লেফটেন্যান্ট কম্যান্ডার অভিলাষ টমি, নামটা আমাদের কাছে পরিচিত, ভারতীয় হিসেবে তিনিই প্রথম একা একবারও না থেমে জলপথে পৃথবীর পরিধি বরাবর পরিভ্রমণ করেন, পোশাকি নাম সোলো ননস্টপ সারকামনেভিগেশন অফ দ্য আর্থ। দুবছর আগের এই অভিযানে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ একা, তাঁর আগে গোটা পৃথিবীতে মাত্র ৭৮ জন এই অভিযান একা সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হন যার মধ্যে এশিয়া থেকে রয়েছেন একজন। সোলো ননস্টপ সারকামনেভিগেশনকে পৃথিবীর কঠিনতম অভিযানগুলির একটি বলেই গণ্য হয়। ২০১৩ সালে এই অভিযানটিই সফলভাবে শেষ করেন অভিলাষ। বইয়ের পোকা অভিলাষ একাধিক প্রতিভার অধিকারী, সে একজন ফটোগ্রাফার, জ্যোতিষবিদ্যায় পারদর্শী এবং একজন বিমান চালক।
ছোটবেলা থেকে অভিলাষ ছিলেন অন্তর্মূখী, কৌতুহলী এবং পড়াশোনায় উত্সাহী, রেজাল্টও করতেন ভাল। অভিলাষের বাবা নেভিতে চাকরি করতেন তাই সমুদ্রের প্রতি তাঁর টানটা এসেছিল স্বাভাবিকভাবেই। সমুদ্রে থার্মোকলের ভেলা ভাসানো থেকে জলপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ, পথটা সহজ ছিল না।
স্কুলের পর ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি, দুটিতেই পড়ার সুযোগ পান অভিলাষ, কিন্তু তিনি বেছে নেন নৌবাহিনীকে। বন্ধুদের সমর্থন ছিল না তাঁর এই সিদ্ধান্তে, বরং তাঁরা বলেছিল তুলনামূলক সহজ ও নিরাপদ কেরিয়ার বেছে নিতে। কিন্তু অভিলাষের মতে এটাই একমাত্র কেরিয়্যার যা তিনি বেছে নিতে পারতেন, ছোটবেলায় শোনা সমুদ্র অভিযানের গল্পে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন তিনি।
যে কোনও জিনিসের জন্য অপেক্ষার সময়টাকে সঠিকভাবে ব্যবহারে বিশ্বাস করেন অভিলাষ, “আমি একবার একটি বোট ক্লাবে গিয়েছিলাম, সেখানে সেইলবোট এবং জাহাজের মূল কাঠামো দেখে আমি এতই উত্সাহীত হয়েছিলাম যেটা সারাজীবন আমার সঙ্গে রয়ে গেছে। আমি সুযোগ পেলেই সেইলবোট নিয়ে পাড়ি দিতাম। বিমান চালানোর ব্যাপারটাও একইভাবে হয়েছিল। নেভি থেকে স্বেচ্ছাসেবকের খোঁজ করা হচ্ছিল আর আমি হাত তুলেছিলাম। আমি বিষয়টাতে এতটাই ডুবে গিয়েছিলাম, বিমান বাহিনীর সঙ্গে প্রশিক্ষণ ও পরে নৌবাহিনীতে কর্মী নিয়োগের সময় আমি ভাল করি। ফটোগ্রাফি, জ্যোতিষ ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাই, আমি অপেক্ষার সময়গুলোকে খুব ভালো ভাবে ব্যবহার করেছিলাম”।
প্রজেক্ট সাগর পরিক্রমা-শিক্ষা নবিশী
ভাইস অ্যাডমিরাল মনোহর আওয়াতি সাগর পরিক্রমা প্রজেক্টটির কথা প্রথম ভাবেন, তিনি চেয়েছিলেন কোনো ভারতীয় একা জলপথে পৃথিবী পরিক্রমা করুক। কম্যান্ডার ধোন্ধে প্রজেক্টির জন্য মনোনীত হন, লেফটেন্যান্ট অভিলাষ টমি নিয়োজিত হন প্রজেক্টে তাঁকে সাহায্যের জন্য। কম্যান্ডার ধোন্ধে অভিযান শেষ করেন এবং তা একটি সাফল্য হিসেবে গণ্য হয় তবে তাঁকে চার জায়গায় থামতে হয়। নৌবাহিনী থেকে ঠিক করা হয় আরও কঠিন অভিযান করা হবে, সাগরপরিক্রমা-২ এর ঘোষণা হয়।
অভিলাষ বললেন, “আমি যখন কম্যান্ডার ধোন্ধের সহকারী হিসেবে সাগরপরিক্রমা অভিযানে কাজ করি আমি বুঝতে পারি এটার গুরুত্ব কতটা, দেশের ইতিহাসে লেখা থাকবে এই অভিযানের কথা। আমি এতদিন অবধি নৌযাত্রা আর অভিযানে যা যা করে এসেছি তারই স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে এটিকে দেখি আমি। নৌযাত্রা আর অভিযানের ক্ষেত্রে এটি ভারতের সবথেকে বড় ঘটনা ও আমি যেন তাতে অংশ নেওয়ার জন্যই তৈরি হচ্ছিলাম”।
সাগর পরিক্রমা-২ এর প্রস্তুতি
