ঘুরে দাঁড়ানো ভারতের আত্মবিশ্বাসী পঁচিশটি বসন্ত

ঘুরে দাঁড়ানো ভারতের আত্মবিশ্বাসী পঁচিশটি বসন্ত

Saturday July 23, 2016,

7 min Read

আমি এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করতাম যেটা বামপন্থী আদর্শের জন্যই বিখ্যাত ছিল। আমি যখন ক্যাম্পাসে প্রথম এলাম, তখন মার্কসবাদ লেনিনবাদের জমানা। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন বিশ্বের প্রধান শক্তি। যদিও এটা যে টিকবার নয় তেমন ইঙ্গিতও বিস্তর ছিল। মিখাইল গোর্বাচেভ, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি তখন পেরেস্ত্রৈকার কথা বলছেন। সোভিয়েত দেশের রাজনীতি এবং সমাজকে পুনর্গঠন নিয়ে ভাবনা চিন্তা চলছিল। তখন কেউ ভাবতেই পারেননি এত দ্রুত হুড়মুড়িয়ে রাশিয়ার কমিউনিজম মুখ থুবড়ে পড়বে। তার সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট দেশ গুলোও ভেঙে যাবে। ভারতেও বামপন্থার মত আদর্শের প্রভাব ছিল। বেসরকারি করণের কথা যখন উঠত কিংবা বাজার অর্থনীতির প্রসঙ্গ উঠত তখন বেরিয়ে পড়ত দেশের বামপন্থী সত্ত্বা। তুমুল তর্ক হত তখন। তৃতীয় বিশ্বের দেশের জন্যে ভারত গর্বের সঙ্গে মিশ্র অর্থনীতির মডেলের হয়ে ওকালতি করত। সে এক দিন ছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালে যখন আমি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লাম তখন দেশের আলোচ্য বিষয় বদলে গিয়েছে। বাজার তখন আর অস্পৃশ্য নয়। বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। লাইসেন্সের বেড়া জাল আর পারমিটের নামে সরকারি রক্তচক্ষু থেকে থেকে একটু একটু করে মুক্ত হচ্ছিল দেশ। দেশের অর্থনীতি তখন মুক্ত হাওয়ায় ওড়ার জন্যে সেজে গুজে তৈরি।

image


আর আশির দশকের শেষের দিকে যখন জেএনইউ তে পড়তে এলাম তখন তো এসটিডি ফোন বুথই ছিল নতুন জিনিস। দিল্লির কোণায় কোণায় তখন ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে একের পর এক এসটিডি বুথ। ক্যাম্পাসে তখন রাত এগারোটার জন্যে সবাই অপেক্ষা করত। কারণ তখন রাত এগারোটা বাজলে এসটিডি রেট চার ভাগের এক ভাগ হয়ে যেত। তখন ফোন বুথের সামনে বিশাল লাইন পড়ত। এটা আমি মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ যুগের আগের কথা বলছি। এখনকার মত তো ছিল না, যে আপনি চাইলেই ফোনের স্ক্রিনে আঙুল ছুঁইয়ে দিলেন, আর দুনিয়ার যেকোনও প্রান্তের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারলেন। তখন ল্যান্ডলাইনে একটি শহরের সঙ্গে অন্য শহরকে জুড়তেই কয়েক ঘণ্টা কাবার হয়ে যেত। প্রথমত ট্রাঙ্ক কলের জন্যে সময় বুক করতে হত। আর প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর শুনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হত।

সেসময় হাতে গোণা এয়ারপোর্ট ছিল। দিল্লির কথা বলি, দিল্লির ট্রেন স্টেশন থেকে একটু ভালো পরিস্থিতি ছিল এয়ারপোর্টের। বুঝতেই পারছেন... কী বলতে চাইছি। আর পরিষ্কার হবে নাই বা কেন। তখন তো গুটিকয় শহর বিমান পথে যুক্ত ছিল। মধ্যবিত্তরা প্লেনে চড়ার কথা অতি সন্তর্পণে ভাবতো। খুব কম মধ্যবিত্তই সাহস পেত প্লেনের চড়ার বিলাসিতা করার। বিমানও কম ছিল। শুধু এয়ার ইন্ডিয়া আর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স। মাল্টিপ্লেক্স স্বপ্নেও ভাবিনি। সিনেমা হল গুলোয় একটাই স্ক্রিন হত। ছোটবেলায় মাত্র চারটে শোয়ের কথা জানতাম। নুন শো, ম্যাটিনি শো, ইভনিং শো আর নাইট শো। ১২টা থেকে ৩টে। ৩টে থেকে ৬ টা। ৬ টা থেকে ৯টা আর রাত ৯টা থেকে রাত ১২ টা। সিনেমা দেখাটা ছিল পরিবার নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার মত ব্যাপার। তখন কোনও কেবল টিভি ছিল না। শুধু দূরদর্শন ছিল। তাও আবার সপ্তাহে একদিন রবিবারেই সিনেমা হত। দূরদর্শনই ছিল টিভির খবরের একমাত্র উৎস। অন্য কোনও বেসরকারি টিভি চ্যানেলই ছিল না। খবর এমন একটা জিনিস কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হত। প্রাইম টাইমে এখন যেমন ডিবেট হয়, তখন এসবের প্রশ্নই উঠত না। অ্যাঙ্কার কী বস্তু তা জানতই না দেশ। তখন নিউজ পাঠকরাই টিভির পর্দা জুড়ে রাজত্ব করত। টিআরপির দৌড় ছিল না। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় কেবল নিউজ চ্যানেলের কথা শুনলাম। নাম সিএনএন। সেই প্রথম ভারত দেখল কাকে বলে লাইভ কভারেজ।

