আকাশে উড়ন্ত কিছু দেখলে ছোটবেলা থেকেই চোখ চলে যেত ছেলেটার। উড়ন্ত ফড়িং, পায়রা, ঘুড়ি, কাক, চিল, সাবানের ফেনা খুঁজে বেড়াত চোখ দুটো। আকাশে প্লেন উড়লেই ছুটে চলে যেত মাঠে। একবার হেলিকপ্টার দেখে দারুণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে ও, তা দেখে বাবা বলেছিলেন, "এত তোকে আকাশ টানে! দুটো ডানা বরং তোর পিঠে ফেভিকল দিয়ে এঁটে দিই চল।" ওর যখন চোদ্দ কি পনের তখন প্ৰথম প্লেনে চড়িয়েছিলেন বাবা। গুয়াহাটি থেকে কলকাতা। ঘণ্টা খানেক আকাশ থেকে প্রথম পাহাড়, পর্বত, নদী, ঘরবাড়ি গেরস্থালী দেখেছিল। সেই প্রথম মনে হয়েছিল কেউ যেন সত্যিকারে ডানা গুঁজে দিয়েছে পিঠে। নিজেকে ফড়িং মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল আকাশেই কাটিয়ে দিতে চান গোটা জীবন।... সে অনেক দিন আগের কাহিনি। গল্পগুলো বলতে বলতে চোখ ছল ছল করে উঠছিল বিশ্বজিতের। বিশ্বজিত দে। অসমের গুয়াহাটির ছেলে। বাংলায় কোনও টান নেই। চেন্নাইয়ে এয়ারফোর্সের ট্রেনিং হয়েছিল, বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন সেখানে। তাই তামিলটাও দারুণ বলেন। প্রাণবন্ত ছেলেটার আকাশচারী হওয়ার স্বপ্নে একটা হোঁচট আছে। একটা বাম্পার।
স্বপ্নের উড়ান অনুযায়ী সব ঠিক ছিল। এরোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন। এয়ারফোর্সের চাকরি পর্যন্ত পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রেনিং চলাকালীন ভারী ওজন নিয়ে কোনও একবার ট্রেক করতে করতে পড়ে গেলেন। সে ছিল আকাশ থেকে পড়া। পায়ের নার্ভ, লিগামেন্ট দারুণ আহত হল। পড়ে থাকতে হল হাসপাতালের বিছানায় মাসের পর মাস। তারপর শারীরিক ভাবে জখম হওয়ায় নাকচ হয়ে গেল বায়ুসেনার চাকরি। আকাশ দূরে চলে গেল। আবারও মাটিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখা শুরু করলেন বিশ্বজিত। এতদিন ধরে পাইলট হওয়া শিখেছেন। হেলিকপ্টার সারাতে শিখেছেন। প্যারাগ্লাইডিং, গ্লাইডিং, এসবই ওঁকে টানত। আকাশে উড়ান দেওয়ার বিজ্ঞান, দুটো ডানায় ভর দিয়ে হুস করে উড়ে যাওয়ার ভারসাম্যের গণিত তার মগজের ভিতর ঘুরপাক খেত। আরও একটা জিনিস ঘুরপাক খেত সেটা হল দেশ। দেশের নিরাপত্তা, দেশের প্রতি গভীর প্রেম।
দুর্ঘটনার পর থেকে বিশ্বজিত হয়ে গেলেন সিভিলিয়ান। ওর সব শিক্ষাই অবান্তর হয়ে যেতে বসেছিল। কিন্তু আকাশ থমকে যায়নি। অনন্ত নীল আকাশ ওকে প্রেরণা দিয়েছে। আকাশটা ছুঁয়ে দেখার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে প্রতি নিয়ত। আর ওর ভিতরের যে প্রাণশক্তি ওঁকে দাঁড় করিয়েছিল হাসপাতালের বিছানা থেকে জীবনের কঠিন মাটিতে, সেই প্রাণশক্তিই ওকে সাহস দিল আকাশটা সত্যি সত্যিই ছুঁয়ে দেখার। অহমিকা-হীন বিনয়ী বিশ্বজিত স্থির করলেন আকাশে ওড়ার বিদ্যেটাই সকলকে শেখাবেন। আর এটাই হবে ওর স্টার্টআপ। স্টার্টআপ। শুরুয়াতি ব্যবসা। প্রথম যখন বাবাকে বললেন, বাবা তো অবাক। গোটা পরিবারে কেউ কখনও যা করেননি তাই কি করতে পারবেন আদৌ! গভীর ভাবনায় পড়লেন বাবা। কিন্তু বিশ্বজিত লক্ষ্যে অবিচল। গুয়াহাটি নয় কলকাতা থেকেই শুরু করবেন কাজ। এবার বিশ্বজিতের চোখ খুঁজতে শুরু করল আরেকটি ডানা। পেয়েও গেলেন। ছোটবেলার বন্ধু রীতেশ কানু।
