চাকরিজীবী বাবা-মায়ের ভরসা ‘ফুটপ্রিন্ট’

চাকরিজীবী বাবা-মায়ের ভরসা ‘ফুটপ্রিন্ট’

Thursday September 17, 2015,

5 min Read

আজকাল ছুটে চলার যুগ। বাচ্চা হওয়ার পর কদিন বা ছুটি মেলে মায়েদের। এতটা সময় ছোট্ট সোনার কী হাল হবে ভেবে কুল পান না বাবা-মায়েরা। অথচ কাজটাও করতে হবে। অতএব উপায়? চাকরিজীবী বাবা-মায়েদের সহজ সমাধান এনে দিয়েছে এমন অনেক সংস্থা রয়েছে সারা দেশজুড়ে। আর এই ভিড়ের মধ্যে জেরা হটকে ‘ফুটপ্রিন্ট’, দিল্লির এক চাইল্ড কেয়ার সেন্টার।

বিহারে কাজের দিনে বিকেল বেলা এক বৃদ্ধ দম্পতি বিভোর হয়ে স্মার্টফোনের স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। স্ক্রিনে যা ছিল নতুন কিছু নয়, অভাবনীয়ও কিছু নয়। তবু নিয়ম করে ওইভাবেই তাকিয়ে থাকেন বৃদ্ধ দম্পতি। আসলে ছোট্ট স্ক্রিনে তখন অঘোরে ঘুমোতে দেখা যাচ্ছে আদরের নাতিকে। কাছে কোথাও নয়, সুদূর দিল্লিতে ডে কেয়ার সেন্টারের সেই দৃশ্যই স্মার্টফোনে ভেসে উঠছে।

image


‘ফুটপ্রিন্ট’ যখন শুরু করেছিলেন ঠিক এটাই চেয়েছিলেন তিন বন্ধু পূর্বেশ শর্মা, রাজ সিঙ্ঘল এবং আশিস আগরওয়াল। কাছে থাক বা দূরে, ছোট্ট সোনা বাবা-মা, দাদু-দিদার কখনও চোখের আড়াল হবে না। ‘ফুটপ্রিন্ট’ চাইল্ডকেয়ার, একটি ডে কেয়ার সেন্টার এবং প্রিস্কুল চেইন। দিল্লি এবং তার আশেপাশে ‘ফুটপ্রিন্ট’এর বহু শাখা রয়েছে। আইআইটি দিল্লির তিন প্রাক্তনী চেয়েছিলেন পরিকল্পিত পাঠ্যক্রমের সঙ্গে প্রযুক্তিকে মিশিয়ে দিয়ে যাতে শিশুদের বিশ্বমানের যত্নআত্তির সুবিধা দেওয়া যায়। ‘আমাদের সব ক্লাসরুমে সিসিটিভি আছে। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে বাবা-মা লাইভ স্ট্রিম ভিডিও দেখতে পান। আমরা লক্ষ্য করেছি প্রথম কয়েক মাস, যতদিন না আমাদের ওপর ভরসা তৈরি হচ্ছে ততদিন, বাবা-মায়েরা সারাক্ষণ তাদের সন্তানদের নজরে রাখেন। কিন্তু দাদু-দিদারা তো প্রতিদিন সারক্ষণই তাকিয়ে থাকেন’, জানান পূর্বেশ, সহ প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও, ‘ফুটপ্রিন্ট’ চাইল্ড কেয়ার।

৯০ এর মাঝামাঝিতে তিন বন্ধুর সাক্ষাৎ হয় আইআইটি দিল্লিতে, তিনজনই তখন আন্ডার গ্র্যাজুয়েট। পড়াশুনো শেষে তিন জন তিন দিকে ছড়িয়ে পড়েন। ২০০৯ এর পরে পূর্বেশ আর রাজ অবশ্য ব্রিকরেড টেকনোলজি নামে একটি প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে একসঙ্গে কাজ করেন। পূর্বেশ সমসময় উদ্যোক্তা হওয়ার কথা ভাবতেন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘ফুটপ্রিন্ট’ শুরু করার আগে তিনি আরও দুটি সফল ভেঞ্চার চালিয়েছিলেন। তার একটা হল ই-লার্নিং সংস্থা এবং দ্বিতীয়টি সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট সংস্থা। পূর্বেশের প্রথম সন্তান করীর জন্মায় ওই দুটি ভেঞ্চারের মাঝামাঝি সময়ে। ছেলের জন্মের পর সবকিছু যেন বদলে যায় পূর্বেশের জীবনে।

ছেলেকে রাখার জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার খুঁজছিলেন। আমেরিকা বা ব্রিটেনে যে ডে-কেয়ার সেন্টারগুলি রয়েছে তার সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে দেখেন ভারতে এমন একটিও নেই। কোনওটিই ছেলের জন্য মনে ধরল না পূর্বেশের। ‘প্রথম পাঁচ-ছয় বছর বাচ্চাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ওই সময় তাদের মেধার বিকাশ ঘটে। দেখলাম এখানকার প্রি-স্কুলগুলি সেদিকে নজরই দেয় না’,বলেন পূর্বেশ। নিজে যে অসুবিধায় পড়েছিলেন সেই অবস্থা যেন অন্য বাবা-মায়েদের না হয়, তাদের সুবিধার কথা ভেবে তাঁর অন্য দুই বন্ধুর সঙ্গে ডে-কেয়ার সেন্টার খোলার সিদ্ধান্ত নেন। লক্ষ্য ছিল তার মাধ্যমে শিশুর সম্পূর্ণ বিকাশ। ২০১২র জুলাইয়ে গুরগাঁওতে প্রথম ‘ফুটপ্রিন্ট’ চাইল্ড কেয়ার সেন্টারের উদ্বোধন হয়।

