সহানুভূতি নয় সুযোগ দিন, দাবি সমাজকর্মী অমৃতার

সহানুভূতি নয় সুযোগ দিন, দাবি সমাজকর্মী অমৃতার

Sunday July 23, 2017,

5 min Read

প্যাবলো পিনেদার নাম শুনেছেন? নেরুদা নন, টেনিদা নন। তবে পিনেদা কারও থেকে কমও যান না। ১৯৭৪ এ জন্ম। লেখক, সুবক্তা আর অত্যন্ত প্রতিভাধর স্প্যানিশ অভিনেতা। ২০০৯ সালে তার অভিনীত ছবি ইও তাম্বিয়েনের জন্যে সান সেবাস্তিয়ান আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা অভিনেতার সম্মান পান। তাঁর নিজের জীবনের সঙ্গে ছবির চরিত্রের এক গভীর মিল আছে। ওরা দুজনেই ডাউন সিন্ড্রোমের শিকার। দুজনেই ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েট। আর পিনেদা তো জীবন্ত কিংবদন্তি। ডাউন সিন্ড্রোমের সঙ্গে লড়াই করে তিনিই ইউরোপের প্রথম স্নাতক। এডুকেশনাল সাইকোলজি নিয়ে পড়াশুনো করেছেন। শিক্ষকতার প্রশিক্ষণের ডিগ্রি আছে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন মায়েলাগার মিউনিসিপালিটিতে। এখন অ্যাডেকো ফাউন্ডেশনের হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ান আর ডাউন সিন্ড্রোমে ভুক্তভোগীদের কিভাবে স্বাভাবিক জীবনে কাজে লাগানো যায় তাই নিয়ে মেতে আছেন।

image


স্পেনের পিনেদার সঙ্গে কস্মিনকালেও দেখা হয়নি কলকাতার অমৃতার। তবু তিনিও পিনেদার সঙ্গে একসারিতে বসার দাবিদার। কলকাতার মেয়ে অমৃতা রায় চৌধুরী। পড়াশুনো করেছেন অপ্টোমেট্রি নিয়ে। 

ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির এই ছাত্রী কাজ করেছেন এসএসকেএম হাসপাতালে। রাতদিন ঘেঁটেছেন চোখের সমস্যা নিয়ে আসা ডাউন-সিন্ড্রোমে ভোগা আবাল বৃদ্ধ বনিতাকে। মূলত সদ্যোজাত শিশুদের চিকিৎসা করেছেন দীর্ঘদিন। যত ওদের দেখেছেন ততই নিজেকে অসহায় মনে হয়েছে। গত চোদ্দ পনের বছর ধরে লড়াই চলছে অমৃতার। মাথায় ঘুরেছে একটাই ধাঁধা, মানসিকভাবে যারা আর পাঁচটা মানুষের মত নন তাদের জন্যে কি সত্যিই স্বাভাবিক জীবনে কোনও আসন পাতা নেই? অপাংক্তেয় সেই শ্রেণির শিশুদের জন্যে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করেছেন সবার আগে। তারপর শুরু হয়েছে নিজের মতো করে এই সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা। ২০১০ সালে একদল দক্ষ চিকিৎসককে সঙ্গে করে কলকাতাতেই শুরু করেন আর্লি ইন্টারভেনশন ক্লিনিক। তারপর সেই কাজ করতে করতে টের পান শুধু চিকিৎসা নয়, প্রয়োজন শিক্ষারও। যেসব শিশুদের মধ্যে ডাউন সিন্ড্রোম কিংবা জন্মগত মানসিক অস্বাভাবিকতা আছে তাদের জন্যে প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা। স্বাভাবিক শিশুদের মতো ওদেরও সুযোগ পাওয়ার সমান অধিকার আছে। কিন্তু এরকম স্কুল পর্যাপ্ত নেই। সেই অভাব-বোধ থেকে আরও এক পা এগিয়ে এলেন তিনি।

২০১৫ সালে খুলে ফেললেন তার স্টার্টআপ Transcendent Knowledge Society। অমৃতা বলেন অপরচুনিটি স্কুল। শারীরিক মানসিক সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে উৎরে ওর এই সোসাইটির বাচ্চারা পায় সুযোগ। স্বাভাবিক শিশুরা যে ধরনের পড়াশুনোর কারিকুলামের সঙ্গে পরিচিত এই বিশেষ শিশুদেরও সেই একই কারিকুলাম শেখানো হয় এই অপরচুনিটি স্কুলে। শুধু লেখাপড়া নয়। আছে ওদের সুকোমল বৃত্তিগুলো জাগিয়ে দেওয়ার জন্যে বিশেষ প্রশিক্ষণ। হাতের কাজ শেখানো হয়। ছবি আঁকা, নাটক, নৃত্য, গান সব শেখে এই শিশুরা। পাশাপাশি ভলিবল, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন এসবও শেখার সুযোগ আছে। শরীর ও মনের চর্চার এই কেন্দ্র তৈরি করতে অমৃতার বাবা অম্লান দত্ত তার জমানো সমস্ত পুঁজি দান করে দিয়েছেন অমৃতার এই মিশনে। মেয়ের ইচ্ছের প্রতি আবেগ প্রবণতা বশত নয়, অম্লান বাবুর মনেও দাগ কেটেছে মেয়ের কাজ। এবং সমানাধিকারের প্রশ্নটা। তাই লার্সেন অ্যান্ড টুব্রোর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সরাসরি জুড়ে গিয়েছেন মেয়ের সামাজিক এই উদ্যোগে। ফলে ও এখন একা নন।