রীতেশও অসমের ছেলে। Happy Child High School এর হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্ট হয়েছেন দুজনে। একসাথে খেলেছেন স্কুলের মাঠে। কাদায় ধুলোয় মাখা শৈশবের অঙ্গাঙ্গী বন্ধু। কিন্তু দুজনের পথ ছিল আলাদা। একজন ইঞ্জিনিয়ার তো আরেকজন বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ছাত্র। বিভিন্ন সংস্থায় সেলসের কাজ করেছেন। প্রোডাক্ট সেলসে দারুণ দক্ষ রীতেশ। কিন্তু নিজে কিছু করার ইচ্ছেটা ওঁকে তাড়িয়ে মারছিল। বন্ধুর ডাকে পেয়ে গেলেন সেই কিক। এই কিকটাই যেন খুঁজছিলেন। বিশ্বজিতের স্বপ্ন ওকে কিনে নিলো। এতটাই... যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দামি চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতেই গেলেন না। জীবনে ঝুঁকি নিলেন। এবং কেউ জানতেই পারল না নীরবে বিশ্বজিতের স্বপ্নের অংশীদার হয়ে গেলেন রীতেশ। এই দুই বন্ধু, পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় শুরু করলেন কাজ। আইডিয়াটা ছিল স্কুল কলেজের ছাত্রদের ড্রোন বানানো শেখাবেন। বই পত্তরের জ্ঞান নয় রীতিমত হাতে কলমে শেখাবেন। সেই থেকে শুরু। সালটা ২০১৪। কিন্তু কলকাতার স্কুল, কলেজ, ইন্সটিটিউট গুলিতে অ্যারো মডেলিং কী বস্তু সেটা বুঝিয়ে উঠতেই রীতিমত হিমসিম খান দুজন। জলের মত সঞ্চিত টাকা খরচ হতে থাকে। সময় যত যেতে থাকে ততই টের পান কলকাতায় এ ধরণের ব্যবসা করার হার্ডেলগুলো কী হতে পারে। ডুবতে থাকে স্টার্টআপ। আকাশে ওড়ার আগেই টার্বুলেন্স। ঠাণ্ডা মাথায় স্থির করেন স্ট্র্যাটেজি। এবার গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ার তাগিদ অনুভব করেন। আর এটা করতেই ক্লিক করে যায় আইডিয়া। কলকাতার চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে যেতেই আইআইটি গুয়াহাটি, এনআইটি সুরাট, ত্রিপুরা ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি, জোরহাট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মত দেশের বিভিন্ন নামজাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডাক পেতে শুরু করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয় ওদের অ্যারো মডেলিং এর ওয়ার্কশপ। হাতে করে ড্রোন বানানো যেমন শেখান ওঁরা তেমনি ড্রোনের কার্যকারিতা এবং ব্যবহার নিয়েও সচেতন করার কাজটা চালিয়ে যান। নিজে হাতে স্বয়ংক্রিয় বিমান বানানোর মজা পেয়ে যান ছাত্ররা। একবার ওয়ার্কশপ হলে আরও আরও ওয়ার্কশপের আবদার আসতে থাকে। কলকাতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে ঘুরে ঘুরে যেখানে জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে গিয়েছিল, মুখ থুবড়ে পড়ছিল বিশ্বজিত রীতেশের স্টার্টআপ সেখানে ঝাড়খণ্ড, ছত্তিসগড়, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, অসম সর্বত্রই দারুণ জনপ্রিয় ওদের সংস্থা এডুরেড।
