শিক্ষার আলোয় গ্রামের জীবন বদলানোর ডাক দিচ্ছে ভারত কলিং

ঠিকই বলেছিলেন প্রবাদপ্রতিম মার্কিন লেখিকা মায়া অ্যাঞ্জেলিউ। ‘‘পরোপকারের ইচ্ছা অনেকেরই থাকে। কিন্তু তা করে দেখানোর মতো বুকের পাটা থাকে গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে।’’ মধ্য প্রদেশের সন্দীপ মেহতা বোধহয় সেই ‘গুটিকয়েক’ মানুষদের মধ্যে অন্যতম। ভারত কলিং নামের সংস্থা গড়ে যিনি হয়ে উঠেছেন গ্রামীণ এলাকায় শয়ে-শয়ে দুঃস্থ ছাত্র-ছাত্রীর কাছে অভিভাবক। দিচ্ছেন বটবৃক্ষের ছায়া। আর্থিক সহায়তা কিংবা সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা কোনও পড়ুয়া যাতে উচ্চশিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্যই তাঁর আন্দোলন।

শিক্ষার আলোয় গ্রামের জীবন বদলানোর ডাক দিচ্ছে ভারত কলিং

Monday September 14, 2015,

3 min Read

মধ্য প্রদেশের সাতপুরা জঙ্গল ঘেরা পাথরোটা গ্রাম। পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসা দূরের কথা, পাথরোটা গ্রামের কজন যে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে, তা হাতে গুনে বলা যায়। সেই গ্রামে, এক নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রতিনিধি সন্দীপ। পয়সা-কড়ি না থাকলেও, সন্দীপের বাবার ছিল পরোপকরারের নেশা। বাড়ি ঢোকার মুখে ছোট্ট কাঠের ফলকে তিনি লিখে রেখেছিলেন, ‘‘দয়া হি সুখ কা কারণ হ্যায়।’’ মজা করে কাঠের সেই ফলক খুলে রাখত ছেলে। বাবা আবার তা টাঙিয়ে দিত যথাস্থানে। তখন কে ভেবেছিল যে সুখের খোঁজে একদিন ছেলেই নামবে বাবার দেখানো পথে।


ভারত কলিং মানেই সন্দীপ মেহতা

ভারত কলিং মানেই সন্দীপ মেহতা


ছোটবেলার গল্প শোনাতে গিয়ে সন্দীপের মুখে ফিরে আসে বাবার কথা। ‘‘আর্থিক সমস্যা থাকলেও বাবা চাইতেন আমি পড়াশোনা করি। কিন্তু টিউশন ফি দিতে না পারায় মাঝেমধ্যেই ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া হত না।’’ দ্বাদশ শ্রেণিতে ফল খুব ভালো না হলেও, বিদিশার সম্রাট অশোক টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলেন। সন্দীপের কথায়, ‘‘স্কুলে আমার থেকে যারা ভালো রেজাল্ট করত, টাকা পয়সার অভাবে তাদের পড়াশোনা থমকে গেল। তুলনায় আমিতো ভাগ্যবান।’’

ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শেষ দিকে, দিওয়ালির আলোয় তখন ভাসছে বিশ্বচরাচর, সে সময় পাথোরটা গ্রামে মেহতা পরিবারের নেমে এল বিপর্যয়ের অন্ধকার। মারা গেলেন সন্দীপের বাবা। পরের দিন তাঁর অন্তিম যাত্রায় কত মানুষ। জলে ভেজা কত চোখ। পিতৃশোকে বিহ্বল ছেলে যেন কেবলই শুনতে পাচ্ছে, ‘‘দয়া হি সুখ কা কারণ হ্যায়।’’ শোকের দিনটাই যেন সন্দীপের জীবনকে ঘুরিয়ে দিল অন্য পথে।

ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক হলেও, নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য সন্দীপ ভর্তি হলেন টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সে। সমাজবিজ্ঞানের এমএ কোর্সে। পড়াশোনার মাঝেই খুল ফেললেন ভারত কলিং নামের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ভারতে যত গ্রাম, গ্রামে যত ছাত্র-ছাত্রী সব্বাইকে যেন ভারত কলিং দিতে চাইল আমন্ত্রণ বার্তা। ‘‘এসো, রুদ্ধদুয়ার খুলে তুমি প্রবেশ কর জ্ঞানের জগতে। নতুন ভারত তোমায় ডাকছে।’’

‘গ্রামীণ ভারতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ কতটা’- তা নিয়ে সন্দীপের গবেষণা। সন্দীপ টের পেলেন, অবস্থা শোচনীয়। গ্রামীণ এলাকায় দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করার আগেই পড়াশোনা ছেড়ে দেয় নব্বই শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী। অর্থাৎ ছোটবেলায় সন্দীপ যা দেখেছিলেন, যুবক বয়সেও দেখলেন ছবিটা একই রকম রয়েছে। তবে কি সময় বদলালেও অবস্থা বদলায় না ?