এতদিনে ওঁর কাঁধে কাঁধ মেলানোর মতো অনেকেই হাজির হয়ে গিয়েছেন। বাবা তো আছেনই, এগিয়ে এসেছেন এক ফোটোগ্রাফার বন্ধু, অর্ণব আদক। অমৃতার স্বামীও ওঁকে দারুণ সহযোগিতা করেন। তিনি নিজেও ভিশন কেয়ার কনসাল্টেন্ট। ফলে ওর কাজের গুরুত্ব বোঝেন। অমৃতা বলছিলেন, লো ভিশন, লেজি আই এসব তো শারীরিক বিষয় কিন্তু একজন ডাউন সিন্ড্রোমের শিকার হওয়া মানুষের জীবনের লড়াইটা আরও একটু অন্যরকম। প্রথমত বাবা মায়েদের নানান হতাশা একটা জটিল জট তৈরি করে। পক্ষান্তরে তার প্রভাব পড়ে শিশুর মনের বিকাশে। তারা নিজেদের মেলে ধরতে পারে না। আরও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। অমৃতার কথায় ওরা অধিকাংশ সময়ই খুব ভালো থাকে। ভীষণই অনুগত। পাশাপাশি কিছু শেখালে সেটা আগ্রহ ভরে শেখে। শেখার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই সুযোগ পায় ক'জন।

সমাজ এদের সুযোগই দিতে চায় না। কতজন ভুগছেন এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কারও কাছে কোনও বিশ্বস্ত তথ্য নেই। সরকারি স্তরে আদৌ কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা তাও স্পষ্ট নয়। যেমন ধরুন পরিকাঠামোর প্রশ্নে রাস্তাঘাট, রেল স্টেশন, ট্রেনের কামড়া, বাসের সিট কোনওটাই এধরণের মানুষের কথা ভেবে তৈরি হয় না। কোনও পৃথক বন্দোবস্তও নেই। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এদের রুজি রুটির কী ব্যবস্থা করা যেতে পারে সে কথা ভাবার অবকাশ নেই রাজনৈতিক নেতা আমলাদের। অত: কিম?

লেমন ট্রি গ্রুপ অব হোটেলসের উদাহরণ দিয়ে বলছিলেন, ওরা রুম সার্ভিস সহ নানান কাজে ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত যুবক যুবতীকে নিয়োগ করেছে। অমৃতার আর্জি একই ভাবে অন্যান্য সংস্থারও উচিত এগিয়ে আসা। তাই SEGREGATION TO INCLUSION এই বিষয় ঘিরেই অমৃতার ভাবনা আবর্তিত। ভাবছেন এই সব শিশু এবং বয়স্কদের বিভিন্ন কারিগরি কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়াবেন। অমৃতার ভাবনায় ওরা কৃষি সংক্রান্ত কাজে দারুণ সাফল্য পেতে পারেন। কারণ পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে এমন কাজ শেখানো সহজ। আর ওরা সেটা দারুণ করতেও পারবে বলে অমৃতার বিশ্বাস। এদেরকে কী কাজে লাগানো যেতে পারে, কী ধরনের শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে, কোনও ভাবে কি এই ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্তদের উদ্যোগী করে তোলা যায়? সেই চেষ্টাও করছেন অমৃতা। ক্ষুদে পড়ুয়াদের কাছ থেকে সাড়াও পেয়েছেন ভালো। এই নিয়ে কলকাতায় আলোচনা চক্রেরও আয়োজন করেন তিনি।

এবার আবার বরং ফিরে আসি পিনেদা প্রসঙ্গে। পিনেদা নিজে একজন ভুক্তভোগী। স্পেন থেকে কম্বোডিয়ায় ভাষণ দিতে এসে গোটা দুনিয়াকে বলে এসেছেন যে ডাউন সিন্ড্রোমের আক্রান্তরাও পারেন এবং সামাজিক নানান ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ দেওয়া হলে স্বাভাবিক শিশুদের থেকে অনেক ক্ষেত্রেই ওরা এগিয়ে থাকবেন। আর এই সুযোগটাই দিতে চান কলকাতার এই মেয়ে। অহর্নিশ দিবারাত্র একই স্বপ্নে বিভোর, তাঁর সোসাইটির একটা বড় উঠোন হবে। খোলা আকাশ থাকবে। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে, অর্থনৈতিক বিকাশের হাত ধরে মানুষের মতো মানুষ হবে ওর বিশেষ স্কুলের বিশেষ পড়ুয়ারা।