কর্পোরেট ছেড়ে মাঠে নেমে চাষে বিপ্লব জীতেন্দরের
Thursday November 05, 2015,
4 min Read
এক একটা এমন মুহূর্ত আসে যখন ঠিক জায়গা, ঠিক কার্যকারণ এবং ঠিক সময়-সব এক সূত্রে গাঁথা হয়ে যায়। জীতেন্দর সংওয়ানেরও তাই হয়েছিল। যে ধরনের চাকরি খুঁজছিলেন তেমন চাকরি তো পাচ্ছিলেন না। যা পেলেন সেটা হল আইসিআইসিআই লম্বার্ড এবং আভিভার মতো সংস্থায় দারুণ কর্পোরেট কেরিয়ার। নিজে একটা কিছু করবেন ভাবলেন, তবে কী করবেন ঠিক করতে পারছিলেন না। হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রে ঠোল গ্রামে পৈত্রিক ভিটেতে গিয়ে পেলেন তার উত্তর। ভাবতে লাগলেন চাষবাস শুরু করলে কেমন হয়? ‘যখনই ঠোলে গিয়েছি দেখতাম কৃষকদের মুখে হাসি নেই। তাঁরা চাইতেন না ছেলেমেয়েরাও চাষ করে বাঁচুক, কারণ তার কোনও ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন না’, মনে পড়ে জীতেন্দরের। যতই চাষবাসকে পেশা হিসেবে দেখার কথা ভাবছিলেন ততই বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছিল। যদি কর্পোরেট জগৎ ছাড়তেই হয়, তাহলে কৃষিকাজই একমাত্র বিকল্প। ঠিক করে নেন, জৈবচাষ বা অর্গানিক ফার্মিং শুরু করবেন।
একটাই সমস্যা ছিল, চাষবাসে জীতেন্দরের কোনও কালেই কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। তাঁর বাবা একজন আইএএফ অফিসার ছিলেন। জীতেন্দ্র পড়তেন কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে। পুনে সিমবায়োসিস থেকে এমবিএ করে কর্পোরেট জগতে ঢুকে পড়েন। স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মা, বন্ধুবান্ধ তাতে সায় দেন। ‘আমি শুধু কেরিয়ারই ছেড়ে দিইনি, গ্রাম গিয়ে থাকতে শুরু করি। বিদু্ৎই নেই, ইন্টারনেট তো ভুলে যাওয়ায়ই ভালো’, হাসেন জীতেন্দ্র।
২০১৩র নভেম্বরে ১ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে অনুবাল অ্যাগ্রো প্রডাক্ট প্রাইভেট লিমিটেড শুরু হয়। লক্ষ্য ছিল জৈবচাষ এবং চাষের উৎপাদন সরাসরি কুরুক্ষেত্রের ফার্ম থেকে দিল্লির ঘরে ঘরে যাবে। যখন রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করে প্রথাগত চাষ চলছে আশেপাশে, তখন জীতেন্দ্রর বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নানা রিসার্চ করে জৈবচাষ সম্পর্কে জ্ঞান বাড়ানো। সব আস্তে আস্তে এগোচ্ছিল। ঠিক পথেই এগোচ্ছিল। আনুবলে চাষের কাজ যেমন এগোচ্ছিল তেমনি দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় নানা স্তরের মানুষের কাছে ফার্মের ফলন বিক্রি হচ্ছিল। আনুবাল অ্যাগ্রোর মূল লক্ষ্য ছিল ভারতে জৈবচাষের প্রচার এবং ইকোসিস্টেম তৈরি করা। এর ফলে রাসায়নিক সার, ফলন দ্রুত বাড়ার ওষুধ এবং কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই স্থায়ীভাবে ভালো ফলন উৎপাদন করা সম্ভব হয়। জীতেন্দররা চান, সব জায়গার মানুষের কাছে খাঁটি জৈবখাদ্য পৌঁছে দিতে। এবং তার মাধ্যমে অন্যান্য কৃষকদের জৈবচাষে উৎসাহিত করা।
