প্রত্যন্ত গ্রামে অনলাইন শপিং? এখনও সেভাবে ভাবাই যায় না। তার প্রথম এবং একমাত্র কারণ-ভাষার বাধা। অনলাইন শপিং-এ আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার নেই বললেই চলে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় গ্রামের মানুষের মধ্যে ইংরেজি কজনই বা বোঝেন। তাই বলে শুধু ভাষার বাধাতেই এতবড় বাজার হাতের বাইরে পড়ে থাকবে? যেখানে চিনের মতো দেশ আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করে বাজার কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ঠিক এই বিষয়টিই ভাবিয়েছিল শ্রীধর গুন্ডইয়াহকে। সেখান থেকে ‘স্টোরকিং’-এর বীজ বোনা শুরু। আজ অনেকটাই মহীরুহ ‘স্টোরকিং’। ভাষার বাধা কাটিয়ে ই-কমার্সকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে শ্রীধরের ‘স্টোরকিং’।
ধরা যাক কর্নাটকের প্রত্যন্ত গ্রামের এক নব্য যুবক, পায়ে উজ্জ্বল হলুদ স্টাইলিশ স্পোর্টস সু, কলেজ যাওয়ার পথে সবার নজর কাড়ল। সে কিন্তু জানতে পারল না কিছু দিন পর তার আরও ১১৪ জন সহপাঠির পায়েও ওই একই পাটি জুতো দেখা যাবে। ঠিক তারপরেই প্রশ্ন হতে পারে, ‘কীভাবে এতগুলি ছাত্র একসঙ্গে এই ফ্যান্সি জুতোর সন্ধান পেল? ফ্লিপকার্ট, জাবং, মিন্ত্রা’? উত্তর হল, না। কিছু দিন আগের একটি সমীক্ষা বলছে, অনলাইন শপিং তো দূর, ৯১ শতাংশ গ্রামের মানুষ জানেন না ইংরেজিতে কীভাবে ঠিকানা লিখতে হয়। কর্নাটকের ওই গ্রামে সব তরুণের পায়ে একই ফ্যান্সি জুতো দেখা গিয়েছিল, তা একমাত্র সম্ভব হয়েছিল একটা ই-কমার্স ওয়েবসাইটের দৌলতে, যার ভাষা ছিল কান্নাড়া। নাম ‘স্টোরকিং’। বেঙ্গালুরুর এই ই-কমার্স মাতৃভাষার ব্যবহারকে জুড়ে গ্রামের লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনলাইন শপিংয়ের জগতে নিয়ে আসছে গত তিন বছর ধরে। ‘এটা সত্যিই দরকার ছিল। কিছু দিন আগে একটা সমীক্ষায় সেটা প্রমাণ হয়েছে’, বললেন শ্রীধর গুন্ডইয়াহ, ‘স্টোরকিং’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও।
শ্রীধরের নতুন কিছু করার প্রচেষ্টা এটাই প্রথম নয়। গ্র্যাজুয়েটের পর আইটি অ্যান্ড ই-কমার্সে লন্ডনের গ্রিনিচ ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর হয়ে তিনি ২০০৭ এ Yulop in নামে নিজের সংস্থা শুরু করেন। সেই সময় প্রথম, সংস্থাটি গ্রাহকদের এলাকা ভিত্তিক পরিষেবা দেওয়ার জন্য পরিচিত ছিল। ২ বছর পর ২০০৯ সালে Yulop in ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল আরও তৃণমূল স্তরে গিয়ে নানা জায়গার নানা সমস্যা, যেমন ভারতের গ্রাম্য এলাকায় প্রযুক্তির ব্যবহারের অভাব মেটানোর মত কিছু কাজ করতে হবে।
‘সেবার আমার চিনের ট্রিপে একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করি। সেখানে প্রায় সব জায়গায় পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম ম্যান্ডারিন,তাদের ভাষা। এই বিষয়টা আমাকে নাড়া দিয়েছিল। সব কিছুতে আঞ্চলিক একটা ব্যাপার রয়েছে। টেক্ট, ই-মেল, ই-কমার্স...সবকিছুতে, ‘স্টোরকিং’ এর আইডিয়া কীভাবে এল বলতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিলেন শ্রীধর।‘ স্টোরকিং’ লঞ্চ হয় ২০১২ র শুরুতে।
‘স্টোরকিং’ হল একটা ই-কমার্স ওয়েবসাইট যেখানে ৫০,৫০০ ধরণের জিনিসের ফর্দ রয়েছে। আমরা সাধারনত যে অনলাইন শপিং জাবং বা ফ্লিপকার্টে করে থাকি তার থেকে ‘স্টোরকিং’ আলাদা, কারণ এই ওয়েবসাইটে ইংরেজির কোনও ব্যবহার নেই। তামিল, তেলেগু, কান্নাডা, মালায়াম এই চার ভাষায় আপাতত অনলাইন শপিং হয়। সম্প্রতি গোয়ানও জুড়েছে সেই তালিকায়। ‘গ্রামের বাড়িগুলিতে ঠিকঠাক ঠিকানা থাকে না। মূলত, চিঠি বা যাই হোক পোস্টম্যান ঠিকানায় পৌঁছে দেন একমাত্র প্রাপকের পুরও নামের ভিত্তিতে। আমরা জানতাম, বাড়ি বাড়ি জিনিস পৌঁছে দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বিকল্প ভেবে ‘হাব অ্যান্ড স্পোক’ মডেলে চলার সিদ্ধান্ত নিলাম’, জুড়লেন শ্রীধর।
প্রথমের দিকে কাজটা সহজ ছিল না। গ্রামের খুচরো দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলা শুরু হল। হতে পারে মোবাইল অথবা অন্য কোনও ছোট দোকান, সেইসব দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে তাদের দোকানে ‘স্টোরকিং’ ট্যাবলেট বা কিয়স্ক কেনা এবং বসানোর জন্য বোঝাতে হল। যাদের বোঝানো সম্ভব হল তাঁদের প্রাথমিকভাবে ১০০০০ কম টাকা বিনিয়োগ করতে হবে ডিভাইস ইনস্টলেশনের জন্য। ‘আমরা গ্রামেরই এমন এক বিশ্বস্ত দোকানদারকে খুঁজে পেলাম যাকে স্থানীয়রাও ভরসা করেন। খদ্দেররা প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে ওই দোকানদারের কাছে আসবেন এবং পুরও টাকা দিয়ে যেতে দ্বিধায় ভুগবেন না’, বললেন শ্রীধর। ওই খুচরো ব্যবসায়ীই খদ্দেরকে অনলাইন শপিংয়ের সমস্ত ব্যবস্থা করে দেবেন। অর্ডার নিশ্চিত হলে ক্রেতা পুরও টাকা দোকানদারকে দিয়ে দেবেন এবং নিজের মোবাইলে ‘স্টোরকিং’ থেকে একটা এসএমএস পাবেন। ‘গ্রাহককে চিহ্নিত করতে আমাদের যেটা প্রয়োজন সেটা হল ফোন নম্বর। যা অর্ডার করলেন সেটি কখন পাবেন, কীভাবে পাবেন বিস্তারিত ওই নম্বরে জানাতে থাকি’, যোগ করেন শ্রীধর।
‘স্টোরকিং’-এর গুদাম রয়েছে বেঙ্গালুরুতে। অর্ডার হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জিনিস নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এই অনলাইন শপ। পণ্য সরবারাহের জন্য এফএমসিজি ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল ব্যবহার করে স্টোরকিং। শুরুতে কোনও প্রতিযোগী ছিল না। তাই গ্রাহককে বড় ডিসকাউন্ট দিয়ে আকর্ষণের ব্যাপারও ছিল না। অন্যদিকে খুচরো ব্যবসায়ী যার দোকানে কিয়স্ক বসেছে তিনি প্রত্যেক বিক্রিতে ৬ থেকে ১০শতাংশ কমিশন পান। ‘প্রত্যেকের জন্য এটা লাভজনক’, বলেন শ্রীধর।
‘আপনাদের হয়ত বিশ্বাস হবে না, ‘স্টোরকিং’ এ সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে বার্ধক্য রোধক ক্রিম। তারা এসে বলেন, ‘বিজ্ঞাপনের মাধুরী দিক্ষীতের মতো লাগা চাই’। প্রতিদিন ১০০ র মতো অর্ডার পড়ে ওই ক্রিমের। আর ভাবতে পারেন গ্রামের একটা বাড়িতে দুটো ডিশওয়াশার? একটা মায়ের একটা বউয়ের’,জানান শ্রীধর। গ্রামের মানুষ আরও যা কেনেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উন্নতমানের স্মার্টফোন। আইফোন-৬ এর অর্ডার তো রীতিমতো অবাক হওয়ার মতো।
গোটা দক্ষিণ ভারতে স্টোরকিংয়ের ৪,৫০০ কিয়স্ক রয়েছে।প্রতিমাসে ৭৫ হাজার অর্ডারের ডেলিভারি হয়। গড়ে এক এক জনের কমপক্ষে ৫০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকার অর্ডার পড়ে।
লুক্সেমবার্গের একটি ভিসি সংস্থা ম্যানগ্রোভ ক্যাপিটাল পার্টনার থেকে দফায় দফায় প্রায় ৬০ লক্ষ টাকার বিনিয়াগ ইতিমধ্যে তুলে এনেছে ‘স্টোরকিং’। সর্বশেষ ২০১৪ র ডিসেম্বরে আরও একদফা বিনিয়োগের টাকা ঢুকেছে সংস্থায়।
কয়েক মাসের মধ্যে মহারাষ্ট্র, গুজরাত এবং মধ্যপ্রদেশে ছড়িয়ে পড়তে চলেছে ‘স্টোরকিং’। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ৫০ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। ‘কারণ আমি জানি প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজোন পৌঁছানোর কোনও রাস্তা নেই, সেখানে আমরা পৌঁছে যেতে পারি’, শেষ করেন শ্রীধর