ফুটবল উড়ল কল্যাণী থেকে বেইজিং, পার্থ এখন স্বপ্নের পাইলট

ফুটবল উড়ল কল্যাণী থেকে বেইজিং, পার্থ এখন স্বপ্নের পাইলট

Sunday February 28, 2016,

4 min Read

পার্থ আচার্য, পেশায় ছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিক। কাজ ছিল কলকাতার অডিও ভিজুয়াল চ্যানেলের হয়ে ফুটবল রিপোর্টিং করা। কলকাতারই অসংখ্য ফুটবল রিপোর্টিং করা সাংবাদিকদের মতো তিনিও ছিলেন একজন। কিন্তু পেশার সঙ্গে তাঁর মধ্যে একটা নেশাও ছিল। যে নেশা তাকে অন্য অনেক ফুটবলারদের থেকে আলাদা করে দিল। পার্থ আচার্য স্বপ্ন দেখতেন, যদি এই শহরের ফুটবলকে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দেওয়া যায়। তিনি স্বপ্ন দেখতেন যদি বিশ্বফুটবলের হিসেবে অনেক পিছিয়ে থাকা এই দেশের ফুটবলারদের মধ্যে অন্তত কিছু ফুটবলারকে যদি ফুটবলের মূলস্রোতে নিয়ে যাওয়া যায়। পার্থ বললেন, "ফুটবল কভার করতে করতে বুঝেছিলাম যে, সত্যিকারের কাজ করতে গেলে সাংবাদিক হয়ে কিছু করা যাবে না।"

image


এই ভাবনার প্রতিফলন ঘটল ২০১২ তে সাংবাদিকতার চাকরি ছেড়ে দিলেন। সামনে তখন অনিশ্চিত একটা জীবন। কিন্তু সেই অনিশ্চয়তার কথা তাঁর ভাবনাতেই নেই। এই দেশ ও এই রাজ্যের ফুটবল ও ফুটবলারদের জন্য কিছু কাজ করে যাওয়ার নেশায় তিনি তখন বুঁদ। চাকরি ছাড়লে এই কাজের জন্য যে অনেক সময় পাওয়া যাবে সেই আনন্দেই পার্থ মশগুল। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু সঈফুদ্দিনও। আরও জনা তিনেককে নিয়ে পার্থ আচার্য তৈরি করে ফেললেন একটি সংস্থা। ছোট্ট সংস্থা। কিন্তু তাঁর উদ্যম ও পরিশ্রমের গভীরতা এত বেশি ছিল যে পার্থ আচার্যের কাজের প্রতিফলন দ্রুত দেখতে পাওয়া গেল। তাঁর নিশানায় প্রথমেই এসেছিল কল্যাণী স্টেডিয়াম ও সেখানে খেলতে আসা কিশোররা। পার্থ বললেন, "কি অপরিসীম দারিদ্র্য ওই ছেলেদের। কিন্তু ফুটবলের বেসিক স্কিল নিয়েই অরা যেন জন্মেছে।" যে কাচকাটা হিরের কথা পার্থ বলছেন তাঁদের নিয়েই কল্যাণী পুরসভা তৈরি করেছিল কল্যাণী অ্যাকাডেমি। কল্যাণী পুরসভার চেয়ারম্যান নীলিমেশ রায়চৌধুরীরও প্রবল উৎসাহ এই খুদে প্রতিভাবানদের জন্য কিছু করার। জহুরীর চোখও তাঁর ছিল। না হলে তিনি পার্থ আচার্যকেই বা বলবেন কেন অ্যাকাডেমির ছেলেদের জন্য কিছু করতে?

সাংবাদিকতা করার সময় পার্থর একজন বন্ধু ছিলেন। শ্যানলং ডং। বেইজিঙয়ে তাঁর একটি স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট সংস্থা আছে। সেই চিনা বন্ধুর সাথে কথা বলে তাকে রাজি করালেন পার্থ। কল্যাণী অ্যাকাডেমির ছেলেদের অন্তত একবার বেইজিঙয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হল। ততদিনে পার্থর সংস্থা পুনেতে দুটি ছোট ছোট ফুটবল স্কুল চালু করে ফেলেছে। সেখানে রাখা হয়েছে দুজন করে কোচ। স্থানীয় বাচ্চারা সেখানে যায় ফুটবল শিখতে। কিন্তু কল্যাণী অ্যাকাডেমির প্রতিভাবান ফুটবলারদের নিয়ে চিনের মতো উন্নত ফুটবল দেশে যাওয়ার চেষ্টাটায় মৌলিক একটা পার্থক্য আছে। পার্থ বলছেন “কাজটা সহজ ছিল না। প্রথমত শ্যান লং কে রাজি করানো। দ্বিতীয়ত, ১৭ টা বাচ্চা আর তাদের সাথে তিনজন বড় মোট ২০ জনের বেইজিং যাতায়াত খরচ জোগাড় করাও একটা ব্যাপার ছিল। কল্যাণী পুরসভা তো সাহায্য করেছিল। কিন্তু আমাদেরও তো কন্ট্রিবিউট করার ব্যাপার ছিল।”