ধীরে ধীরে বেড়েছে দল। এখন ওরা ১৭ জন তরুণ তুর্কির বাহিনী। গোটা ভারতে ছড়িয়ে আছে ওদের কর্মকাণ্ড। এখন গোটা দেশে এক সঙ্গে তিনটে ওয়ার্কশপ পুরো দমে চালাতে পারার ক্ষমতা রাখে এডুরেড। বিশ্বজিত চিফ টেকনিকাল অফিসার। রীতেশ সিইও। নীলাংশু পাণ্ডা মার্কেটিং দেখেন। তেইশ অনূর্ধ্ব বরুণ জোশি অ্যারো মডেলিং, শুভম বিলাওয়ার অ্যারিয়েল মার্কেটিং, প্রসাদ আগওয়ানে অটোমোবাইল এবং মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান দায়িত্বে আছেন। অধিকাংশই এসেছেন অন্য রাজ্য থেকে কলকাতায়। বাড়ি ভাড়া করে আছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ভাড়া বাড়িতেই চলছে অয়্যার-হাউস। ড্রোন বানানোর কাজ। রাতদিন টানা চলছে প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করানোর লড়াই। পুরস্কারও পেয়েছেন বেশ কয়েকটি।
রীতেশ বলছিলেন এটা ওদের বুট স্ট্র্যাপিং পিরিয়ড। মাত্র এক দেড় বছরেই ব্রেক ইভেন পেরিয়ে গিয়েছেন ওঁরা। এবার আড়ে বহরে বাড়ার সময়। এবার ওরা ফান্ডিং খুঁজছেন। চাইছেন আরও বেশি বেশি করে যোগাযোগ। চাইছেন আরও সমৃদ্ধ টিম।
বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে এগিয়েছেন সময়ে সময়ে। গাঁটছড়া বেঁধেছেন ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সঙ্গেও। এডুরেড সংস্থা যৌথ উদ্যোগে প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম বানাচ্ছে। পাশাপাশি চলছে ওয়ার্কশপের কাজ।
বিশ্বজিত বলছিলেন ওঁরা ছাত্রদের অ্যারোনটিকস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মৌলিক থিওরির পাশাপাশি হাতে কলমে সেটা বানাতেও শেখান। এর ফলে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাটা সম্পূর্ণ হয়। শুধু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রছাত্রীরাই নন এই প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন হাইস্কুল এবং কলেজ পড়ুয়ারাও। সামান্য কোর্স ফি।
যত দিন এগোচ্ছে ড্রোনের ব্যবহার বাড়ছে। নিরাপত্তার নজরদারির কাজে শুধু নয় ড্রোন এখন পেশাদার ভিডিওগ্রাফি এবং ফটোগ্রাফির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, ভৌগোলিক বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের কাজেও ড্রোন ব্যবহার হচ্ছে। ফলে ড্রোন পরিচালন করা এবং তা নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে। ড্রোনের গতিবিধি যেহেতু কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করা যায় তাই ড্রোন নিয়ে অনেক রকম বাণিজ্যিক পরীক্ষানিরীক্ষাও চলছে। শোনা যাচ্ছে অ্যামাজন গুগলের মত সংস্থা ড্রোন দিয়ে পার্সেল ডেলিভারির কাজ করাতে চায়। আইনি জটিলতা কেটে গেলে আপনার ছাদে আপনার অনলাইন শপিংয়ের অর্ডার ডেলিভারি করে দেবে আগে থেকে প্রোগ্রাম করা ড্রোন।
তবে কলকাতা আছে কলকাতাতেই। তবুও বিশ্বজিতরা কলকাতাকেই তাঁদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এই বিশ্বাসে, যে বদলে যাবে কলকাতার মানসিকতা, বদল আসবে এই শহরের অন্দরমহলেও। আর তখনই ঘুরে দাঁড়াবে কল্লোলিনী তিলোত্তমা।
Related Stories
July 12, 2017
July 12, 2017
July 12, 2017
July 12, 2017
Stories by Hindol Goswami