদের’ নিয়ে মহাব‍্যস্ত।

দোল উৎসবের মূল আকর্ষণই হল মহামণ্ডল পরিক্রমা। পদব্রজে ছুঁয়ে যাওয়া শ্রীচৈত‍ন‍্যদেবের স্মৃতি বিজড়িত নানা লীলাক্ষেত্র থেকে শুরু করে নদীর পাড় থেকে মঠ, মন্দির। এই বিপুল দর্শনার্থীদের সুবাদে নবদ্বীপ, মায়াপুরের বানিজ‍্য চিত্রই বদলে গিয়েছে। সারা বছর আনাগোনা থাকলেও দোলের সময় পর্যটকদের এই মণ্ডল পরিক্রমার প্রবণতা দুই শহরের মানুষের রুটি–রুজিকে অনেকটাই সুরক্ষিত করেছে। দোল উৎসবের আগে পরে মিলিয়ে প্রায় মাস খানেক থাকেন দর্শনার্থীরা। তাদের প্রায় প্রত‍্যেকেই নবদ্বীপ, মায়াপুর থেকে কিছু না কিছু স্মারক কিনে নিয়ে যান। যার মধ‍্যে রয়েছে ইস্টদেবতার পোশাক, অলঙ্কার, কাঁসার বাসন, শাড়ি, দইয়ের মতো নবদ্বীপের নিজস্ব সামগ্রী। এর পাশাপাশি রাস্তার ধারে দোকানিরা পর্যটকদের আগমনে রোজগারের রাস্তা পান। এই একটা উৎসবেই রিক্সা, টোটো ওয়ালা, মাঝিরাও বাহন হয়ে সারা বছরের আয়ের পথ খুঁজে নেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র হয়ে ওঠা নবদ্বীপের মানুষের আর্থিক মোক্ষলাভ যাতে বছরভর হয় তার জন‍্য এবার যৌথভাবে উদ‍্যোগ নিয়েছে কয়েকটি সংগঠন। নবদ্বীপ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ, সনাতন সন্ত সমাজ ও চৈতন‍্য ভাবনামৃত সেবাশ্রম এবার এই পরিক্রমার জন‍্য ১৫ কিলোমিটার পথ নির্দিষ্ট করেছে। যা পঞ্চকোশী পরিক্রমা মার্গ নামে ঠিক করা হয়েছে। পথ নিদের্শক ফলকের মাধ‍্যমে ভক্তরা সহজেই এবার তাই পৌঁছে যাচ্ছেন এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস মহারাজ এই ব‍্যাপারে জানান, “সারা বছর যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভক্তরা সহজে পরিক্রমায় যেতে পারেন তার জন‍্য এমন সিদ্ধান্ত।”

পরিক্রমার নির্দিষ্ট পথ পেয়ে ভক্তদের পথের হয়রানি যেমন দূর হয়েছে তেমনই সহজ হয়েছে এক প্রান্ত থেকে আর প্রান্তে যাওয়া। দর্শনার্থীদের পাশাপাশি এর সুফল পুরোমাত্রায় পাচ্ছেন নবদ্বীপের সাধারণ মানুষ। টোটোচালক অজয় সরকারের কথায়, “এবার রুট ঠিক হওয়ায় অনেক বেশি মানুষকে আমরা পৌঁছে দিতে পারছি। দিনে পাঁচশো থেকে হাজার টাকা রোজগার কোনও ব‍্যাপারই নয়।” শুধু অজয় নন, পথের ধারে অস্থায়ী দোকানদারদের মুখে এই ভরসার কথা। তরমুজ, ডাব বিক্রি করে দিনে চার অঙ্কেরও বেশি বিক্রি হচ্ছে সহদেব মণ্ডলের। নবদ্বীপ স্টেশন রোড এলাকার এই ব‍্যবসায়ীর মতো বেজায় আনন্দে সিভিক ভলেন্টিয়ার রাজু মজুমদার। ভিড় সামলাতে গিয়ে পকেটও যে তার বেশ ভরছে। দোলের দু দিন আগে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ ভাগীরথী পারাপার করেছেন। দোল এবং হোলিতে সংখ‍্যাটা লক্ষাধিক ছাড়িয়ে যাবে।

নবদ্বীপের মতোই মণ্ডল পরিক্রমায় রঙিন মায়াপুর। ইস্কন নগরীতে এবার শুধু বিদেশি এসেছেন প্রায় পাঁচ হাজার। ইস্কন মন্দিরের মুখ‍্য জনসংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস বলেন, “দোলকে কেন্দ্র করে প্রত‍্যক্ষ–পরোক্ষভাবে মায়াপুরে কয়েক হাজারের মানুষ উপকৃত হন। ছোট দোকানদার থেকে হোটেল ব‍্যবসায়ী বা নিরাপত্তাকর্মী। সবার কাছে এটাই সেরা বাণিজ‍্য পার্বণ।” গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস মহারাজের কথাতেও সেই লক্ষ্মীলাভের ইঙ্গিত। তাঁর কথায়, “দোলের সময় ভক্তদের তিনবেলা খাওয়ানোর জন‍্য যে পরিমাণ সামগ্রী কিনতে হয় তাতেই অনেকের রোজগারের পথ খুলে যায়।” ৫৩১ বছর আগে দোলপূর্ণিমায় আবির্ভাব হয়েছিল শ্রীচৈতন‍্যদেবের। ভক্তসমাগমে চৈতন‍্যস্মৃতি টিকিয়ে রাখতে ১৭৬০সালে নরহরি চক্রবর্তী এই মণ্ডল পরিক্রমার সূচনা করেছিলেন। যার সুবাদে এখন নবদ্বীপ, মায়াপুরে ছোট, বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০০টি মঠ, মন্দির পরিক্রমার মানচিত্রে এসেছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে দুই শহরের অর্থনীতিতে।