সেই অসাধ্য সাধন পার্থরা শেষপর্যন্ত করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তারও আগে, ২০১৩ তে পার্থর মাথায় আরও এক অসম্ভবকে সম্ভব করার তাগিদ তৈরি হয়েছিল। কল্যাণী স্টেডিয়ামটাকে যদি আন্তর্জাতিক মানের একটা স্টেডিয়ামে পরিণত করা যায়? সেখানেও পার্থ রাজি করালেন তাঁর চিনা বন্ধু শ্যান লং কে এবং কল্যাণী পুরসভার চেয়ারম্যান কে নিয়ে পার্থ উড়ে গেলেন বেইজিং। শ্যান লংয়ের উদ্যোগে দু’জনেই দেখলেন বেইজিঙয়ের আন্তর্জাতিক মানের বেশ কিছু স্টেডিয়াম। বিশেষত, শেনজেনের অলিম্পিক স্টেডিয়াম। ফিরে এসেই কল্যাণী পুরসভার চেয়ারম্যান রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রককে একটি প্রজেক্ট তৈরি করে জমা দিলেন। রাজ্য ক্রীড়ামন্ত্রক প্রায় আট কোটি টাকা জমা করেছিলেন সেই প্রোজেক্টের জন্য। কিন্তু শেনজেন স্টেডিয়ামের আদলে কল্যাণী স্টেডিয়াম তৈরি করতে তো অনেক খরচ, প্রায় কুড়ি কোটি টাকা। কোথায় পাওয়া যাবে ওই টাকা? পার্থ বলছেন, “কল্যাণী পুরসভার চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমরাও কোমর বেঁধে নেমে পড়েছি টাকা জোগাড় করতে। জানি, ২০১৬-র এই পণ্যজনীন সভ্যতায় সতকাজে আর্থিকভাবে সাহায্য করার লোক কম। তবু, কাউকে তো পাব।” এই তীব্র ইচ্ছা থেকেই কল্যাণীর খুদে ফুটবলারদের নিয়ে গতবছর পার্থর বেইজিঙয়ে যাওয়া। সেখানে গোটা চারেক প্রস্তুতি ম্যাচ খেলা ছাড়াও কল্যাণীর অনূর্ধ্ব ১৬ দলটি চিনের বিখ্যাত ক্লাব গুয়াংঝাউ এফ সি তে এক সপ্তাহ ট্রেনিং করেছিল। বিরল এই সুযোগের সঙ্গে আরও আকর্ষণীয় তথ্য আছে। অ্যাকাডেমির পাঁচটি ১৪ বছর বয়সের ছেলেকে চীনের ক্লাবের কোচ, যিনি একসময় চীনের জাতীয় দলেরও কোচ ছিলেন, বেছে নিয়েছেন এবং কল্যাণী পুরসভাকে গুয়াংঝাউ প্রস্তাবও দিয়েছে ওদের বয়স ১৭ হলে ওদের চিনে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য, ওখানে ওরা ফুটবল শিখবে। ওখানকার ক্লাবে খেলারও সুযোগ পাবে। তারপর একদিন আন্তর্জাতিক ফুটবলের মূলস্রোতে থেকে দেশে ফিরবে।

পার্থ আচার্য হাসছেন, বলছেন, “বিকাশ মুর্মুর নাম শুনেছেন? শোনার কথাও নয়। গুয়াংঝাউ যে পাঁচটি ফুটবলারকে পছন্দ করেছে তাদের মধ্যে একজন। দু’বেলা ভাল করে ভাত জোটে না ওদের। এত গরিব ওরা। অথচ পায়ে বল পড়লেই মনে হয় যেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতেছে। ওদেরকে ফুটবল বিশ্বে আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত একটা দেশের প্রথম সারির ক্লাবে পাঠালে কে উন্নত হবে? আমি না ওই ছেলেগুলো? কার লাভ হবে আমার না ভারতীয় ফুটবলের? তাই ছোট আকারে হলেও একটা সত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।” ফুটবলের জন্য সত্যিকারের কাজ হয়তো একেই বলে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, কল্যাণী স্টেডিয়ামের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কাজও কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছে।