প্রযুক্তির ভারতে দাপুটে পঞ্চকন্যা

প্রযুক্তির ভারতে দাপুটে পঞ্চকন্যা

Monday September 07, 2015,

6 min Read

কে বলে প্রযুক্তিতে মেয়েরা পিছিয়ে? এটা ঠিক, মাঝ পথে পড়া ছেড়ে দেওয়া এবং বোর্ডের আসনের পরিসংখ্যান অন্তত সেরকমই বলছে। কিন্তু, জেনে ভালো লাগবে, দেশেই প্রযুক্তিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে কয়েকজন মহিলা রয়েছেন যাদের বুদ্ধি, দক্ষতা, অভিজ্ঞতায় ভর করে বড় বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলি বড় বড় মাইলস্টোন পেরিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার কর্মী তাঁদের অধীনে কাজ করেন। এই মহিলারাই এক একটি সংস্থার চালিকাশক্তি। প্রযুক্তি সংস্থাগুলিতে আসলে মহিলা সিইও-দের একটা যুগ তৈরি হচ্ছে, তাঁদের পাঁচ নেত্রীকে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই চলুন-

image



বিনীতা নারায়াণান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, আইবিএম ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড

image


বিনীতা নারায়াণান একাধারে আইবিএম ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার (আইএসএ) রিজিওনাল জেনারেল ম্যানেজার। ২০১৩র জানুয়ারিতে সংস্থার এতবড় দায়িত্ব পান বিনীতা। আইবিএমের সেলস, মার্কেটিং, পরিষেবা, ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে সরবরাহের প্রক্রিয়া, একই সঙ্গে বাংলাদেশ, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কাতেও সংস্থার দেখভালের দায়িত্ব তাঁরই কাঁধে। আইবিএমের সবচেয়ে দ্রুত বিস্তার ঘটছে ভারতে। সারা বিশ্বে সংস্থার সরবরাহ প্রক্রিয়ার কৌশলগত অবস্থান রয়েছে। ১৯৮৭ সালে আমেরিকায় আইবিএমে যোগ দেন বিনীতা। ২৫ বছরে নানা দেশের নানা রকম ক্লায়েন্ট বা খদ্দের সামলানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। ২০০৯ সাল থেকে সেলস অ্যন্ড ডিস্ট্রিবিউশন লিডার (বিক্রি এবং সরবরাহ) এবং সদ্য গ্লোবাল বিজনেস সার্ভিস (জিবিএস)এর ম্যানেজিং পার্টনার হিসেবে আইবিএম আইএসএ-এর ব্যবসা বাণিজ্যের নানা দিকের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিনি। তার আগে বিনীতা এশিয়া প্যাসিফিকের কমিউনিকেশন (যোগাযোগ) সেক্টরের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং আইবিএম টেলিকম সলিউশন অফারিং-এ গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সংস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং তার লাভজনক দিকটা নিয়ে যারা সর্বক্ষণ ভাবছেন সেই ইন্টিগ্রেশন অ্যান্ড ভ্যালু টিম যেখানে সংস্থারই চেয়ারম্যানের অস্থাভাজন সারা বিশ্বের পোড়খাওয়া সব গ্লোবাল এক্সিকিউটিভরা রয়েছেন, সেই দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বিনীতা। একের পর এক হার্ডেল টপকে গিয়েছেন মেধাবী বিনীতা। বাছা বাছা অভিজ্ঞদের নিয়ে তৈরি আইবিএম ইন্ডাস্ট্রি অ্যাকাডেমি যার কাজ হল আইবিএমের ব্র্যান্ড এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সংস্থার ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, সেই দলে ২০১২ সালে জায়গা করে নেন তিনি। আইএসএ-তে আরও ভালো নেতৃত্ব এবং বৈচিত্রের উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্বে রয়েছেন বিনীতা। পাশাপাশি মহিলাদের নেতৃত্বকে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলিও উৎসাহ দেয় তাঁকে। ২০১৩-১৪ সালে বিনীতা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (সিআইআই) এর সদস্য ছিলেন। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অ্যাডমিনেস্ট্রেশন ইন মার্কেটিং-এ স্নাতোকত্তর তিনি। তাছাড়া হাউসটন ইউনিভার্সিটি থেকেও বিজনেস অ্যাডমিনেস্ট্রেশন ইন ইনফরমেশন সিস্টেমে স্নাতোকত্তর ডিগ্রি রয়েছে তাঁর।

নীলিমা ধাওয়ান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, এইচপি ইন্ডিয়া

image


নীলিমা ধাওয়ান হেওলেট প্যাকার্ড ইন্ডিয়ার ম্যানেজিং ডিরেক্টর। সারা বিশ্বে এইচপি সার্ভিসেস (এইচপি সরবরাহ), পারসোনাল সিস্টেম (ব্যক্তিগত প্রক্রিয়া)এবং ইমাজিনিং অ্যান্ড প্রিন্টিং (ভাবা এবং ছাপা) সংস্থার আয়, লাভ এবং ব্যবসা বৃদ্ধি-এতকিছুর দায়িত্ব শুধু সামলানই না সফলভাবে সামলান নীলিমা। তাঁর দায়িত্ব মোটামুটি এইরকম-বিপিও (বাইরের কর্মী দিয়ে ব্যবসা সামলানো), সফওয়ার ইঞ্জিয়ার, রিসার্চ অ্যান্ড আইটি সার্ভিস - এককথায় একটি সংস্থার দেখভালের জন্য যা যা প্রয়োজনীয় সবকিছুর পাশাপাশি তিনি পুরও ব্যবসা কেমন হবে তার পরিকল্পনা এবং ভারতে এইচপিকে সবচেয়ে প্রশংসাজনক জায়গায় রাখতে ব্যবসায়িক দিক নির্দেশ এবং কর্পোরেটের দিকটিও দেখেন তিনি নিজেই। ২০০৫ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত নীলিম মাইক্রোসফট ইন্ডিয়ার ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। তাঁর সময়ে নীলিমা মাইক্রোসফটের দিশা আরও ক্ষুরধার করেছিলেন এবং ব্যবসা চালানো এবং তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, আর্থিক বৃদ্ধি, গ্রহকদের সুবিধা-অসুবিধা নানা দিক নিয়ে ভাবা-সব সামলেছেন দক্ষতার সঙ্গে। তারও আগে ভারতের বিভিন্ন অগ্রগন্য আইটি সংস্থা-এইচসিএল, আইবিএমে নিজের দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং ফ্যাকালটি অব ম্যানেজমেন্ট স্টাডিস থেকে বিজনেস অ্যাডমিনেস্ট্রেশনে স্নাতকোত্তর তিনি।


অরুণা জয়ন্তী,সিইও, ক্যাপজেমেনি ইন্ডিয়া

image


ক্যাপজেমিনি গ্রুপের একটা গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ক্যাপজেমিনি ইন্ডিয়ার চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার অরুণা জয়ন্তী। সংস্থার সমস্ত ব্যবসায়িক দিক সামলানোর ভার অরুণার কাঁধে। তিনি ভারতে ক্যাপ জেমিনির জন্য নানান পরামর্শ, প্রযুক্তি এবং বাইরের সংস্থাকে দিয়ে নিজের সংস্থার কাজ করানো এইসব বিষয়েসর্বক্ষণ নজর রাখছেন। মূলত ৪০০০০ কর্মীর এই সংস্থার আর্থিক এবং কাজের অগ্রগতির দিকটাও দেখতে হয় তাঁকে। ২০১১র জানুয়ারিতে ক্যাপজেমিনি ইন্ডিয়ার সিইওর পদে আসার আগে অরুণা ক্যাপজেমিনি আউটসোর্সিংয়ের গ্লোবাল ডেলিভারি অফিসার ছিলেন। সেই সময় তিনি সারা বিশ্বে ক্যাপজেমিনির আউটসোর্সিংয়ের মানোন্নয়ন, উৎপাদন বাড়ানো এবং মুনাফা বাড়ানোর দিকটি বেশ ভালোভাবেই সামলেছেন। আইটি সংস্থা এবং বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থায় দু দশক কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে অরুণার। বিভিন্ন গ্রাহক, গবেষক এবং সংস্থার কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা সারতে ইউরোপের বাইরে, উত্তর আমেরিকায় প্রায়শই যাতায়াত করেছেন। লক্ষ্য ছিল গ্রাহকদের চাহিদা এবং বাজারের অবস্থা বোঝা। সিইও হওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যে অরুণা ভারতের বাণিজ্য ক্ষেত্রে নিজের দক্ষতার ছাপ রেখে যাচ্ছেন। ২০১২য় ফরচুন ইন্ডিয়ায় ব্যবসায় সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০ জন মহিলার তালিকায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। বিজনেস টুডের তালিকাতেও পর পর দু বছর ব্যবসায় প্রভাবশালী মহিলার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। কিছুদিন আগে ইন্ডিয়া টুডে উইমেন সামিট ২০১৩য় ইন্ডিয়া টুডে উউমেন ইন কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড এ পুরস্কৃত হয়েছেন।

