খাইবার পাখতুনখোওয়া থেকে হিমালয়, মৃত্যুকে চুক্কি দিয়ে ক্যাপ্টেন কোহলির জয়

এ এমন এক মানুষের কাহিনি, যিনি জীবন দিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে জুঝেছেন বারবার। প্রতারণা, হানাহানি, দাঙ্গা, দেশভাগ দেখেছেন। আর নিজেকে একের পর চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়েছেন। এগিয়েছেন, লড়েছেন, জিতেছেন। ৮৪ বছরের সেই তরুণের নাম ক্যাপ্টেন মোহন সিং কোহলি।

খাইবার পাখতুনখোওয়া থেকে হিমালয়, মৃত্যুকে চুক্কি দিয়ে ক্যাপ্টেন কোহলির জয়

Saturday August 29, 2015,

6 min Read

বয়স থাবা বসিয়েছে শরীরে। কিন্তু মন এখনও তাজা। এই ৮৪ বছর বয়সেও অনায়াসে ফেলে আসা সময়কে ছুঁয়ে ফেলতে পারেন ক্যাপ্টেন মোহন সিং কোহলি। দিন-কাল-ঘটনা, স্মৃতিতে সবই থরেথরে সাজানো, যেন এতটুকুও মরচে পড়েনি।

image


শৈলশহর হরিপুরের কথা

ক্যাপ্টেন কোহলির জন্ম ১৯৩১ সালে খাইবার পাখতুনখোওয়ার হাজারায় অবস্থিত হরিপুরে। এখনও যা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নামেই পরিচিত। ক্যাপ্টেন কোহলির কথায় বারবার আসে পাহাড়ঘেরা এই হরিপুরের কথা। ছোট্ট একটা পার্বত্য শহর হরিপুর, যার বুক দিয়ে বয়ে চলেছে সিন্ধু নদ, চারপাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে হিমালয় ও কারাকোরাম রেঞ্জের পর্বতশ্রেণি। অধিবাসীদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছেন যাঁদের শরীরে রয়েছে গ্রিক রক্ত। ৩২৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় থেকেই এই ধারা চলছে। যুদ্ধ করতে এসে এদেশেই রয়ে গিয়েছিলেন বহু গ্রিক সৈনিক। সময়ের প্রবাহে তাদের বংশধররাই ছড়িয়ে গিয়েছেন হরিপুরের চারপাশে। তবে আজকের যে হরিপুর তা গড়ে তোলার কৃতিত্ব হাজারার দ্বিতীয় নিজাম জেনারেল হরি সিংহ নালওয়ার। " জানেন, হরিপুরমুখী এই পাহাড়ের ওপরেই আমার পূর্বপুরুষদের হত্যা করা হয়েছিল। সেই তখন থেকেই আমাদের পরিবারের কাছে এটা একটা তীর্থক্ষেত্র। সাত বছর বয়স থেকে শুরু করে আমার ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত সিন্ধু নদ সাঁতরে আমি ওই পাহাড়ের মাথায় চড়ে গিয়ে বসতাম", বললেন ক্যাপ্টেন কোহলি। তবে দেশভাগের পরে পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায় হরিপুর। অনেকেই পাকিস্তান ছাড়লেন। হরিপুর ছাড়লেন কোহলিরাও। কিন্তু শিকড়ের টানটা রয়েই গেল। এমনকী তিনি জীবনে যা কিছু করেছেন তার কৃতিত্ব এই হরিপুরকেই দিয়ে থাকেন ক্যাপ্টেন কোহলি। যারা এই হরিপুরের কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, তাদের জানাই ২০০৪ সালে এখানেই অস্থায়ী আস্তানা গেড়েছিল ওসামা বিন লাদেন। পরে অবশ্য হরিপুর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অ্যাবটাবাদে চলে যায় ওসামা। "আমাদের হরিপুরের চারপাশেই গায়ে গা লাগিয়ে পাহাড়-পর্বত। আপনি ১৫ মিনিটের মধ্যে একটা পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন। ২০০৪ সালে আমি নিজেও হরিপুরে ছিলাম। তবে ওসামার সঙ্গে দেখাটেখা হয়নি!", মুখ টিপে হেসে বললেন ক্যাপ্টেন কোহলি।

