রিল লাইফে অভিনেতা, রিয়েল লাইফে ট্যুর গাইড

রিল লাইফে অভিনেতা, রিয়েল লাইফে ট্যুর গাইড

Tuesday November 24, 2015,

3 min Read

‘আমি আমার পিতাকে খুন করেছি।’ অভিনেতা থেকে পেশাদার ট্যুর গাইড বনে যাওয়া অনুজ টিক্কুরের কবিতায় ঝরে পড়ে যন্ত্রণা, দুঃখ, হাহাকার। বছর তিনেক আগেকার কথা কর্মাশিয়াল অ্যাডে অভিনয়ের পর বলিউডের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষ্যে তখন একটু একটু করে এগিয়ে চলেছেন অনুজ। আচমকা নিউজ চ্যানেলে গোটা ভারত দেখল গ্রেফতার হয়েছেন অভিনেতা অভিনেতা টিক্কুর। মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা, হিড় হিড় করে তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ‘বাবাকে খুন করেছি সন্দেহে পুলিশ আমাকে ধরেছিল। ভোজালি দিয়ে আমার বাবাকে ১৫ বার কোপানো হয়েছিল। ১৫ বার।’ অনুজের কথায়, ‘ছিলাম অভিনেতা। সব্বার চোখে হয়ে গেলাম পিতৃঘাতক।’


image


অনুজ আঁচ পর্যন্ত করতে পারেননি বন্ধু বলে যাঁকে ভেবেছিলেন, সেই আসল চক্রী। মুম্বইয়ের ফ্ল্যাট হাঁকিয়ে নেওয়ার জন্য যে ফেঁদেছিল ভয়ঙ্কর ছক। ভাড়াটে খুনী লাগিয়ে অনুজের বাবাকে খুন করা হল ফ্ল্যাটের মধ্যে। আর অনুজ? বেড়াতে যাওয়ার নাম করে বিশ্বাসঘাতক বন্ধু তখন তাঁকে নিয়ে গিয়েছেন গোয়ায়। ‘হয়তো আমাকেও খুন করত। তার আগেই বাবার খুনী সন্দেহে আমাকে গ্রেফতার করা হল।’ তদন্তের পর আসল খুনী ধর পড়ল। মুক্তি পেলেন অনুজ।


image


ভয়ঙ্কর বিষের দংশনে অনুজ তখন জ্বলছেন। মনে হচ্ছিল বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে গোয়ায় না গেলে হয়তো বাবাকে মরতে হত না। বাবার শরীরে একের পর এক কোপ পড়েছিল শুধুমাত্র আমার জন্য। এই মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। আমিই খুনী। শরীরময় যন্ত্রণা। অজস্র খুনপোকা যেন ফোপরা করে দিয়েছে হৃদয়। মুম্বই ছেড়ে দেরাদুনে ঠাকুমা-ঠাকুর্দার কাছে চলে গেলেন অনুজ। বিক্রি করে দিলেন মুম্বইয়ের অভিশপ্ত ফ্ল্যাট। শুরু হল কবিতা লেখা এবং ভ্রমণ। চার ধাম থেকে অমরনাথ। জম্মু-কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী। উত্তর-পূর্ব ভারত, অমৃতসর, ওয়াঘা বর্ডার। অনুজের কথায়, ‘কত অচেনা মানুষ। কত ধর্ম। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলাম। মানুষের ওপর যে বিশ্বাসটা তোড়ে গিয়েছিল, তা ফিরে এল নিজের অজান্তে। শুরু করলাম পেশাদার ট্যুর গাইডের কাজ।’


image


কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স, মালদ্বীপ নিয়ে ১২টি দেশ ইতিমধ্যেই ঘুরে ফেলেছেন অনুজ। এখন তিনি স্কুবা ডাইভিং-এর প্রশিক্ষক। টিক্কুসট্র্যাভেলডটকম নামের ওয়েবসাইটে তিনি তুলে ধরছেন অচেনা সব ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন। সঙ্গে থাকে ভিডিও ক্লিপিংস। লেখেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। নানান দেশের বিচিত্র সব খানা-খাজানা। এক আকাশ ঝিকিমিকি তারার নীচে একলা শুয়ে থাকা ভার্জিন বিচ। কোথাও আবার মহার্ঘ সুরায় নিশি জীবন হয়ে ওঠে উদ্দাম। বেহিসেবী। এমন সব অভিজ্ঞতার কথা তুলতে ধরতে গিয়ে অনুজ নিজেও অকপট। বেপরোয়া। টিক্কুসট্র্যাভেলডটকম এখন রীতিমতো হিট। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ট্র্যাভেল সাইটও টিক্কুর শরণাপন্ন হয়েছে। কেউ চায় ছবি, তো কেউ লেখা। পেশাদার ট্যুর গাইড হিসাবে অনুজ শুরু করেছেন নতুন প্রজেক্ট। বলছেন, ‘বেড়াতে চল আমার সঙ্গে। আমিই হব তোমার গাইড।’


image


এভাবেই এক দেশ থেকে অন্য দেশ। আগামী ৭ বছরে ২০০টি দেশ ঘোরা অনুজের লক্ষ্য। অনুজ বলেন, ‘আমার তো নিজের কোনও পরিবার নেই। গোটা পৃথিবীটাই আমার পরিবার।’

বন্যা বিপর্যস্ত কেদারনাথে গিয়ে অনুজের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটা বরং তাঁর কাছ থেকেই শোনা যাক। ‘যেদিকে চোখ যায়, শুধুই বিপর্যয়ের ছবি। শুধু ভীমশিলা রয়েছে নিজের জায়গায়। মন্দিরের সামনে পড়ে থাকা সুবিশাল শিলায় বাধা পেয়ে প্লাবনের জল ঘুরে গিয়েছিল অন্য পথে। সেবার জনা কয়েক অঘোরি সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। বাবার সম্পর্কে ওঁদের জানিয়েছিলাম। এক সন্ন্যাসী বলেছিলেন, তোমার বাবা হলেন ভীমশিলা। নিজের জীবন দিয়ে উনি তোমাকে আগলে রেখেছিলেন। এখনও উনি তোমার সঙ্গে রয়েছেন।’


image


ব্লগ, ওয়েবসাইট, এদেশ থেকে ওদেশ। কখনও বা স্কুবা ডাইভিং। অচেনা অতিথি দেখে আলাপ জমাতে ছুটে আসে লাল-নীল মাছের ঝাঁক। খাড়াই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড় চুড়ো থেকে অনুজ দেখতে পান আলোকপ্রভা। দেখতে পান সূর্য গোটা পৃেথিবীকে আলোয় মাখিয়ে যেন বলছে, এস অন্ধকার থেকে এস আলোয়। অভূতপূর্ব সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করছেন অনুজ। নিজে যা দেখছেন তা সকলের সঙ্গে ভাগ করার জন্য।

লেখক — তরুশ ভল্লা

অনুবাদক — তন্ময় মুখোপাধ্যাকয়