অভাব সত্যিই অভিশাপ। মেধা, বুদ্ধি হেরে যায় দারিদ্রের কাছে। উচ্চশিক্ষার জন্য চাই অর্থ। গবেষণার সময় যেন চোখ খুলে গেল সন্দীপের। বুঝতে পারলেন যে, নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে ‘রোল মডেল’ নেই। সাহায্য করার মতো কেউ নেই। অনলাইনে অ্যাপ্লিকেশন করার জন্য কম্পিউটার নেই। এত ‘নেই’ ডিঙিয়ে উচ্চশিক্ষার আঙিনায় পৌঁছানো যে অসম্ভব, তা সন্দীপের চেয়ে ভা্ল আর কেই বা বুঝবে। টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সের সহায়তায় ২০০৯ সালে তিনি গড়লেন ভারত কলিং। শুরুর দিকে স্কুলে স্কুলে গিয়ে সচেতনতা শিবির করতেন সন্দীপ। আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা গ্রামীণ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নিয়ে আসতেন কলেজের অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম। দরকারে তাঁদের নিয়ে যেতেন কলেজে। এখন মধ্য প্রদেশের সাতাশটি স্কুলে ছড়িয়ে পড়েছে ভারত কলিং-এর নেটওয়ার্ক। ফি বছর তাতে যোগ দেন এলাকার প্রায় ১২ হাজার ছাত্র-ছাত্রী। সন্দীপের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে, ভারত কলিং-এর স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে যোগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কত শিক্ষক।

সন্দীপের উদ্যোগ যেন মনে করিয়ে দেয় আফ্রিকার প্রাচীন প্রবাদের কথা। ‘‘তুমি যদি দ্রুত যেতে চাও, তবে একলা যাও। অনেক দূর যেতে চাইলে, যাও দল বেঁধে।’’ দ্রুত হাঁটতে চাইলেও, সন্দীপ যেতে চান দূরে। পাশে নিতে চান সহযোদ্ধাদের। যেমন ডিবিএস ব্যাঙ্ক ইন্ডিয়া। সন্দীপ বলেন, ‘‘প্রতিবন্ধকতাকে কীভাবে ডিঙিয়ে যাওয়া যায়, তা দেখাল ডিবিএস ব্যাঙ্ক। বুঝতে পারলাম য়ে ভালো কাজ করতে গেলে যেমন ভালো হৃদয়ের দরকার, সঙ্গে দরকার ক্ষুরধার মস্তিষ্ক।’’

ডিবিএস ব্যাঙ্ক এই মুহূর্তে ভারত কলিং-এর অন্যতম অংশীদার। ২০১২ সাল থেকে ভারত কলিং ছড়াতে লাগল দ্রুত গতিতে। টাকা-পয়সার অভাবে প্রত্যন্ত এলাকায় যেসব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে বসেছিল, তাদের মিলল সুযোগ। অনেকেই এখন কলেজে পড়ছে। কিংবা কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে রয়েছেন সন্দীপ। বলেন, ‘‘আগামী দশ বছরের মধ্যে যদি ভারত কলিং-এর প্রয়োজন না পড়ে, তবে সেটাই হবে স্বপ্নের দিন।’’ ভারত কলিং-এর স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করেন ডিবিএস ব্যাঙ্কের পাঁচশো কর্মী। সন্দীপের বক্তব্য, গ্রামীণ ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার জন্য যে বেসরকারি সংস্থাও কাজ করতে ‌রাজি আছে তার প্রমাণ ডিবিএস ব্যাঙ্ক। এবার যদি একইরকমভাবে যৌ থ উদ্যোগে নামে সরকার, তবে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়বে শিক্ষা। হয়তো দারিদ্র ঘুঁচবে একদিন।