মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা মহানগরীকে লন্ডনে রূপান্তরিত করবার স্বপ্ন দেখিয়েছেন এই রাজ্যের মানুষকে। তবে, মেট্রো কলকাতার এমন বহু সমস্যা আছে, যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে কলকাতা পুরোপুরিভাবে সভ্য শহর হয়ে উঠবে না। এমনই এক সমস্যা কলকাতার পথের শৌচাগারগুলির হাল।
প্রয়োজনীয় শৌচাগার নেই সারা ভারতেই। কলকাতা শহরে মোটে ১৮০টির মতো পাবলিক টয়লেট আছে। দরকারের তুলনায় তা নগণ্য। তাছাড়া, শুধুমাত্র মহিলাদের ব্যবহারের জন্যে শৌচাগারের সংখ্যা নিতান্ত অল্প। পাবলিক টয়লেটগুলির অধিকাংশই যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণও করা হয় না। টয়লেটগুলিতে কাজ করেন যে সমস্ত কর্মী, তাঁরাও ওই নোংরা, দুর্গন্ধময় পরিবেশে জীবিকার কারণে থাকতে বাধ্য হওয়ায় নানা ধরনের অসুখে ভুগছেন।
কলকাতা শহরের পাবলিক টয়লেটগুলি নিয়ে মানবাধিকার কর্মী ময়ূরী ভট্টাচার্য গত কয়েক বছর ধরে গবেষণা চালাচ্ছেন। তার অভিজ্ঞতা একেবারেই সুখের নয়। ময়ূরী বললেন, ১৮০ টির মতো পাবলিক টয়লেট রয়েছে কলকাতায়। তার ৬০ শতাংশই পরিচালনা করে সুলভ শৌচালয়। বাকি ৪০ শতাংশের দেখভালের দায়িত্ব এই শহরের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির হাতে ন্যস্ত। পথচলতি মানুষের প্রয়োজন মেটাতে দরকার আরও বেশি সংখ্যক শৌচাগার। তবে, সে কাজে এখনও হাত পড়েনি। তাছাড়া, শহরের কোথায় কোথায় শৌচাগার রয়েছে, তার মানচিত্র থাকা উচিত। যাতে পথচারীরা প্রয়োজনের সময় সহজেই শৌচাগারটি চিনে নিতে পারেন। কলকাতায় সেই ব্যবস্থাও এখনও মানুষের কাছে অধরা। ময়ূরীর অভিযোগ, কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের কাছেও পাবলিক শৌচাগারগুলি সম্পর্কে দরকারি কোনও তথ্যই নেই।
সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হল, ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস। ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল, শৌচাগার। স্বচ্ছ ভারত মিশনকে কীভাবে আপামর মানুষের উপকারের কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির স্বপ্নের প্রকল্প স্বচ্ছ ভারত অভিযান। দিল্লিতে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সাম্প্রতিক ১০৩তম অধিবেশনে অংশ নিয়েছিলেন সুলভ শৌচাগার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা বিন্দেশ্বর পাঠকও। তিনি আশা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের মধ্যে সারা দেশে আরও ১২ কোটি শৌচাগার তৈরি করা হবে। এর ফলে প্রতিটি বাড়িতে একটি শৌচাগার থাকবেই। তাছাড়া, পথচারীদের জন্যেও প্রয়োজনীয় শৌচাগার ২০১৯ সালের ভিতর নির্মাণ করা হবে। ফলে, শৌচাগারের অভাবে খোলা জায়গায় মানুষের মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাস দূর হবে।
প্রয়োজনীয় সংখ্যক শৌচাগার না থাকায় এদেশের মেয়েরা বিপদে পড়ছেন। বিশেষত, গ্রামাঞ্চলে। বহু ক্ষেত্রে মেয়েরা ধর্ষণেরও শিকার হচ্ছেন। প্রতিটি পরিবারের একটি করে আধুনিক শৌচাগার থাকলে মেয়েরা আক্রান্ত হবেন না বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী ময়ূরী।
কীভাবে কাজ করেন ময়ূরী, তা জানতে চাইলে ময়ূরী বলেন, ইতিমধ্যে সারা কলকাতা শহরের বেতশ কিছু পাবলিক টয়লেট তিনি পরিদর্শন করেছেন। সেগুলি স্বচক্ষে দেখার পরে শৌচাগারগুলির হাল ফেরানো নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। তবে, আশার আলো তেমন দেখেননি। ময়ূরীর অভিযোগ, কলকাতা পুরসভা বেহাল শৌচাগারগুলির হাল ফেরানোর কাজে এপর্যন্ত বলবার মতো কোনও উদ্যোগ নেয়নি।
পথের শৌচাগার ব্যবহারকারীদের ভিতর পথচারীরা ছাড়াও রয়েছেন অন্যান্য বহু মানুষ। সরকারি হিসাব অনুসারে, ৬ থেকে ৮ লক্ষ মানুষ কলকাতা শহরের ফুটপাথে বসবাস করেন। সারা দেশের নানান জায়গা থেকে রুজির খোঁজে এই মানুষগুলি এখন কলকাতায় আশ্ৰিত। তার ভিতর রয়েছেন ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালা, ফুটের দোকানদার থেকে শুরু করে নানান পেশার মানুষজন। ফুটপাথের বাসিন্দাদের বেশিরভাগই জামাকাপড় কাচা, স্নান ও শৌচকর্মের জন্য পাবলিক টয়লেটগুলি নিয়মিত ব্যবহার করে থাকেন।
মানবাধিকারের প্রাক্তন ছাত্রী ময়ূরী কেন এই কাজটিই বেছে নিলেন, তা জানতে চাইলে ময়ূরী হাসতে হাসতে বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমার আবর্জনা ঘাঁটতে ভালোলাগে। সেই কাজটাই বড় হয়েও করছি। উদ্বেগজনক বিষয় এই যে, শৌচাগারগুলিতে সর্বক্ষণের যে কর্মীরা নিযুক্ত আছেন, তাঁদের ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা শৌচাগারের পূতিগন্ধময় পরিবেশ থেকে কাজ করতে হয়। স্বভাবতই, তাঁদের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে। এদিকে এই মানুষগুলির স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় এপর্যন্ত কোনও সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এ ব্যাপারে কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের কাছ থেকে কোনও সদুত্তর মেলেনি।
বলাবাহুল্য, ময়ূরী একাই এর হাল ফেরাতে পারবেন না। তবে, যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তিনি করেছেন, তা হল, চোখে আঙুল দিয়ে সমস্যাটি নজরে আনা।