image


দেশভাগের যন্ত্রণায় হরিপুর

ক্যাপ্টেন কোহলি তখন সবে ষোলো। ১৯৪৭ সালে দাঙ্গা নাড়িয়ে দিয়ে গেল হরিপুরকে। মুসলিম লিগ যত শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগল, ততই পাকিস্তানের দাবি জোরদার হল। একের পর এক বিদ্রোহের সাক্ষী হল ভারতীয় উপমহাদেশ। ক্যাপ্টেন কোহলির কথায়, "প্রত্যেকদিন শয়ে-শয়ে মানুষ খুন হচ্ছে। আমি তখন ছাত্র। আমার বাড়িতে তখন দুটো বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক চলছে। সব ছেড়েছুড়ে অবিলম্বে পালান হবে, না আমার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে। যাইহোক মার্চে পরীক্ষা শেষ করেই চাকরির সন্ধানে গেলাম ভারতে। একটা চাকরির জন্য প্রায় পাঁচশোর মতো ছোটবড় কারখানায় গিয়েছিলাম। কিন্তু কাজ পেলাম না।" বিধ্বস্ত এই মানসিক অবস্থার মধ্যেই ২ জুন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে শুনলেন সেই ঘোষণা। দেশভাগের কথা ঘোষণা করলেন জওহরলাল নেহরু, মহম্মদ আলি জিন্না এবং বলদেব সিং। ক্যাপ্টেন কোহলি এবং তাঁর বাবা, সর্দার সুজন সিং কোহলি ফিরে গেলেন হরিপুরে। ঠিক তখনই ম্যাট্রিকুলেশনের ফল প্রকাশ হল। ৭৫০ নম্বরের মধ্যে ৬০০ পেয়ে জেলার মধ্যে সেরা হলেন ক্যাপ্টেন কোহলি। নতুন একটা দেশ (পাকিস্তান) তখন গড়ে উঠছে। লাহোরের ঐতিহ্যশালী সরকারি কলেজে (বর্তমানে যা গভর্ণমেন্ট কলেজ ইউনিভার্সিটি, লাহোর) পড়ার সুযোগ পেলেন তরুণ কোহলি। তবে সেই সুখ এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হল না। হঠাৎই কোনওরকম প্ররোচনা ছাড়াই হরিপুরে হামলা চালাল পাশের গ্রামের মানুষ। একসময় আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ধ্বংসলীলা চালিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল এখানকার সভ্যতা। দু-হাজার বছর পরে যেন সেই ধ্বংস, হত্যাই ফিরে এল। এবার ঘাতকের ভূমিকায় নিজের দেশেরই মানুষ। এখনও সেসব দিনের কথা ভাবলে শিউরে ওঠেন কোহলি। " আমরা তখন প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া। সারারাত প্রাণভয়ে দৌড়ে বেড়ালাম, যতক্ষণ না পুলিশ স্টেশন খুঁজে পেলাম। এরই মধ্যে কত লোককে মরতে দেখলাম। সেইসব হতভাগ্যদের গলা কেটে বাড়ির সামনে টাঙিয়ে দেওয়া হল", বললেন কোহলি। এক শিবির থেকে আর এক শিবিরে ঘুরতে ঘুরতে শেষপর্যন্ত তাঁরা পৌঁছলেন শিখদের পবিত্র ধর্মস্থান পাঞ্জা সাহিবে। মাসখানেক সেখানে থাকার পরে খোলা মালগাড়িতে চাপিয়ে তাঁদের পাঠানো হল ভারতে। মালগাড়ির ওপরে কাতারে-কাতারে মানুষ। উদ্বাস্তু। এরপর ফের ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা। মালগাড়িতে হামলা চালায় স্থানীয় পুলিশবাহিনী। ট্রেনের তিন হাজার সওয়ারির মধ্যে প্রায় হাজার খানেককে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হল। বাকিরা হয়তো বাঁচতেন না। যদি না সেইসময় এসে পড়ত বালুচ রেজিমেন্টের সেনাবোঝাই একটি ট্রেন। সেই ট্রেন থেকেই নেমে এলেন পাক সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্তা মহম্মদ আয়ুব খান।


image


প্রাণ বাঁচালেন আয়ুব খান

ছিন্নমূল,ভয়ার্ত নরনারীর সামনে যেন দেবদূত হয়ে দেখা দিলেন মহম্মদ আয়ুব খান। ঘটনা হল, একটা সময় কিছুদিন হরিপুরে কোহলিদের প্রতিবেশী হয়ে কাটিয়েছিলেন আয়ুব। তাঁকে চিনতে পেরে সর্দার সুজন সিং চেঁচিয়ে উঠলেন, "আয়ুব! আমাদের বাঁচাও!" এর উত্তরে আয়ুব খান কী বলেছিলেন তা এখনও স্পষ্ট মনে আছে ক্যাপ্টেন কোহলির। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সেদিন বলেছিলেন, "চিন্তা কোর না সুজন সিং, আমি এসে গিয়েছি।" আয়ুব খান কথা রেখেছিলেন। সেফ প্যাসেজ দিয়ে কোহলিদের পাঠিয়ে দিলেন গুজরানওয়ালায়। সেখানেও অভিজ্ঞতা সুখের হল না। হামলার পর হামলা চলল। এভাবেই অক্টোবরের মাঝামাঝি তাঁরা গিয়ে পৌঁছলেন দিল্লিতে। "প্রাণটা ছাড়া আমাদের তখন কিছুই ছিল না। পকেটে একটা পয়সা নেই। খালি পায়ে, ছেড়া জামাকাপড়ে আমরা নতুন জীবনের সন্ধান শুরু করলাম", বললেন ক্যাপ্টেন কোহলি। তবে তিনি যেখানেই থাকুন না । কেন, হিমালয় তাঁর পিছু ছাড়েনি। এরপরেও ছ-বার হরিপুরে গিয়েছেন কোহলি। শেষবার গিয়েছিলেন আয়ুব খানের ছেলের আমন্ত্রণে। তখন আয়ুব খান মারা গিয়েছেন। তাঁর সমাধির কাছে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন কোহলি বলেছিলেন, "আপনি আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। এটাই আমার শেষবারের মতো হরিপুরে আসা।" সেই সম্পর্ক অবশ্য শেষ হয়ে যায়নি। হরিপুরের মানুষ এখনও মনে রেখেছে ক্যাপ্টেন কোহলিকে। বহু অভিজ্ঞতার সাক্ষী কোহলির কথায়, "আসলে কী জানেন, গ্রামের এইসব মানুষ চান ভারত আর পাকিস্তানের একসঙ্গেই থাকা উচিত। এই রাজনীতিকরাই যত নষ্টের গোড়া।"