ভারতের অর্থনীতি তখনও বিকশিত হয়নি। গোটা বিশ্বের কাছে ভারত দরিদ্র দেশ হিসেবে গণ্য হয়। ভারত বলতে গোটা পৃথিবী জানত এটা সাধুদের দেশ, সাপুড়েদের দেশ এবং এই দেশের রাস্তায় গরু ঘুরে বেড়ায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার চাপে পরে চিড়ে চ্যাপ্টা একটা দেশ। কারণ তখন গোটা দুনিয়াটা ঠিক দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। দুটো আলাদা নীতি। দুটো দর্শন। একটা সাম্যবাদী পৃথিবী আর অন্যটা পুঁজিবাদী। তখনও ভারত একই রকম দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। বোফর্স কেলেঙ্কারিই তার প্রমাণ। কংগ্রেসের জন্যে এখনও এটা একটা কলঙ্ক হয়ে রয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি বদল হতে শুরু করেছিল ১৯৯১ সালে। যখন নরসিমহা রাও প্রধানমন্ত্রী হলেন, দেশটা তখন দেউলিয়া হওয়ার মুখে। আন্তর্জাতিক ধার চোকানোর ক্ষমতাও তখন প্রায় নিঃশেষিত। কঠিন পথে হাঁটতেই হত। বামপন্থার মডেল তখন আর কাজ করছিল না। মিশ্র অর্থনীতির ভারতীয় ফান্ডা ভীষণভাবে ফেল করেছিল। দেশের বাজার খুলে দেওয়া ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না। লাইসেন্স পারমিট রাজ যেতেই হত। নিজস্ব নিয়মেই বাজারকে বাজারের মত চলতে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপযুক্ত গ্রহণযোগ্য যুক্তি ছিল না। ফলে লাভ আর প্রতিযোগিতার নতুন দৌড় শুরু করল ভারত। এটা খুব সোজা ছিল না। একটা এতদিনের অভ্যস্ত নীতি বিশ্বাসকে সরিয়ে নতুন একটি পথে হাঁটাটা কঠিনই ছিল। সৌভাগ্যবশত কালের নিয়মেই মার্ক্স সাহেবের দেখানো আদর্শ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল। নরসিমহা রাও দৃপ্ত পা ফেললেন। অর্থমন্ত্রীর ভিতর থেকে একজন টেকনোক্র্যাটকে বের করে আনলেন। আমার মতে নরসিমহা রাওয়ের দাওয়াইটাই ছিল স্বাধীনতার পর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

সেই সময় আমি তরুণ রিপোর্টার। এখনও মনে আছে। গোটা দেশে সেদিন কী ঝড় উঠেছিল। তখন তো কম্পিউটারের বিরোধিতা হত। এমনকি সাংবাদিকদেরও বলতে শুনেছি কম্পিউটার এলে নাকি লোকেদের চাকরি চলে যাবে। বেকারি বাড়বে। তখন মগজ ধোলাই চলত, ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড, ওয়ার্ল্ড ব্যা ঙ্ক, ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন এসব নাকি পুঁজিবাদী এমন যন্ত্র যা দিয়ে দেশটাকে আবার পরাধীন করা হবে এবং পুঁজিবাদী ঊপনিবেশিকতার ভিতর ঠেলে দেওয়া হবে। বাজারকে রাক্ষস হিসেবে ব্যাখ্যা করা হত যা কেবল ধনী শিল্পপতিদেরই স্বার্থ রক্ষা করবে। বুদ্ধিজীবীরাই বলতেন বহুজাতিক সংস্থাগুলো নাকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মত ভারতকে আবার দাসে পরিণত করবে। এবং পরাধীনতার দিন এলো বলে। সে এক আজব সময় ছিল। নরসিমহা রাওকে আটকানো যায়নি। তিনি রাজনীতি সামলেছেন এবং মনমোহন সিংকে দায়িত্ব দিয়েছেন অর্থনীতি সামাল দেওয়ার। এই দুজনের জুটিটা ম্যাজিক করেছে। কিন্তু দলে একা পড়ে গেছেন নরসিমহা রাও। সাধারণ মানুষও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ভোটে হেরে গেছেন। কিন্তু ততদিনে দেশের অর্থনীতির রেলগাড়ি স্পিড ট্রেনের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তখন আর থেমে থাকার উপায় নেই।