গতানুগতিক চাষিরা মান্ডি, কীটনাশক এবং ঋতু পরিবর্তনের উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। যদিও শহুরে ভারতীয়রা জৈব ফলনকে বেশি করে গ্রহণ করতে শুরু করছেন। উচ্চমানের স্বাস্থ্যকর খাবার চান তাঁরা। এরই প্রেক্ষাপটে জীতেন্দর চেয়েছিলেন রাজ্যের কৃষকদের জৈবচাষে উৎসাহিত করতে। তার জন্য বিনামূল্যে বীজ এবং পরামর্শ দেন তিনি। জীতেন্দরের দাবি, প্রথম কয়েক বছর কম ফলনের জন্য নিজেদের ফান্ড থেকে বাজার দরের উপর ১০ শতাংশ চাষিদের দাম দেওয়া হত। ‘আমাদের প্রতিযোগীদের চেয়ে ২০-৩০ শতাংশ কম দামে আমরা পন্য বিক্রি করি। যেহেতু এর মাঝখানে কোনও ফড়ে নেই, মার্কেটিং-ব্র্যান্ডিংয়ের কোনও খরচ নেই, ফলে তার সুফল পান ক্রেতারা। বীজ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে কৃষকের ওপর চাপ কমে এবং জৈব ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করে। উৎসাহী চাষিদের সঙ্গে আমরা ১০ বছরের চুক্তি করছি। একই সঙ্গে আমাদের লাইসেন্স দিয়ে তাদের জমি প্রত্যায়িত করা হয়েছে’।
অনুবাল নানা ধরনের শস্য ফলায়। এরপর সেটাকে প্রসেস এবং প্যাকেজিংয়ের পর বাজারে ছাড়ে। গম, গমের আটা, মাষকলাই, লালআলু, ডালিয়া হচ্ছে তাদের মধ্যে অন্যতম। যেটা উল্লেখ করার মতো সেটা হল, অনুবাল সরাসরি ভোক্তার কাছে পন্য সরবরাহ করে। আপাতত সপ্তাহের শেষে বিভিন্ন জায়গায় কিয়স্কে বিক্রি করা হয়। কোনও স্থায়ী কর্মী নেই।সবটাই ঠিকাদারদের দিয়ে করানো হয়। সপ্তাহান্তে বিক্রির হিসেবটা এরকম-ডাল-২ থেকে ৩ কুইন্টাল, আলু-৪ থেকে ৫ কুইন্টাল, চাল-২ থেকে ৩ কুইন্টাল, গম-৫ থেকে ৬ কুইন্টাল, চালের আটা-১ থেকে ২ কুইন্টাল এবং ডালিয়া-৫০কেজি থেকে ১ কুইন্টাল।
‘চাষের প্রচলিত ধারা একেবারে পালটে দিয়েছি আমরা। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করি কোনও মধ্যসত্তভোগী ছাড়াই। ভারতের চাষিরা এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চাইছিলেন। কিন্তু সরকার এবং কর্পোরেট হাউসগুলির সাহায্য ছাড়া এটা সম্ভব নয়’, জীতেন্দরের ব্যাখ্যা। ‘গোটা প্রক্রিয়া থেকে ফড়েদের বাদ দিলে গ্রাহকদের সঙ্গে কৃষকদের সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয় এবং ক্রেতারা চাইলে আমাদের ফার্মেও আসতে পারেন। এটা আগে কখনও হয়নি। আমার ধারনা এই প্রক্রিয়া ভারতীয় কৃষিব্যবস্থাকে আমূল পালটে দেবে। কারণ এর ফলে কৃষকের জীবনমানের উন্নতি ঘটবে এবং চাষকে পেশা হিসেবে পুরনো জায়গায় ফিরিয়ে আনা যাবে’, বলেন তিনি।
ভারতের বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায় আমরা কৃষকদের মধ্যে প্রায়শই আত্মহত্যার প্রবণতা দেখি। এই অবস্থায় কোনও নতুন ব্যবস্থা চালু করা বেশ কঠিন। বিশেষ করে কোনও আর্থিক এবং সরকারি সহযোগিতা ছাড়া নিজেদের ব্র্যান্ডে জৈব ফলন সরাসরি গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। কৃষকদের উৎসাহিত করতে এবং বড় বড় সংস্থাগুলিকে পথ দেখাতে পারে অনুবালের মতো ভেঞ্চারই।
৮০ শতাংশেরও বেশি বেশি অর্ডারের পুনরাবৃত্তি হয়। সেখান থেকেই এবার অনুবাল পরিকল্পনা করছে এশিয়া এবং ইউরোপের বাজারেও হাজির হওয়ার। ভারতের মধ্যে মুম্বই, বেঙ্গালুরু, পুনে, হায়দরাবাদ এবং কলকাতার মতো মেট্রো সিটিতে জৈবফলন থেকে তৈরি নানা খাবার যেমন, কর্নফ্লেক্স এবং অন্যান্য ব্রেকফাস্ট সিরিজ, নুডুলস, পাস্তা, জুস, মসলার মতো প্রসেসড ফুড চালুর ইচ্ছে রয়েছে। ২০১৬য় ৫০ লক্ষ টাকা রেভিনিউ আসবে বলেই ধারণা সংস্থার কর্ণধার জীতেন্দর সংওয়ানের।