নেভিতে কাজ করার দৌলতে স্বাভাবিকভাবেই একটা পর্যায়ের শারীরিক সুস্থতা ও সক্ষমতা ছিলই, পাশাপাশি প্রায় তিনবছর ধরে কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। “পোতাশ্রয় থাকা জাহাজে কাজ করার সময় প্রচুর ভারী জিনিস (১০০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত) তুলতে ও সরাতে হয় সারাদিনে, অনেকবার। আমি সহকারীদের দিয়ে না করিয়ে নিজে সেগুলি করতাম”, বললেন অভিলাষ। ২০১২ এর ১ নভেম্বর মুম্বই বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেন অভিলাষ। একা থাকাটা চ্যালেঞ্জ না হলেও এমন অনেক কাজ সেখানে করতে হয় যা একজনের পক্ষে করাটা কষ্টসাধ্য। বিমান চালনার শিক্ষা কীভাবে তাঁকে এই অভিযানে সাহায্য করেছে বলতে গিয়ে অভিলাষ বলেন, “যখন কেউ পাইলট হয় তাঁকে একটা শিক্ষা দেওয়া হয়, বলা হয় একজন ভাল পাইলট হওয়ার লক্ষণ হচ্ছে তুমি কখনোই এমন কোনো পরিস্থিতিতে পড়বে না যেখানে তোমাকে অসাধারণ কোনো দক্ষতা দেখাতে হয়। এটাই আমি আমার অভিযানের সময় মেনে চলি। খুব ভালো প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও আমি সবসময় সতর্ক ছিলাম যাতে কোনও হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে গভীর কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়”।
সমুদ্রের রোজনামচা
সমুদ্রের বুকে সারাদিন একা একজন কী করতে পারেন? অভিলাষ বললেন, “আমার রোজকার কাজ মোটামুটি ঠিক করাই ছিল। ঘুমের সময় আমি কখনোই ঠিক করিনি কারণ নৌযাটি তো সবসময়ই চলছে, যখনই প্রয়োজন ১৫-৩০ মিনিট ঘুমিয়ে নিতাম আমি। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই দিন শুরু হত। প্রথমে আধঘন্টার ধ্যান, তারপর এক গ্লাস দুধ বা ওরকম কিছু খাওয়া। এরপর আবহাওয়ার পূর্বাভাস ডাউনলোড করা ও সময় নিয়ে সেটা পর্যালোচনা। ৮টার সময় আমাকে নৌবাহিনীর কাছে একটি রিপোর্ট পাঠাতে হত, তারপর পুরো নৌযানটি ঘুরে সারাদিন কী কী কাজ করা দরকার সেটা ঠিক করে নেওয়া। সূর্য ডোবার আগেই আমাকে দিনের সব কাজ করে নিতে হত। ভারী কিছু জল খাবার খেয়ে যতটা সম্ভব কাজ এগিয়ে রাখতাম আমি। দুপুরের মধ্যে আমাকে কিছু পর্যবেক্ষণ করে নিতে হত। দুটো নাগাদ দুপুরের খাওয়া দাওয়া, এরপর সূর্য ডোবা অবধি কাজ। এরপর দ্বিতীয় কিস্তির আবহাওয়ার পূর্বাভাস আসত, রাত ৮টার মধ্যে আমাকে দিনের দ্বিতীয় রিপোর্ট পাঠিয়ে দিতে হত।
এরমধ্যে আমাকে ভিডিও ও স্টিল ছবি তোলা, ব্লগ লেখা ও ফেসবুকের পাতা চালানো, নৌযানটি চালানো, দিক ঠিক করা, জরুরি কথা জানানো, পথ পরিবর্তনের পরিকল্পনা, যন্ত্রপাতির দেখভাল ও মেরামতি ইত্যাদি সবই করতে হত”।
পথের চ্যালেঞ্জ
“সমুদ্রে হাওয়ার গতি কখনও কখনও সাইক্লোনে গতিবেগে পৌঁছতো, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি থেকে শূন্য ডিগ্রির নীচে চলাফেরা করত। আমি পৃথিবীর এমন জায়গা দিয়ে গিয়েছি যেখানে কোনও নিয়ম নেই, আইন নেই, ভগবান নেই বা সাধারণ জ্ঞানের আওতায়ও পড়ে না। কেপ অফ গুড হোপ যা গ্রেভিয়ার্ড অফ শিপ নামেও পরিচিত পরিক্রমার সময় একটি ঝড়ে পড়ি যাতে বায়ুর গতিবেগ ছিল ৭০ নটের বেশি এবং ঢেউয়ের উচ্চতা ১৫ মিটারের বেশি, বললেন অভিলাষ।
অভিলাষের সব থেকে স্মরণীয় মুহূর্তে প্রজাতন্ত্র দিবসের বিকেলে কেপ হর্ণ (গ্রেট কেপসের দক্ষিণতম অন্তরীপ, যা সাগরের এভারেস্ট নামে পরিচিত) প্রদক্ষিণ ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা
আগামী দিনে মাইক্রোলাইট এয়ারক্রাফটে আকাশপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণের পরিকল্পনা রয়েছে অভিলাষের।
যারা নিজেদের স্বপ্নপূরণের পথে হাঁটতে চান তাঁদের জন্য একটাই পরামর্শ অভিলাষের, “বিয়ে করবেন না”।
অভিলাষের আগামী দিনের জন্য শুভকামনা আমাদের তরফ থেকে।
অনুবাদ- সানন্দা দাশগুপ্ত