গুরগাঁও ও নয়ডাতে এখন পাঁচটি জায়গায় ‘ফুটপ্রিন্ট’ রয়েছে। তিন মাস থেকে ৪ বছরের বাচ্চা নেওয়া হয়। সব সেন্টারেই শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং কেয়ারটেকাররা থাকেন। শিক্ষক শিক্ষিকারা বিশেষভাবে পরিকল্পিত পাঠ্যক্রম অনুসরণ করেন। অন্যদিকে কেয়ারটেকাররা বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন। ‘আমরা চেয়েছিলাম ‘ফুটপ্রিন্ট’ এমন একটা জায়গা হবে যেখানে শিশুরা অন্য শিশুদের সঙ্গ উপভোগ করবে। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত শিক্ষক-শিক্ষিকার মাধ্যমে মূল এবং প্রয়োজনীয় জীবনশৈলীর শিক্ষাও পাবে’, বলেন উদ্যোক্তা পূর্বেশ। ‘ফুটপ্রিন্ট’ মূলত হাইস্কুপের রিচার্স করা শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে। জোর দেওয়া হয় বড়দের সঙ্গে শিশুদের আলাপচারিতার ওপর। খুব সকর্তভাবে শেখার পরিবেশ তৈরি করা হয় যা শিশুদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করে। ‘আপনি ভাবতে পারেন তিন মাসের একটা বাচ্চা পড়াশেনার কী বুঝবে? শুনলে অবাক হবেন শিশুরা জন্মের পর প্রথম কয়েক মাস দেখে, গন্ধ শুঁকে, শব্দ শুনে বোঝার চেষ্টা করে। তারপর মুখ চেনার চেষ্টা করে, ডাকে সাড়া দেয়। তাহলে মেধার বিকাশ ঘটার এরচেয়ে ভাল সময়আর কী হতে পারে?’, প্রশ্ন পূর্বেশের। যে শিশুদের ‘ফুটপ্রিন্ট’এ নিয়ে আসা হয় তারা যাতে সারাদিন ব্যলেন্সড ডায়েট (সুষম খাবার) পায় সেদিকেও নজর থাকে। বাব-মায়েরা নিজেরাও বাড়িতে রান্না করা খাবার দিয়ে যেতে পারেন। বাবা-মা সাধারণত শিশুদের যা হজম হয় তেমন খাবার তৈরি করেন। কিন্তু ‘ফুটপ্রিন্ট’এ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মত খাবারের মেনু থাকে শিশুদের জন্য। সারা বছরে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ রকমের ফল এবং সবজি দিয়ে তারা যাতে পুষ্টিকর এবং সুষম খাবার পায় সেদিকে নজর দিই। সিসিটিভি ফুটেজে ক্লাসরুমে লাইভ স্ট্রিমিং ছাড়াও বাবা-মায়েরা সঙ্গে সঙ্গে এসএমএসেও আপডেট পেতে থাকেন বাচ্চা কখন খাচ্ছে, কখন ঘুমোচ্ছে অথবা যখন যাই করছে সবকিছুর। আমেরিকান অথবা ব্রিটেনের ডে-কেয়ার সেন্টারগুলির তুলনায় ‘ফুটপ্রিন্ট’ ভারতীয় বাবা-মায়েদের সাধ্যের মধ্যে এই পরিষেবা দেয়। খাবার ছাড়া বছরে ১.৩ লক্ষ টাকা (মাসে ১১.০০০ টাকা)এবং খাবার নিয়ে ১.৫ লাখ (১২,৫০০ টাকা মাসে)টাকা নেয় ‘ফুটপ্রিন্ট’।

K-12 এডুকেশনের একটি রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, সারা ভারতে ৩০০ মিলিয়ন বাচ্চা স্কুলে পড়ে। যার মানে দাঁড়ায় ডে-কেয়ারগুলির যথেষ্ট ভালো বাজার রয়েছে। ‘ভারতে অর্থনীতি দ্রুত উর্দ্ধমুখী। দেশের মধ্যবিত্তের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে। যাদের বেশিরভাগই সন্তানের পড়াশোনা এবং দেখাশোনায় খরচ করতে আগ্রহী। ফলে আগামী বছরগুলিতে শিশুদের পড়াশোনা এবং তাদের জন্য ডে-কেয়ারগুলির বাজার দ্রুত বাড়বে’, অনুমান ‘ফুটপ্রিন্ট’এর সিইও রাজ সিঙ্ঘলের। সারা দেশে এমন আরও কয়েকটি ভেঞ্চার রয়েছে। যেমন, ক্লে স্কুলস (সারা ভারতে), উই কেয়ার (বেঙ্গালুরু) এবং মাদারস প্রাইড (সারা ভারতে)।

২০১২ সালে লঞ্চের পর এই ক বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকা আয় করেছে ‘ফুটপ্রিন্ট’। ৫টি সেন্টারে ৭০০ বাচ্চা ভর্তি হয়। আপাতত ৪০০ বাচ্চা রয়েছে। ভালো পুঁজি উদ্যোক্তাদের সহায়তা পেয়েছে এই সংস্থা। এই কবছরে এনজেল ইনভেস্টরদের কাছ থেকে ৭ কোটি টাকা তুলেছে।

‘দিল্লিতে আমরা আরও ৪০টি চাইল্ড কেয়ার সেন্টার খুলছি। কয়েকমাসের মধ্য সব মেট্রো শহরে পৌঁছে যাব’, জানান পূর্বেশ। সঙ্গে যোগ করেন শিগগিরই মুম্বই, বেঙ্গালুরু, পুনে এবং হায়দরাবাদেও ‘ফুটপ্রিন্ট’ পৌঁছ যাবে।