ভারতীয় নৌ বাহিনীতে ক্যাপ্টেন কোহলি

এক সময় ইন্ডিয়ান নেভিতে যোগ দিলেন ক্যাপ্টেন কোহলি। উচ্চপদস্থ কর্তারা তাঁকে জানালেন, ভারতের যে কোনও জায়গাকে নিজের হোমটাউন ঘোষণা করলে, সেখানে প্রতি দু-বছরে একবার সময় কাটানোর সুযোগ মিলবে। কোহলির জীবনে ফের ধরা দিল হিমালয়। কাশ্মীরের পহেলগাঁওকে নিজের হোমটাউন বলে ঘোষণা করলেন তিনি। ১৯৫৫ সালে সেখানে ঘুরেও এলেন। পহেলগাঁওয়ে থাকতেই সিদ্ধান্ত নিলেন, অমরনাথ গুহায় যাবেন। কিন্তু সে তো প্রায় ১২ হাজার ফুট উচ্চতায়। সঙ্গে গরমের সেরকম পোশাকও নেই। তাতেও দমলেন না কোহলি। স্যুট, টাই পরেই অমরনাথে উঠলেন তিনি। ক্যাপ্টেন কোহলির কথায়, "এভাবেই আমি একজন পর্বতারোহী হয়ে গেলাম।"

শৃঙ্গ অভিযানে ক্যাপ্টেন কোহলি

এরপর আর পর্বতারোহী ক্যাপ্টেন কোহলিকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৫৬ সালে জয় করলেন নন্দাকোট। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে, প্রাকৃতিক সব বাধা পেরিয়ে ১৭ হাজার ২৮৭ ফুট উচ্চতায় পৌঁছে গেলেন তিনি। পাঁচের দশকে সে এক সাড়া ফেলা ঘটনা। ঈশ্বরের নিজের দেশ থেকে যেন বাকি বিশ্বকে দেখা। আজও সেদিনের সেইসব কথা ভুলতে পারেন না ক্যাপ্টেন কোহলি। ১৯৬৩ সালে গেলেন অন্নপূর্ণা ৩ অভিযানে। সেখানেও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। লুঠপাট চালাল স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতী, দুজনকে পণবন্দি করা হল। শেষপর্যন্ত প্রাণ নিয়ে ফেরেন কোহলি। অভিযানের নেশা তখন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ১৯৬৫ সালে ক্যাপ্টেন কোহলির নেতৃত্বে এভারেস্ট অভিযানে সামিল হলেন ৯ জন। সঙ্গী হল আটশোর মতো মালবাহক আর পঞ্চাশজন শেরপা। এর আগে ১৯৬২ সালেও দু'বার এভারেস্ট অভিযান করেছিলেন কোহলি। তবে সাফল্য পাননি। একবার ২০০ মিটার এবং অন্যবার ১০০ মিটার দূর থেকেই ফিরতে হয়েছিল। তৃতীয়বারে কিন্তু সাফল্য ধরা দিল। এভারেস্ট জয় করলেন ক্যাপ্টেন কোহলি এবং বাকিরা। রচিত হল নয়া ইতিহাস। দেশে ফিরে দিল্লি বিমানবন্দরে পেলেন রাজকীয় অভ্যর্থনা।

তরুণ প্রজন্মকে কোহলির পরামর্শ

অ্যাডভেঞ্চার ছাড়া কোনও দেশ বা জাতি বড় হতে পারে না। এমনটাই মনে করেন ক্যাপ্টেন কোহলি। তিনি চান হিমালয়কে টুরিস্ট ডেস্টিনেশন না মনে করে ভালোবাসুক দেশের মানুষ। স্কুল ছাত্রছাত্রীদের ভ্রমণের জন্য সেখানে পাঠানো হোক। অল্প বয়সেই তৈরি হোক ভালোবাসা।