কীর্থিগা রেড্ডি, হেড অব অফিস, ফেসবুক ইন্ডিয়া

image


কীর্থগা ভারতে ফেসবুকের গ্লোবাল মার্কেটিং সলিউশান (সারা বিশ্বের ব্যবসা সংক্রান্ত)টিমের চালিকাশক্তি। আঞ্চলিক সংস্থা এবং গ্রাহকদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়া এবং তা ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ এ ফেসবুক ইন্ডিয়ার প্রথম কর্মী হিসেবে যোগ দেন কীর্থিগা। ভারতে সংস্থা পরিচালনার জন্য হায়দরাবাদে পরিকাঠামো তৈরি করেন। এখান থেকেই বিশ্বজুড়ে ফেসবুকের গ্রাহক, বিজ্ঞাপনদাতা বাড়ানোর যে প্রক্রিয়া তাতে নিজের অবদান রাখেন। ফেসবুকের আগে কীর্থিগা কনসিউমার সিকিউরিটি বিজনেস ইউনিটে এবং ফিন্ক্সি টেকনোলজির ভিপি এবং জিএম ছিলেন। আমেরিকা, ভারত, জাপান, কোরিয়া এবং তাইওয়ানে নানা সংস্থায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং কখনও মোটরোলার ডিরেক্টর অব প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট, কখনও সিলিকন গ্রফিক্সে ডিরেক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং, যুক্ত ছিলেন বুজ অ্যালেন হেমিলটনের সঙ্গে। সবচেয়ে বেশি সময় ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ায় সিলিকন ভ্যালিতে। বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী কীর্থিগা। শিক্ষাগত যোগ্যতার তালিকা বেশ লম্বা। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ, সেখান থেকেই তার আগে আর্য মিলার স্কলার হিসেবে স্নাতক হন, সিরাকাস ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ এমএস এবং ভারতে আম্বেদকর ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে বিই করেন। তিনি ফাস্ট কোম্পানির হানড্রেড মোস্ট ক্রিয়েটিভ পিপল ইন বিজনেস ২০১৩, বিজনেস টুডের হটেস্ট ইয়ংগেস্ট এক্সিকিউটিভ, ফরচুন ইন্ডিয়ার ভারতে ৫০ প্রভাবশালী মহিলার তালিকা, ইমপ্যাক্টের হানড্রেড আইকনস অব ইন্ডিয়া ডিজিটাল ইকোসিস্টেম এমন নানা ধরনের পালক রয়েছে তাঁর মুকুটে। কীর্থিগা ভরতের ইন্টারনেট অ্যান্ড মোবাইল অ্যাসেসিয়েশনের(আইএএমএআই) ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। শিশু এবং মহিলাদের উন্নয়নের নানা উদ্যোগ তাঁকে উৎসাহিত করে।

কুমুদ শ্রীনিবাসন, প্রেসিডেন্ট, ইনটেল ইন্ডিয়া

image


ভারতে ইনটেল ইন্ডিয়ার ব্যবস্থাপনার পুরও দায়িত্ব কুমুদ শ্রিনিবাসনের কাঁধে। মূলত ব্যবসা বাড়ানোর নানা কৌশল, স্থান নির্ভর কৌশল, সংস্থার উন্নয়ন, বাজার ধরার জন্য প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন নিয়ে ভাবনা চিন্তার পাশাপাশি সরকার এবং অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দক্ষ হাতেসামলান। কুমুদ আইটি ফর সিলিকনের ভাইস প্রেসিডেন্ট, সফটওয়ার অ্যান্ড সার্ভিসের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন যেখানে তিনি ইনটেল হার্ডওয়ার এবং সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের তথ্য-প্রযুক্তি সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান এবং পরিষেবা সরবরাহ করতেন।১৯৮৭ সালে ইনটেলে যোগ দেন কুমুদ। তখন থেকে ইনটেলেরই বিভিন্ন প্রস্তুতকারক এবং তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থায় ব্যবসা এবং তথ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নানা পদে ছিলেন। সিরাকস ইউনিভার্সিটিতে স্কুল অব ইনফরমেশন স্টাডিজের পরামর্শদাতা বোর্ডের সদস্য শ্রীনিবাসন। তিনি বেঙ্গালুরুর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির পরিচালন কমিটির সদস্যও। ইন্ডিয়া কাউন্সিল অব অনিতা বর্গ ইনস্টিটিউটে অনেক দিন কাজ করেছেন। ১৯৮১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হন।১৯৮৪ সালে সিরাকাস ইউনিভর্সিটি থেকে ইনফরমেশন অ্যান্ড লাইব্রেরি স্টাডিজ এ স্নাতকোত্তর। বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে তথ্য বিজ্ঞানে ডক্টরেট করেন।

মহিলা টেক সিইওদের এই নতুন অধ্যায় চলতে থাকবে। এরাই পথ দেখাবেন, উৎসাহ যোগাবেনষতাঁদের দেখে উদ্বুদ্ধ হবে সমাজ, সমাজ ব্যবস্থা। বাড়বে মহিলা সিইওদের সংখ্যা।