এইচ ডি দেবগৌড়া এবং ইন্দ্রকুমার গুজরালের সরকারকেও মানতে হয়েছে সেই নীতি। যদিও দুজনের সরকারই বামপন্থীদের সমর্থিত ছিল। এবং মনে রাখতে হবে, দুটি বামপন্থী দলই বেসরকারি করণের বিরোধী ছিল। বাজপেয়ীর সরকার উড়েছে একই গতিতে তার সঙ্গে অটলজি জোর দিয়েছেন পরিকাঠামোর উন্নয়নের ওপর। ২০০৪ এ বাজপেয়ী যখন মানুষের আস্থা হারালেন তখন দেশের অর্থনীতির ইনডেক্স ঊর্ধ্বমুখী ছিল। সে বছর আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৯ শতাংশ। যেটা ২০০৮ এর বিশ্বের মন্দার সময়কে বাদ দিলে ২০১১ পর্যন্ত চলেছিল। এখন ভারতীয় অর্থনীতি দুনিয়ায় সব থেকে দ্রুততার সঙ্গে বাড়তে থাকা অর্থনীতি। যখন ভারত এগোয় তার প্রভাব পড়ে দুনিয়ায়।

আজকে আমি লিখছি কারণ আজ ভারত মুক্ত অর্থনীতির রজত জয়ন্তী বর্ষ উদযাপন করছে। গত ২৫ বছরে ভারতকে বদলাতে দেখেছি আমি। এখন আর ভারতকে কেউ গরিব দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে না। বরং ভবিষ্যতের সুপার পাওয়ার হিসেবে দেখছে গোটা দুনিয়া। নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণি উঠে এসেছে। আম আদমির ক্রয় ক্ষমতা অনেক গুণ বেড়েছে। বাইরে খাওয়াটা এখন আর বিলাসিতা নয়। এখন এটা অনেকেরই অভ্যাস। লোকজন এখন দামি দামি ব্র্যান্ডের জিনিস কিনছে। রোজ নতুন নতুন শপিং মল মাথা তুলছে। ভারত বিশ্বের সব থেকে বড় কনজিউমার হাব। ভারতীয় সংস্থাগুলি বিদেশে যাচ্ছে এবং বিদেশি ব্র্যান্ডকে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দিচ্ছে। ভারতীয় সিইওদের খুব চাহিদা। দেখুন না, গুগল, মাইক্রোসফট আর পেপসির মত বহুজাতিক সংস্থাগুলির সিইওরা সবাই ভারতীয়। সিলিকন ভ্যালি বিপ্লবেও ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

১৯৯১ সালে আমাদের প্রতিবেশী দের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকের কাছে গাড়ি ছিল। আর আজ সবার চারচাকা গাড়ি আছে। কোনও কোনও পরিবারে তো একটার বেশি আছে। ভারত এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী একটি দেশ। প্রতিযোগিতায় ভয় পায় না। আর কোনও বুদ্ধুও বলে না ভারত বহুজাতিকের দাস হয়ে যাবে। সারা পৃথিবীতে ভারতীয়রা সম্মান পান। এবং ভারত এখন বিনিয়োগের জন্যে সব থেকে পছন্দের ঠিকানা। বাজার এখন আর খারাপ শব্দ নয়। যদিও এখনও অনেক কিছু করার আছে। যেমন এখনও সিস্টেমের ভিতরই প্রচুর দুর্নীতি আছে। গরিব আর বড়লোকের মধ্যে পার্থক্যটা দিন দিন বাড়ছে। এখনও পরিকাঠামো অনেক জায়গাতেই ভালো নয়। এবং উন্নয়ন লাল ফিতে আটকা পড়ে আছে। ভারতকে যদি দুনিয়া জয় করতে হয় তবে এর শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের ওপর জোর দিতে হবে। আমাদের গণতন্ত্র এখনও জগঝম্প। কিন্তু আমাদের শেষ ২৫ বছরকে আমাদের দেশের আশা এবং আত্মবিশ্বাসের যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতেই পারে। আমি আশাবাদী। এমনকি এই উশৃঙ্খল সময়েও আমি একটা দুর্দান্ত ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি।