মায়ের ওষুধ খুঁজতে দক্ষিণ থেকে উত্তর কলকাতা চষে ফেলেছিলেন পণ্ডিত যশরাজ

মায়ের ওষুধ খুঁজতে দক্ষিণ থেকে উত্তর কলকাতা চষে ফেলেছিলেন পণ্ডিত যশরাজ

Saturday November 28, 2015,

3 min Read

সাফল্যের পিছনে লড়াই থাকে। দীর্ঘ সেই ইতিহাস। কখনও আমরা জানতে পারি, কখনও হারিয়ে যায় সাফল্যের গৌরবগাঁথায়। আচমকাই হয়তো একদিন সেই লড়াইয়ের গল্প আমাদের সামনে চলে আসে। যেমন চলে এল এই সেদিন হায়দরাবাদে এক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায়। হিন্দুস্তানী রাগসঙ্গীতের জগতে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র পণ্ডিত যশরাজ একসময় কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় হন্যে হয়ে খুজেছেন মায়ের ওষুধ। অথবা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন, প্রতিবছর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে কেন তিনি চলে আসেন হায়দরাবাদে!

হায়দরাবাদের অম্বরপেটে তাঁর বাবার সমাধি। সেখানেই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটান তিনি। স্মৃতি রোমন্থন করেন। বাবার থেকে পাওয়া তাঁর সঙ্গীত। অথচ মাত্র চার-পাঁচ বছর বয়সে বাবা মারা যান। আর তারপরই শুরু সেই লম্বা লড়াই।

সেই সমাধির সামনে বসেই ইওরস্টোরির আঞ্চলিক ভাষার ম্যানেজিং এডিটর ড. অরবিন্দ যাদবের সঙ্গে নিখাদ আড্ডা দিলেন পণ্ডিতজি। তাতেই উঠে এল নানা কিস্যা। বললেন, আজকের এই সাফল্যের পরও তাঁর লড়াই জারি রয়েছে, প্রতিটি দিন, প্রতিটা মুহূর্তই তাঁর কাছে একটি লড়াই।

image


বাবার সেবা করার সুযোগ পাননি, মা সঙ্গে ছিলেন, কিন্তু তিনিও আক্রান্ত হন দুরারোগ্য ক্যান্সারে। পঞ্চাশের দশকে ক্যান্সার হওয়া কতটা ভয়ঙ্কর ছিল আজ তা আন্দাজ করা মুশকিল। ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খুঁজতে খুঁজতে পায়ে হেঁটে দক্ষিণ কলকাতা থেকে মধ্য কলকাতায় পৌঁছোন তরুণ যশরাজ। বেশিরভাগ ওষুধের দোকানই সেই সময় এই ওষুধ রাখতই না, শেষ পর্যন্ত একটি দোকানে ওষুধ পাওয়া গেলেও তা কেনার মতো অত টাকা ছিল না। তিনি বললেন, “পকেটে যা ছিল সবটাই দিয়ে বললাম, বাকি টাকা পরে দেব। দোকানের লোকেদের উত্তর ছিল, ওষুধের দোকানে কখনও ধারে বিক্রি শুনেছেন? কিন্তু ঠিক সময়ই কেউ আমার কাঁধে হাত রাখলেন, দোকানের লোকেদের বললেন, যা টাকা আছে নাও, আর পুরো ওষুধ দিয়ে দাও, বাকি টাকা আমার খাতায় লিখে দিও, উনি ছিলেন ওই দোকানের মালিক, জানিনা আমাকে কীভাবে চিনতেন”।

পণ্ডিত যশরাজ মনে করেন লড়াই, পরিশ্রম, রেওয়াজ সব কিছুই জীবনে জরুরি, কিন্তু এই সব কিছুর সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন ভগবানের দাক্ষিণ্য। ওটাই লড়াইয়ের সঙ্গী হয়. পণ্ডিতজি সারা জীবন, হাজার হাজার মানুষকে মাটি থেকে আকাশে পৌঁছনোর পথ দেখিয়েছেন। ওঁনার নিজের জীবনের অনেক গল্পই মানুষকে নতুন রাস্তা দেখাতে পারে। আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে পণ্ডিতজি বললেন, “মায়ের ওষুধের ব্যবস্থাতো হয়ে গেছিল, কিন্তু ডাক্তার বলেছিল দিনে দু’বার ইঞ্জেকশন দিতে হবে মাকে। এরজন্য ডাক্তারের একবার আসার ভিসিট ছিল ১৫ টাকা, দিনে ৩০ টাকা দেওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল, কিন্তু মায়ের ব্যাপার তাই বাধ্য হয়ে রাজি হয়ে যাই। দ্বিতীয়দিন যখন ডাক্তারবাবু যাচ্ছেন আমি বললাম আজ সন্ধে বেলা অল ইন্ডিয়া রেডিওতে আমি গাইছি, শুনবেন। ডাক্তারবাবু জানালেন গানে উত্সাহ নেই তার, আর ওইদিন ওঁনার ভাইঝির বাড়িতে নিমন্ত্রণ আছে। আমি নিরাশ হই, কিন্তু পরদিন যখন এলেন ওনার মেজাজ পুরো অন্যরকম ছিল। উনি বললেন, ‘আমি তোমার গান শুনেছি, আমার ভাইঝির বাড়িতে, আর আমার ভাইঝি বলেছে এই গায়কদের পয়সা থাকে না। ওনার ওই ভাইঝি ছিলেন গীতা রায়, পরে যিনি গীতা দত্ত নামে পরিচিত হন। এরপর থেকে ডাক্তারবাবু ২ টাকা ভিসিট নিতে শুরু করেন। এভাবেই লড়াইয়ের দিনগুলিতে কাউকে কাউকে আমি পাশে পেয়েছিলাম”।

পণ্ডিত যশরাজ মনে করেন, লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই সাফল্য পাওয়া যায়, কিন্তু তিনি এও মনে করেন যে সফল ব্যক্তিদের ‘আমি’র উপর নজর দেওয়া উচিত নয়। মানুষ যখন নিজেকে নিয়ে অহঙ্কারী হয়ে ওঠে তখন সে শেষ হয়ে যায়। তার লড়াইও মূল্যহীন হয়ে যায়।

পণ্ডিতজির ছেলেবেলার কিছুদিন হায়দ্রাবাদে কেটেছে.। এখানকার গুলিগুডা চমন ও নামপল্লীতে ছোটবেলার নানা স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে তাঁর। স্কুলে যাওয়ার পথে একটি সস্তার হোটেলের কথা মনে আছে তাঁর, এখানেই বেগম আখতারের গজল, ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে, ভরনা কাহি তকদির তামাশা না বানা দে’ শুনতেন ছোটবেলায়। তাঁর স্কুল ছাড়ার পিছনে এই গজলই দায়ী বলে মনে করেন তিনি। এরপর শুরু করেন তবলা বাজাতে। বহু বছর পর লাহোরে গায়ক হিসেবে মঞ্চের মুখ্য আকর্ষণ হয়ে উঠতে চান তিনি, আর তারপর গায়ক হওয়ার জন্যও দীর্ঘ লড়াই চলতে থাকে।

তিনি মনে করেন, তাঁর এই লম্বা জীবন থেকে যদি কিছু শেখার থাকে, তা হল কাজ করে যাও। গানের যদি ইচ্ছে থাকে, তাহলে রেওয়াজ করতে থাক আর ভগবানের দয়ার জন্য অপেক্ষা কর।

(লেখা- ড. অরবিন্দ যাদব, অনুবাদ- সানন্দা দাশগুপ্ত )